প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ-জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের অঙ্গ হিসেবে ১-৮ মার্চ ১৯৩৭ আয়োজিত বিশ্বধর্মসম্মেলনের ১৮টি অধিবেশনের একটিতে সভাপতি হতেও রাজি হয়ে যান। নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লেখেন, ‘হেনকালে ডাক পড়ল পার্লামেন্ট অফ রিলিজন্সে (যদ্দৃষ্ট)– মার্চ মাসের প্রারম্ভে। রথীরা পর্যন্ত বললে এটা কাটানো চলবে না– ভালো মানুষের মত মেনে নিলুম।’ ৪ মার্চ ১৯৩৭ কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত সেই অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ইংরাজিতে ২৫ মিনিটের এক মূল্যবান ভাষণ দেন। পরবর্তীকালে বহু প্রশংসিত এই বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন, ‘পরমহংসদেবকে আমি ভক্তি করি। ধর্মনৈতিক ধ্বংসবাদের যুগে তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ উপলব্ধি করিয়া উহার সত্যতা প্রমাণ করিয়াছেন…।’
তাঁর নামটি অভিনব: ত্রিষ্টুপ– সংস্কৃত ছন্দ ‘ত্রিষ্টুভ’-এর অপভ্রংশ হয়তো। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে জয়নগর ইনস্টিটিউশনের তরুণ প্রধান শিক্ষক এই ত্রিষ্টুপ মুখোপাধ্যায় কবিগুরুকে ‘রামকৃষ্ণ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ’ করার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছিলেন। একবার ১৯৩১ সালে, তারপর আবার ১৯৩৩-এ। তাঁর ‘রামকৃষ্ণ-কথা’ গ্রন্থে তিনি জানিয়েছেন, ‘…যোগভ্রষ্ট সাধক রবীন্দ্রনাথকে ধরেছিলাম শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে তিনি কেমন দেখেছিলেন তাই লিখতে।’ রবীন্দ্রনাথের বিশেষণ প্রাপ্তির কখনও অভাব ঘটেনি, তবু সেই তালিকায় ‘যোগভ্রষ্ট সাধক’ নিশ্চয়ই স্বাতন্ত্র্যে চমকপ্রদ। আর ‘কেমন দেখেছিলেন’ বলতে নিশ্চয়ই শ্যামবাজার ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে ২ মে ১৮৮৩ রামকৃষ্ণদেবকে অল্পবয়সি রবীন্দ্রের চাক্ষুষ করার কথা শুধু বলা হচ্ছে না, কবির চোখে রামকৃষ্ণ কেমনভাবে প্রতীয়মান, সেটিই জানতে চাওয়া হয়েছে।
ত্রিষ্টুপের প্রস্তাব কবিকে নিশ্চিতভাবেই অস্বস্তিতে ফেলে। শ্রীরামকৃষ্ণের সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সেই কালী পূজারীকে ভক্তি প্রদর্শন সহজ নয়। এই দোলাচল স্পষ্ট হয় দুই দশক আগেই। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩১৮ সংখ্যায় তাঁর ‘রোমীয় বহুদেববাদের পরিণতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি দেখাতে চাইছিলেন, রোমক ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের মৌলিক বিরোধ থাকলেও ক্রমশ মিলনের বাতাবরণ তৈরি হয়; দেশীয় পাঠকদের বোধগম্য উদাহরণ হিসেবে তিনি লেখেন, ‘বর্ত্তমান ভারতে ব্রাহ্মধর্মের সহিত নবজাগ্রত হিন্দুধর্মেরও প্রায় এইরূপ সম্বন্ধ দেখা যায়। সেইজন্যই কেশবচন্দ্রের সহিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের যোগ অথবা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শেষ বয়সের মতের সঙ্গে হিন্দুসমাজের মতের মিলন এরূপ সম্ভবপর হইয়াছে।’
এই সশ্রদ্ধ ইতিহাস বিশ্লেষণের পরের মাসেই ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পৌষ ১৩১৮ সংখ্যায় তাঁর ‘রূপ ও অরূপ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের নামোল্লেখ না করে অবাঞ্ছিত শ্লেষ প্রকাশ করলেন, “…শুনা যায় শক্তি-উপাসক কোনও একজন বিখ্যাত ভক্ত মহাত্মা আলিপুর পশুশালায় সিংহকে বিশেষ করিয়া দেখিবার জন্য অতিশয় ব্যাকুলতা প্রকাশ করিয়াছিলেন– কেন না সিংহ ‘মায়ের বাহন’। শক্তিকে সিংহরূপে কল্পনা করিতে দোষ নাই কিন্তু সিংহকেই যদি শক্তিরূপে দেখি তবে কল্পনার মহত্ত্বই চলিয়া যায়।” বাস্তবিক রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, ‘চিড়িয়াখানা দেখতে লয়ে গিছল। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম! ঈশ্বরীর বাহনকে দেখে ঈশ্বরীর উদ্দীপন হল…!’ অর্থাৎ, রামকৃষ্ণদেবের মূল বক্তব্য ঈশ্বরের উদ্দীপন বিষয়ে, সিংহ সেখানে উদ্দীপক মাত্র; ‘সিংহকেই শক্তিরূপে’ বা ঈশ্বরী রূপে দেখার প্রশ্নই উঠছে না।
পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ সাহিত্যিক কুমুদবন্ধু সেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক গভীরতা অনুধাবন না করে রবীন্দ্রনাথের করা এই মন্তব্যকে ‘অনধিকার চর্চা’ বলে আক্রমণ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রাহ্মভক্তরা যাঁকে একাধারে শাক্ত, বৈষ্ণব, বৈদান্তিক যোগী বলে নির্দেশ করেছেন, তাঁকে শুধু শক্তির উপাসক, ভক্ত বলে উল্লেখ করা (রবিবাবুর) উদারতার পরিচায়ক হয়নি।’ (উদ্বোধন, আশ্বিন ১৩৯৮)
কবির এই ভ্রান্ত বিশ্লেষণের প্রসঙ্গ আপাতত সরিয়ে আমরা বরং প্রশ্ন করি তাঁর ‘শুনা যায়’ কথাটি নিয়ে। ‘শুনা যায়’ না কি ‘পড়া যায়’? এই প্রবন্ধ প্রকাশের ঠিক এক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-এর চতুর্থ খণ্ড, যেখানে গড়ের মাঠে যাওয়া প্রসঙ্গে রয়েছে রামকৃষ্ণদেবের এই উক্তি (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৪-র বিবরণী)। এই সমাপতন নিশ্চয়ই প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়, কিন্তু ত্রিষ্টুপকে লেখা চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথ কথামৃত পাঠের কথা কার্যত প্রকাশ করেছেন।
…………………………………………………………….
অস্বস্তি সত্ত্বেও পত্রলেখককে উত্তর দেওয়ার সৌজন্যবোধে অবিচল রবীন্দ্রনাথ ত্রিষ্টুপের দু’টি চিঠিরই উত্তর দিয়েছিলেন যথাক্রমে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ এবং ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ তারিখে। দু’টি চিঠিতেই তিনি তাঁর কথামৃত পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম চিঠিতে লিখেছেন, ‘পরমহংসদেবের কথোপকথনের যে বিবরণ আমি পড়েচি তার কোনো কোনো অংশ মনে হল বিদেশী সাধকদের কথা থেকে সংগৃহীত।’ আর দ্বিতীয় পত্রে, ‘পরমহংসদেবের কথোপকথন লিপিবদ্ধ হয়েচে। বহুকাল পূর্ব্বে পড়েছিলেম। মনে ধারণা হয়েছিল বানানো কথা আছে। কিন্তু সেটা আমার ভুল হওয়া অসম্ভব নয়।’
…………………………………………………………….
অস্বস্তি সত্ত্বেও পত্রলেখককে উত্তর দেওয়ার সৌজন্যবোধে অবিচল রবীন্দ্রনাথ ত্রিষ্টুপের দু’টি চিঠিরই উত্তর দিয়েছিলেন যথাক্রমে ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১ এবং ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ তারিখে। দু’টি চিঠিতেই তিনি তাঁর কথামৃত পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম চিঠিতে লিখেছেন, ‘পরমহংসদেবের কথোপকথনের যে বিবরণ আমি পড়েচি তার কোনো কোনো অংশ মনে হল বিদেশী সাধকদের কথা থেকে সংগৃহীত।’ আর দ্বিতীয় পত্রে, ‘পরমহংসদেবের কথোপকথন লিপিবদ্ধ হয়েচে। বহুকাল পূর্ব্বে পড়েছিলেম। মনে ধারণা হয়েছিল বানানো কথা আছে। কিন্তু সেটা আমার ভুল হওয়া অসম্ভব নয়।’ রবীন্দ্রনাথ কথামৃতের অংশবিশেষ পাঠ করেছিলেন, এই তথ্যটুকু সাব্যস্ত করা ছাড়া তাঁর এই পত্রাংশ নিয়ে আর আলোচনা বৃথা, কারণ রামকৃষ্ণদেবের ঘনিষ্ঠ ভক্তদের সাক্ষ্য তাঁর তোলা সন্দেহকে বহু আগেই অমূলক প্রমাণ করেছে।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই দুই পত্রোত্তরের মূল উদ্দেশ্য ত্রিষ্টুপের আহ্বানের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন। দুই চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর অপারগতার কথা জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় চিঠিতে স্পষ্টতর ভাষায়, ‘পরমহংসদেব সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে কিছু লিখি এই তোমার ইচ্ছা। তোমার এই অনুরোধ পালন করা আমার পক্ষে কঠিন। তার প্রধান কারণ, আমার যে শিক্ষা দীক্ষা, আমার যে চিন্তার প্রণালী; যে স্বভাব যে অভ্যাস তাতে তাঁর সম্বন্ধে পর্যালোচনা আমার পক্ষে বিহিত হবে না। যে কারণেই হোক্ যাঁর সঙ্গে চিত্তের সঙ্গতি ঘটেনি তাকে (?তাঁকে) সম্যকরূপে চিনতে পারা ও বিচার করা অসম্ভব।’
