আড্ডা অর্থের বিনিময়ে সুনিশ্চিত হয় কি না, তাই নিয়ে আমার কিছু সংশয় আছে। সান্নিধ্য ক্রয় করা যেতে পারে কিন্তু যাঁরা আসছেন তাঁদের সঙ্গে আড্ডা জমবে কি না, কথা বলে ভাল লাগবে কি না– এর কোনও আগাম নির্ধারক হয় বলে জানা নেই। যেখানে আড্ডার সঙ্গে পরিষেবা জুড়ে নেই সেখানে আড্ডা না জমলে মন ভরে না, কিন্তু ব্যাগও খালি হয় না। এখানে অর্থের বিনিময়ে আড্ডার প্রত্যাশা আছে তাই আলাপচারিতা মনোমতো করে তোলার প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
কথার দাম আছে– আলংকারিক অর্থে শুনেছি। তার আক্ষরিক প্রয়োগ খবরের শিরোনামে দেখলাম। পড়লাম, পয়সা দিয়ে আড্ডা কিনছেন প্রবীণরা। আড্ডা, যা স্বতঃস্ফূর্ত, তা অর্থের বিনিময়ে পেতে হবে ভাবলে প্রাথমিকভাবে একটু ধাক্কা লাগতে পারে। কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়াও উঠে আসতে পারে।
কিন্তু তলিয়ে দেখলে বিষয়টির মধ্যে কিছু ইতিবাচক সম্ভবনা থেকে যায়। কেন আড্ডা দেওয়ার মানুষ কমে যাচ্ছে, কেন নতুন প্রজন্ম অন্যত্র পাড়ি দিল, কেন এক বাড়িতে থাকলেও সেই নৈকট্য রইল না– এই গ্লানি বা দোষারোপ দিয়ে বিষয়টি দেখলে সমালোচনার রসদ মিলবে। সমাধান মিলবে না। প্রতিটি একা হয়ে যাওয়ার আখ্যান আলাদা। তার কারণও আলাদা। হয়তো সে প্রবীণ নিঃসন্তান। হয়তো সন্তান অন্য দেশ থেকে যখন ভিডিও কল করেন তখন এই মানুষটির শরীরে ঘুমের অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। ফলে কেজো কথাটুকুই হয়ে ওঠে। হয়তো সন্তান বা সন্তানসম একই বাড়িতে থাকেন কিন্তু তারও জীবনের ঘড়ি অন্য দায়িত্বের কবজিতে বাঁধা। তাঁর সারাদিনের শ্রম অভিভাবকদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করছে কিন্তু যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন আড্ডা দেওয়া দূরে থাক, ‘রা’ কাটার মতো উদ্যমটুকুও অবশিষ্ট নেই। বহু সময় অভিভাবকরাও হয়তো বুঝতে পারছেন, আমার সন্তান ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে, আবারও ওঁকে একথা-ওকথার মধ্যে ফেলব? এসব ভেবে তাঁরাও হয়তো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছেন, নিজেকে গুটিয়ে ফেলছেন। অথবা বাড়ির সদস্যদের পরস্পরের জন্য সময় আছে– কিন্তু মানসিকতার বিরাট তফাত। কথা এগোলে আড্ডা নয়, ঝগড়া অবধারিত। এই প্রতিটি মানুষ কখনও গমগমে বাড়িতে একা। কখনও ফাঁকা বাড়িতে একা। যে নবীন একা বোধ করে, সে হেঁটে-চলে আড্ডার বৃত্তের কাছে পৌঁছতে পারে। কিন্তু শারীরিক কারণেও যে প্রবীণ মানুষটি তার সচল মন নিয়ে বাড়িতে রয়ে গেলেন তার কাছে আড্ডা নিজেই না হয় এল! আসছে!
………………………………………..
পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: বেলজিয়ামের শ্রমআইনে যৌনকর্মীদের ‘না’ বলার অধিকার সুরক্ষিত
………………………………………….
একা হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে অনেক অনুমান কাজ করে। বড় পরিবার হলে এমন হত না, সন্তান অন্য জায়গায় চাকরি না করলে এমনটা হত না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি মনে করি, প্রতিটি অনুমানই তর্কসাপেক্ষ। আমরা এমন অনেক বড় পরিবারের কথাই জানি, যার মধ্যে কোনও এক কাকা কোনও এক মাসি, একা বোধ করতেন। হয়তো কোনও কোনও দিন তিনি বাইরে বেরিয়ে আড্ডার মানুষ খুঁজে নিতেন। এই মানুষগুলিও পরবর্তীকালে যখন বয়স বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বাড়িতে আটকে পড়তেন বাড়ির মানুষরা বিপদে পাশে দাঁড়াত। কিন্তু আড্ডা? মন ভরে মন মেলে কথা বলার শোনার মানুষ কি তাঁরাও পেতেন?
