সংবাদের জগতে মহিলা খেলোয়াড়দের প্রতিচ্ছবি পিতৃতান্ত্রিক মননেরই এক প্রতিফলন। সংবাদ সৃষ্টি হয় সমাজ থেকে এবং সংবাদ প্রভাবিত করে সমাজকে। যেহেতু সংবাদমাধ্যমের রেটিং দরকার, তাই সাংবাদিকরা সমাজের মূলস্রোতের দিকে তাকিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। আর এই মূলস্রোত– পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো। এই কাঠামোতে মেয়েদের কর্ম নিপুণতাকে দৃশ্যমান করা হয় না। ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহিলাদের খেলার কভারেজ দেওয়া হয় মাত্র ৪ শতাংশ। কারণ, ধারণা এমন যে লোকে মহিলাদের খেলা দেখতে আগ্রহী নয় এবং যারা দেখবে তাদের আগ্রহ প্রতিযোগীদের শরীর উপভোগ করা নিয়ে।
এই বছর অলিম্পিক শুরু হওয়ার আগে, সোশাল মিডিয়ায় একটি খবর বারবার চোখে পড়েছে– প্যারিসে প্রথম সমান সংখ্যক পুরুষ ও নারী প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করবেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা খেলার জগতে নারী-পুরুষের সমমর্যাদার পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রচারিত হয়। অলিম্পিক শুরু হওয়ার পর এটাও জানা যায় যে, খেলার জগতে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে অলিম্পিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিসেস (ওবিএস) ক্যামেরা অপারেটরদের অনুরোধ করে, মহিলা খেলোয়াড়দের খেলা সম্প্রচারে যেন কোনও বৈষম্য না আসে।
ওবিএস-এর প্রধান নির্বাহী ইয়ানিস এক্সার্চোস প্যারিসে সাংবাদিকদের বলেন, কিছু খেলাতে মহিলাদের এখনও এমনভাবে দেখানো হচ্ছে, যেখান থেকে বোঝা যায় যে স্টেরিওটাইপ এবং লিঙ্গবৈষম্য এখনও সমানভাবে বিরাজমান। ক্যামেরা অপারেটররা পুরুষ ও মহিলা খেলোয়াড়দের ভিন্ন দৃষ্টিতে সম্প্রচার করেন। তিনি এটিকে ক্যামেরা অপারেটর এবং সম্পাদকদের অবচেতন পক্ষপাতিত্ব বলে অভিহিত করেছেন। উনি এটাও বলেছেন, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বেশি ক্লোজ-আপ শট দেখায়। এক্সার্চোসের কথা ইঙ্গিত করে যে মহিলাদের খেলার পারদর্শিতার চেয়ে দোলায়িত শরীরটাকে বেশি ফোকাসে রাখা হয়।
এই অবচেতন পক্ষপাতিত্ব ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকের সম্প্রচারে প্রতিফলিত হয়েছিল। সেই বছর বিচ ভলিবলের সম্প্রচার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। খেলোয়াড়দের দক্ষতা উপেক্ষিত হয়েছিল তাঁদের শারীরিক রূপের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলগুলি মহিলাদের শরীরে এমনভাবে জুম হয়েছিল, যা মার্জিত নয়। সমস্যাযুক্ত ছবিগুলির পাশাপাশি, রিও অলিম্পিকের ভাষ্যকাররা মহিলা খেলোয়াড়দের কৃতিত্বকে অমর্যাদা করেছিলেন। যেমন হাঙ্গেরিয়ান সাঁতারু কাতিনকা হোসু-র বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার অর্জনকে ম্লান করে দিয়ে একজন ভাষ্যকার তাঁর প্রাক্তন স্বামী এবং কোচ শেন টুসাপসকে কৃতিত্ব জানান।
রিও অলিম্পিকের কভারেজ নিয়ে পরবর্তীতে এক আলোড়ন ওঠে। মহিলা খেলোয়াড়দের সম্প্রচারণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমালোচনা হয়। এবং, ৮ বছর পর, ওবিএস মহিলা ও পুরুষের খেলার সমমর্যাদার জন্য আহ্বান জানিয়ে নিজেদের সংশোধনের চেষ্টা করে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা বিফল।
সাঁতারে ৪x১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে অস্ট্রেলিয়ান মহিলা খেলোয়াড়রা সোনা জেতেন। এই আনন্দে দর্শকের দিকে তাঁদের হাত নাড়ানো দেখে ভাষ্যকার বব বলার্ডের ভাষ্যে চরম পিতৃতান্ত্রিক বক্তব্য উঠে আসে। তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ‘শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। আপনারা জানেন মহিলারা কেমন… ঘুরে বেড়ায়, মেকআপ করে।’ এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েন এবং তাঁকে ভাষ্যকারের পদ থেকে অপসারিত করা হয়।
…………………………………………………………………..