আশ্চর্যের কথা, ১৯৩৩ সালে এই চিঠি লেখার এক বছরের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ চিত্তের অসংগতি অনেকটা বুঝি কাটিয়ে ওঠেন। ‘বিচিত্রা’ মাসিকপত্রের আশ্বিন থেকে অগ্রহায়ণ ১৩৪০-এ প্রকাশিত তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মালঞ্চ’-র নায়িকা নীরজা রামকৃষ্ণদেবের ভক্ত। উপন্যাস শুরু হচ্ছে অসুস্থ নীরজার ঘরের বর্ণনা দিয়ে। সেখানে ‘দেয়ালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ছবি’। এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে নীরজা তার দেশপ্রেমিক খুড়তুতো দেওর রমেনকে বলে, ‘যখন চোখের জলে ভিতরে ভিতরে বুক ভেসে যায় তখন ওই পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু ওঁর বাণী তো হৃদয়ে পৌঁছয় না।’ এই কথোপকথনের শেষ দিকে “পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে দু-হাত জোড় করে (নীরজা) বললে, ‘বল দাও ঠাকুর, বল দাও, মুক্তি দাও মতিহীন অধম নারীকে।’ ”
দেখতে দেখতে এসে যায় ১৯৩৬ সালে রামকৃষ্ণ-জন্মশতবর্ষ। তার আগের বছর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কিছু বরিষ্ঠ সন্ন্যাসী শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অমিয়কুমার চক্রবর্তীর মাধ্যমে কবিকে একটি বাণী দেওয়ার অনুরোধ জানান। তাঁর দেওয়া সংক্ষিপ্ত ইংরেজি বাণীটি সঙ্ঘের ইংরেজি মুখপত্র ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে কবি এটির যে ছন্দোবদ্ধ বঙ্গানুবাদ করেন, সেই “বহু সাধকের/ বহু সাধনার ধারা/ ধেয়ানে তোমার/ মিলিত হয়েছে তা’রা।/…” রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বহু উদ্ধৃত যথার্থ মূল্যায়ন। এটি প্রকাশিত হয় একযোগে ‘প্রবাসী’ ও ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার পরের সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৩৬)।
এরপর প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ-জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের অঙ্গ হিসেবে ১-৮ মার্চ ১৯৩৭ আয়োজিত বিশ্বধর্মসম্মেলনের ১৮টি অধিবেশনের একটিতে সভাপতি হতেও রাজি হয়ে যান। নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লেখেন, ‘হেনকালে ডাক পড়ল পার্লামেন্ট অফ রিলিজন্সে (যদ্দৃষ্ট)– মার্চ মাসের প্রারম্ভে। রথীরা পর্যন্ত বললে এটা কাটানো চলবে না– ভালো মানুষের মত মেনে নিলুম।’ ৪ মার্চ ১৯৩৭ কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত সেই অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ইংরাজিতে ২৫ মিনিটের এক মূল্যবান ভাষণ দেন। তাঁর সহবক্তাদের মধ্যে ছিলেন সরোজিনী নাইডু, ব্রিটিশ রাজপুরুষ তথা যশস্বী লেখক স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ড। পরবর্তীকালে বহু প্রশংসিত এই বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন, ‘পরমহংসদেবকে আমি ভক্তি করি। ধর্মনৈতিক ধ্বংসবাদের যুগে তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ উপলব্ধি করিয়া উহার সত্যতা প্রমাণ করিয়াছেন…।’
কালক্ষেপ নিশ্চয়ই হল। কিন্তু বিশ্বকবি শেষ পর্যন্ত চিনে নিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শ্রেষ্ঠত্ব। দেশ-বিদেশের প্রণাম যেখানে আকর্ষিত সেখানে তিনিও ঢেলে দিলেন তাঁর অকুণ্ঠ প্রণতি।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
ঋণ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (শঙ্করীপ্রসাদ বসু ও বিমলকুমার ঘোষ সম্পাদিত)। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দ। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আশ্রম, হাওড়া।
রবীন্দ্রবীক্ষা, সংখ্যা ৩০। বিশ্বভারতী।
স্বামী মেধসানন্দ। রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচেতনা ও শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্ক।