অভিনেতা যে নাকি সারা শরীর দিয়ে তাকে অনুভব করতে চায়, যার মধ্যে একটা হ্যাংলামো আছে। এই শিক্ষানবিশি পর্বে কখনও কখনও মনে হয়েছে, এই যে অভিনেতার যাপন, তা নিয়ে এত হইহইয়ের কী আছে! শুরুর ওই সময়টায় আমরা যেভাবে অভিনয়কে আয়ত্তের চেষ্টা করেছি, খেয়াল করে দেখেছি, সেসময় আমরা হাত-পা ছুঁড়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। মঞ্চে কবিতা পাঠ করতে গিয়ে একটি শব্দকেও ছাড় দিতাম না। মনে হত, এই শব্দকে কবি যখন নির্বাচন করেছেন, তখন এর উচ্চারণেও বিশেষ কিছু একটা আছে। সেটাকেই তুলে ধরতে হবে দর্শকের সামনে। ছাঁচে-ফেলা এই যে প্রয়াস, সেটা যে বিরক্তিকর, বড়ই অদ্ভুত, সেটা বুঝেছি অনেক পরে। বুঝেছি বয়সের সঙ্গে।
১৩.
মানুষের জীবনে বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার পাত্র পরিপূর্ণ হয়। তার এই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার নেপথ্যে বয়সের একটা মস্ত ভূমিকা থাকে। অভিনেতার ক্ষেত্রেও তাই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে আরও অভিজ্ঞ হয়। সেই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় তার অভিনয়ে। মানুষের কিংবা একজন অভিনেতার যেমন বয়স হয়, তেমনই অভিনয়েরও বয়স আছে। অভিনেতা অভিনয়ের সেই বয়সকে আত্মস্থ করেন তার যাপনের মধ্যে দিয়ে।
বয়সের এই বিবর্তন খোলা চোখে ধরা না পড়াই স্বাভাবিক, আসলে সেটা অনুভবভেদ্য। দর্শককেও সেটা বলে বোঝানো কষ্টকর। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, যার মধ্যে দিয়ে একজন অভিনেতাকে যেতে হয়। হয়তো এমন অভিজ্ঞতা কমবেশি অনেকেই অনুভব করেন, আবার হতে পারে এই অনুভব কেবলমাত্র অভিনেতার অন্তরেই প্রকট হয়ে বেশি করে। সব পেশাদারদের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটবে এমন নয়।
যখন শিক্ষানবিশ হিসেবে অভিনয় শুরু করি, সেটা আজ থেকে বহু বছর আগে, ১৯৮৬-তে, ‘নান্দীকার’-এ, তখন আমার বয়স ছিল ২২ বছর। ’৮৬ সালে অভিনয়ের শুরুর দিকে, থিয়েটারকে ২৪ ঘণ্টার কাজ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম। তবে তখনও জানতাম না, অদূরভবিষ্যতে এই ভালোলাগা কাজটাই আমার পেশা হয়ে দাঁড়াবে, নাটক এবং নাটকের মঞ্চকে আশ্রয় করে আমি পেশাদার হয়ে উঠব। একটা নতুন কিছু শেখার অদম্য ইচ্ছা, নাট্যকলাকে ঘিরে সেই তাগিদ অনুভব করেই এই কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। আসলে স্বপ্ন ছিল নাটকের রন্ধনশালায় ঢুকে দেখার চেষ্টা করব, বোঝার চেষ্টা করব, কীভাবে উৎকৃষ্ট নাট্য-ব্যঞ্জন প্রস্তুত হয়, যা দেখে ও আস্বাদনে মোহিত হয়ে পড়ে দর্শক। এ ভেবেই আসা। কিন্তু দেখলাম যে, নাটক যা কি না তিলোত্তমা অর্থাৎ কালেকটিভ আর্ট, একাধিক শিল্পের সংমিশ্রণ, তা আয়ত্ত করতে গেলে একটা শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে অপরটাকেও জানতে হয়, বুঝতে হয় অর্থাৎ চর্চা করতে হয় নিরন্তরভাবে। এই যাপনটা নেশার মতো।