সাঁতারে ৪x১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে অস্ট্রেলিয়ান মহিলা খেলোয়াড়রা সোনা জেতেন। এই আনন্দে দর্শকের দিকে তাঁদের হাত নাড়ানো দেখে ভাষ্যকার বব বলার্ডের ভাষ্যে চরম পিতৃতান্ত্রিক বক্তব্য উঠে আসে। তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ‘শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। আপনারা জানেন মহিলারা কেমন… ঘুরে বেড়ায়, মেকআপ করে।’ এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েন এবং তাঁকে ভাষ্যকারের পদ থেকে অপসারিত করা হয়।
…………………………………………………………………..
সংবাদের জগতে মহিলা খেলোয়াড়দের প্রতিচ্ছবি পিতৃতান্ত্রিক মননেরই এক প্রতিফলন। সংবাদ সৃষ্টি হয় সমাজ থেকে এবং সংবাদ প্রভাবিত করে সমাজকে। যেহেতু সংবাদমাধ্যমের রেটিং দরকার, তাই সাংবাদিকরা সমাজের মূলস্রোতের দিকে তাকিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। আর এই মূলস্রোত– পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো। এই কাঠামোতে মেয়েদের কর্ম নিপুণতাকে দৃশ্যমান করা হয় না। ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহিলাদের খেলার কভারেজ দেওয়া হয় মাত্র ৪ শতাংশ। কারণ, ধারণা এমন যে লোকে মহিলাদের খেলা দেখতে আগ্রহী নয় এবং যারা দেখবে তাদের আগ্রহ প্রতিযোগীদের শরীর উপভোগ করা নিয়ে। খেলার দক্ষতা ছাপিয়ে তাঁদের প্রাধান্য দেওয়া হয় নারীত্ব ও মাতৃত্ব প্রকাশের নিপুণতাকে প্রচার করে। কারণ সমাজের দৃষ্টিতে নারীর পরিসর গৃহের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। তিনি বাইরের পরিসরে এসে যত সাফল্যই অর্জন করুন না কেন, তাঁকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গৃহের সাফল্য নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হয়।
অপরদিকে, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার আরেক দৃষ্টান্ত মহিলা ক্রীড়া সাংবাদিক, ভাষ্যকার ও সংবাদ প্রযোজকের পরিসংখ্যান। ২০২২ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, খেলার জগতে মহিলাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত কম। মাত্র ১৫ শতাংশ ক্রীড়া সাংবাদিক মহিলা। একইভাবে, দ্য অ্যাটলান্টিক জার্নাল অফ কমিউনিকেশন দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২,২৪২টি খেলা সম্পর্কিত সংবাদমাধ্যমের লেখার মধ্যে ৯৪.৯ শতাংশ পুরুষ সাংবাদিকের লেখা এবং মাত্র ৫.১ শতাংশ মহিলা সাংবাদিক দ্বারা লিখিত।
……………………………………………………………………………
আরও পড়ুন তিতাস সমূহ-র লেখা: খেলিফের ‘পৌরুষ’ বিতর্ক নগ্ন করেছে ট্রান্স-মানুষদের বিরুদ্ধে সমাজের অসূয়াকে
……………………………………………………………………………
এই বছর, প্যারিস অলিম্পিকের সময়, ওবিএস ক্রীড়া সম্প্রচারে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার চেষ্টা করেছে। প্রযোজনা, সম্পাদনা এবং প্রযুক্তিগত সম্প্রচারের ভূমিকায় চেষ্টা করেছে আরও বেশি মহিলাকে শামিল করার। মহিলা ভাষ্যকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৪০ শতাংশ করেছে, যা রিও অলিম্পিক থেকে ২০০ শতাংশ বেশি। এই প্রচেষ্টাগুলি প্রশংসনীয়। কিন্তু তবু মেনে নেওয়া যায় না, বলার্ডের মতো সিনিয়র ভাষ্যকারের মুখ থেকে মহিলা খেলোয়াড়দের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক ভাষ্য প্রচার হলে।
আমাদের, অর্থাৎ সাংবাদিকদের দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলি সমাধান করার। মহিলাদের খেলার সম্প্রচারের পরিমাণ বাড়ানোর এবং সেখানে খেলার দক্ষতাকেই প্রাধান্য দেওয়ার। এবং সংবাদ পরিবেশনে মহিলা ক্রীড়া সাংবাদিকদের বেশি উৎসাহ দেওয়ার। পুরুষ ও মহিলা খেলোয়াড়দের সমান সংখ্যক অংশগ্রহণকে যতই উদযাপন করি না কেন, ক্যামেরা অপারেটর বা ভাষ্যকারদের কাছে যতই আবেদন জানাই না কেন, পদ্ধতিগতভাবে প্রত্যেক ধাপে পরিবর্তন না এলে লিঙ্গবৈষম্য দূর হবে না। কেবলমাত্র লিঙ্গসাম্য দেখানোর বাহ্যিক চমক হয়েই থাকবে।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….