একার জীবনে যদি অর্থের বিনিময়েও আড্ডামনস্ক মানুষের আনাগোনা নিশ্চিত করা যায়, তাতে সমস্যা কোথায়? পরিষেবার নিরিখে সাম্প্রতিক অতীতে আমরা অনেক বদল দেখেছি। সুরাহা দেখেছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বিলাসদ্রব্য, ওষুধ, ফিজিওথেরাপিস্ট বাড়িতে আসছেন। রোজকার খাওয়া নিজের রান্নাঘরেই আটকে নেই। ‘থালি’ আসছে। এমনকী, প্রেমের ক্ষেত্রেও ডেটিং অ্যাপের ব্যবহার বাড়ছে। সে-ও তো এক ধরনের পরিষেবা। আমরা এই সব বদলে স্বচ্ছন্দ হচ্ছি। হয়তো আড্ডাও সেইভাবে এক নতুন পরিষেবার অংশ হয়ে উঠবে।
বুড়ো বয়সে একাকিত্ব ভয়াবহ ইত্যাদি বলে বলে সমাজ সারাক্ষণ ভয় দেখায়। এই ভয় আত্মকরুণা বাড়ায়। নিজের চোখে নিজের আগামী ছবিকে সঙ্কুচিত করে। অকাজ করে। উপকারে আসে না। পরিষেবার অভিনবত্ব সব আশঙ্কার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিকল্প যাপনের সম্ভাবনা নির্মাণ করে। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শুনলেই আগে যে ভীতি বা ক্ষোভ জন্মাত, এখন সেই ভাবনাতেও বদল আসছে। অনেক প্রবীণ মানুষ স্বেচ্ছায় একটা পরিষেবা সমৃদ্ধ কমিউনিটি লিভিং চাইছেন। অনেকে মনে করছেন তাতে বয়সকালে একটা সুরক্ষিত পরিবেশে আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে বেঁচে থাকা সম্ভব। একইভাবে নিজের বাড়িতে থেকেও শরীর-মন সুরক্ষিত এবং আনন্দিত রাখার পরিষেবাও গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক সুস্থতার, আরামের পাশাপাশি মানসিক ভালো থাকার কিছু রসদ না হয় কলিং বেল বাজাক। এ-ও এক অবধারিত বদল। এক অনিবার্য দিশা।
……………………………………………………………
যাঁরা আড্ডা-সঙ্গী হচ্ছেন তাঁরা অন্যের ধাঁচ বুঝে যদি নিজেদের পড়াশোনা ও আগ্রহের চর্চাকে ক্ষুরধার করতে পারেন, তাহলে আড্ডা আরও মনোগ্রাহী হতে পারে। ধরা যাক, কারও সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল, ওই মানুষটির সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তিনি অমুক ধরনের গান শোনেন। কিংবা বিশেষ কোনও রাজনৈতিক ভাবনা তাঁকে আলোড়িত করে। সেই প্রবীণ মানুষটির বাড়ি আবারও যাওয়ার আগে এই নবীন যদি সেই বিষয়গুলির একটু চর্চা করে যান, তাহলে দু’জনের কথোপকথনের সংযোগসেতু আরও মসৃণ এবং মজবুত হতে পারে।
……………………………………………………………
যেহেতু এই আড্ডার বৈঠক পরিষেবার অংশ হয়ে আসছে সেখানে দু’পক্ষের মধ্যে একতা সমতা তৈরি হতে পারে। যে প্রবীণ মানুষটি এ পরিষেবা নিচ্ছেন তাঁরও ‘আরেকদিন এসো’ বলতে কুণ্ঠিত লাগার কথা নয়। এখানে দ্বিধা বা অনুকম্পার অবকাশ নেই। বয়ঃপ্রবীণ মানুষরা নির্ভার সান্নিধ্য পাচ্ছেন। উল্টোদিকে যাঁরা এই পরিষেবা নিয়ে আসছেন, তাঁদেরও তো জীবিকার সুরাহা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দু’-পক্ষের মধ্যেই একধরনের পরস্পরকে ভালো রাখার সেতুবন্ধন হচ্ছে।
আড্ডা অর্থের বিনিময়ে সুনিশ্চিত হয় কি না, তাই নিয়ে আমার কিছু সংশয় আছে। সান্নিধ্য ক্রয় করা যেতে পারে কিন্তু যাঁরা আসছেন তাঁদের সঙ্গে আড্ডা জমবে কি না, কথা বলে ভাল লাগবে কি না– এর কোনও আগাম নির্ধারক হয় বলে জানা নেই। যেখানে আড্ডার সঙ্গে পরিষেবা জুড়ে নেই সেখানে আড্ডা না জমলে মন ভরে না, কিন্তু ব্যাগও খালি হয় না। এখানে অর্থের বিনিময়ে আড্ডার প্রত্যাশা আছে তাই আলাপচারিতা মনমতো করে তোলার প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