একজন অপরিচিতের সঙ্গে যখন আমাদের প্রথম আলাপ হয়, প্রাথমিক আলাপচারিতায় আমরা তার নাম জিজ্ঞাসা করি। সেটা প্রাথমিক পরিচয় মাত্র। সেই প্রাথমিক পরিচয়ের মোড়কটুকু খুলে গেলে তারপর নানা কথায় তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়। আমরা তখন মানুষটাকে অন্যভাবে চেনার চেষ্টা করি। বুঝতে পারি, প্রাথমিক পরিচয়ে যে মানুষটার সঙ্গে প্রথমে আলাপ হয়েছিল, সেই মানুষটা আর এই মানুষটা মোটেই এক নয়। আলাদা। তাকে তখন আরও জানার, আরও বোঝার আগ্রহটা মনের মধ্যে বাড়তে থাকে। এভাবেই থিয়েটারের অঙ্গনে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে দেখেছি যে, শিল্পকলার একটা ধাপ থেকে আরেকটায়, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে। সেগুলো যত জানছি, যত শিখছি, তত বিস্মিত হচ্ছি।
আমরা গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়তাম। কিন্তু অভিনয়ের ভিতরে যখন এলাম, তখন নাটকের ওই চরিত্রগুলোকে পড়তে গিয়ে দেখলাম, একটা অন্য মানে খোঁজার চেষ্টা করছি। অভিনেতার বয়ানে ওই চরিত্রগুলোকে দেখছি। অভিনেতা যে নাকি সারা শরীর দিয়ে তাকে অনুভব করতে চায়, যার মধ্যে একটা হ্যাংলামো আছে। এই শিক্ষানবিশি পর্বে কখনও কখনও মনে হয়েছে, এই যে অভিনেতার যাপন, তা নিয়ে এত হইহইয়ের কী আছে! শুরুর ওই সময়টায় আমরা যেভাবে অভিনয়কে আয়ত্তের চেষ্টা করেছি, খেয়াল করে দেখেছি, সেসময় আমরা হাত-পা ছুঁড়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। মঞ্চে কবিতা পাঠ করতে গিয়ে একটি শব্দকেও ছাড় দিতাম না। মনে হত, এই শব্দকে কবি যখন নির্বাচন করেছেন, তখন এর উচ্চারণেও বিশেষ কিছু একটা আছে। সেটাকেই তুলে ধরতে হবে দর্শকের সামনে। ছাঁচে-ফেলা এই যে প্রয়াস, সেটা যে বিরক্তিকর, বড়ই অদ্ভুত, সেটা বুঝেছি অনেক পরে। বুঝেছি বয়সের সঙ্গে।
এতকিছু বলার একটাই কারণ, তা অভিনয়ের বয়স বোঝানোর জন্য। আসলে একাধিক শিল্পকলার চর্চা করতে গিয়ে এর হদিস পায় অভিনেতা। যেমনভাবে থিয়েটারের মঞ্চসজ্জা শিখতে গিয়ে আমাদের মধ্যে রঙের ব্যবহার, নানা খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। ঠিক তেমনই শিল্পকলার একটা ধাপ থেকে আরেকটা ধাপে যাওয়ার সময়ও অভিজ্ঞতার স্পর্শে আমাদের মধ্যে সেই আগ্রহের সৃষ্টি হয় বারবার করে। তো সেই ’৮৬-তে যখন অভিনয় শুরু করলাম, তার ঠিক একবছর পর অর্থাৎ ১৯৮৭-তে একটা নাটক করেছিলাম, নাম ছিল ‘ফুটবল’। এই নাটকটি আগেও অভিনীত হয়েছে। সেই নাটকে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম আমি। পরবর্তীতে এই ‘ফুটবল’ নাটকে সমস্ত পুরুষ চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি, শুধু রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত যে-চরিত্রে অভিনয় করতেন, সেই চরিত্রটা ছাড়া।
………………………………………………………………….
অভিনয় করব কি করব না, সেই সংশয় আমাকেও গ্রাস করেছে। জীবনে এই যে ঘাত-প্রতিঘাত, নানা ঘটনার বিচ্ছুরণ, স্বপ্নভঙ্গ থেকে নতুন স্বপ্ন গড়ে ওঠা, মনের নানাবিধ পরিবর্তন– এই সমস্তকিছু বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে অভিনেতা হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। হয়েছি বলেই আমি যে অভিনয়টা ২২ বছর বয়সে করতাম, করে যে প্রতিক্রিয়া পেতাম, তা হয়তো আজও পাই, কিন্তু সেই অভিনয় যে আজ অন্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে পারি।
………………………………………………………………….