যে সমস্ত বেসরকারি সংস্থা এই পরিষেবা দিচ্ছে, তারা হয়তো ইতিমধ্যেই তেমন প্রয়াস রাখছে। আমার তাদের কর্মপদ্ধতি বা পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনও সরাসরি অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু মানুষের মন আড্ডার মাধ্যমে আদতে কী চায়, সে সম্পর্কে যা বুঝেছি তার ভিত্তিতে কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি।
যাঁরা আড্ডা-সঙ্গী হচ্ছেন তাঁরা অন্যের ধাঁচ বুঝে যদি নিজেদের পড়াশোনা ও আগ্রহের চর্চাকে ক্ষুরধার করতে পারেন, তাহলে আড্ডা আরও মনোগ্রাহী হতে পারে। ধরা যাক, কারও সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল, ওই মানুষটির সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তিনি অমুক ধরনের গান শোনেন। কিংবা বিশেষ কোনও রাজনৈতিক ভাবনা তাঁকে আলোড়িত করে। সেই প্রবীণ মানুষটির বাড়ি আবারও যাওয়ার আগে এই নবীন যদি সেই বিষয়গুলির একটু চর্চা করে যান, তাহলে দু’জনের কথোপকথনের সংযোগসেতু আরও মসৃণ এবং মজবুত হতে পারে। একটা চাকরিতে যেমন নিজেকে নিয়ত উন্নত করার চেষ্টা চলতে থাকে, এখানেও ব্যাপারটা সেরকমই। যাঁরা এই পরিষেবা দিচ্ছেন, তাঁরা যদি এ ব্যাপারে আরেকটু অনুশীলন রাখেন তাহলে আড্ডায় শুধু অর্থ বিনিয়োগ হয় না, আড্ডা অর্থপূর্ণও হতে পারে।
…………………………………………………………………..
আরও পড়ুন অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: মৃত্যু নিয়ে এই লেখা পড়তে অসুবিধে হলে থেমে যাবেন
…………………………………………………………………..
‘আহা ওরা বয়স্ক, ওদের কথা বলার কেউ নেই’, এই অমার্জিত মনোভাব আড্ডার পরিপন্থী। দায়সারা কৃপাদৃষ্টিপাত করে আমরা কথাপ্রার্থীদের যেন ‘অসহায়’ বলে গণ্য না করি। আড্ডা দিতে এসে যেন তার একঘেয়েমি বাড়িয়ে না ফেলি। এক বয়স্ক মানুষের বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে এলাম– এই গয়ংগচ্ছ ভাব যেন না থাকে। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে তার সময়ের গল্প নিহিত থাকে। একখণ্ড ইতিহাস থেকে যায়। আড্ডা সেইসব গল্পকে এক থেকে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করে। সমৃদ্ধ করে। এই সংযোগ এই প্রাপ্তি পারস্পরিক। এখানে কেউ ‘আহারে’ নন। এখানে কেউ ত্রাতা নন।
পরিষেবা যদি দিতেই হয়, তা আরও উন্নত হোক।
সংবাদপত্রে এই খবরটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, এই আড্ডা কি শুধু প্রবীণ নাগরিকদেরই প্রয়োজন? আমরা, যারা তুলনামূলকভাবে কম প্রবীণ, তারাও কি মনের কথা বলার মতো, মন খুলে আড্ডা দেওয়ার মতো অভিপ্রেত সান্নিধ্য চারপাশ থেকে পাই? আমাদেরও কখনও নির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য কিছু গ্রুপের মেম্বারশিপ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ তৈরি হতে পারে। আমরা তো আগে স্টাডি সার্কেল, লাইব্রেরি সার্কেল দেখে এসেছি। আমাদের শহরে যদি সুসংহতভাবে ছোট ছোট আড্ডা সার্কেল থাকে, আগ্রহী ব্যক্তির জন্য সদস্য হওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি হয়– হয়তো সেখানে বয়স নির্বিশেষে মানুষ জুড়তে চাইবেন।
চাইবেন। কারণ আড্ডা পুরনো হলেও আড্ডার বয়স হয় না।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………