তারপর যে মৌলিক নাটকে আমি অভিনয় করি, সেটি হল ‘শেষ সাক্ষাৎকার’। রুশ নাটক ‘লাস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ থেকে বাংলা করেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। মুখ্য চরিত্র চারটি। অভিনয় করেছিলাম আমি, গৌতম হালদার, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত নিজে। আর একটি ছোট্ট চরিত্র ছিল, যাতে অভিনয় করেন পার্থপ্রতিম দেব। এই নাটকটি যখন করছি, আমার জন্য যে চরিত্রটি বরাদ্দ হল, সেটি বেশ বড় চরিত্র। স্বাতীলেখাদির তেমন কোনও সংলাপ ছিল না। একমাত্র নাটকের বিরতিতে ও শেষে তাঁর কিছু সংলাপ ছিল। স্টেজে তাঁর উপস্থিতিটাই বা বলা ভালো নীরব থাকাটাই ছিল সংলাপের নামান্তর, অভিনয়ের কুশলতা। মূল কথাগুলো বলতেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। সাধারণ মানুষের যে চরিত্রটি, সেটায় অভিনয় করতেন তিনি। আর ছিল মন্ত্রী ও আমলা। সেই মন্ত্রীর চরিত্রে ছিল গৌতম হালদার। আমি আমলার চরিত্রে। নাটকে দেখানো হয়েছে, মন্ত্রীর ঘরে একজন সাধারণ মানুষ এসে তাঁকে বলছে, মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করতে।
আমার চরিত্রটি একটি ধুরন্ধর ক্যারেকটার। সে মন্ত্রীকে চালনা করে। মন্ত্রী ও আমলা দু’জনেই একদা ডাক্তার ছিল। এই চরিত্রে অভিনয় যখন করছি তখন সবে একুশ পেরিয়ে ২২-এ পা দিয়েছি। আমলা বিষয়টি ঠিক কী, সেই সময় এসম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা আমার ছিল না। আসলে চোখের সামনে আমলার দৈনন্দিন জীবন, তাদের জটিলতা কখনও দেখিনি। যেটুকু জানা, সেটা বই পড়ে। আর এর-ওর মুখ থেকে শুনে, জেনে। এই নাটকটা আমরা অভিনয় করেছিলাম বহুদিন, প্রায় ১৫ বছর। এই নাটকে প্রথম যেদিন অভিনয় করলাম, আর ১৫ বছর পর যখন অভিনয় করছি, মাঝে অনেকটা সময় কিন্তু আমি পেরিয়ে এসেছি। তিরিশের পর বা মধ্যতিরিশে যখন সেই চরিত্রটায় আমি অভিনয় করছি, খেয়াল করে দেখেছি আমি স্টেজে সেই একই জায়গায় দাঁড়াচ্ছি, আমার কম্পোজিশন বা মঞ্চে অভিনেতার যে চলন, অন্য অভিনেতার সঙ্গে দূরত্বের যে তালমিল– সেসব বজায় রাখছি যথাযথভাবে। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে আমি ভিতর থেকে অনুভব করছি, এই যে ১৫ বছর আমি পেরিয়ে এসেছি, তিরিশ পেরিয়ে গিয়ে যে অভিনয়টা আমি করছি, তা শুরুর দিনের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….
ছোটবেলায় বাড়ির গুরুজনদের কাছে শুনতাম, যদি তুমি কিছু করতে চাও, তাহলে সেটা তিরিশ বছরের মধ্যেই করতে পারবে। তারপরে যে প্রতিভার বিকাশ ঘটে না, তা নয়। কিন্তু তিরিশ বছর যেন প্রতিভা, নিজের অন্তরের যে ইচ্ছাশক্তি তার স্ফূরণের আদর্শ সময়, চূড়ান্ত মাপকাঠি। আসলে তিরিশ বছর বয়সটা একটা পরিপূর্ণ জীবনের মধ্যপর্ব। যেন একটা প্রবাহ থেকে এসে আরেকটা দর্শনে জীবনটা বইবে, এই বিশেষ সময়ে। এতদিনের যে দর্শন মনে প্রতিপালিত হয়েছিল, তার ওপর এবার নতুন ভাবনা, দর্শনের রং লাগবে। তার সংমিশ্রণে নতুন আরেকটা রং ধরবে মনের ভিতরে। একটা অন্য পর্যায়ে বোধের উত্তরণ ঘটবে। এই সময়টায় মানুষ একটু ভাবে, একটু নিজেকে জরিপ করে গভীর ভাবে। ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে মানুষ এই বয়সে এসে নিজেকে যাচাই করার চেষ্টা করে, আদৌ কি সে কিছু করতে পারল, নাকি সে কিছু করতে পারবে– এ জাতীয় ভাবনার জন্ম হয় তার মনে। সেই শিক্ষা তাকে অভিজ্ঞ করে তোলে।
অভিনেতা হিসেবে আমিও সেই একই পথ ধরে হেঁটেছি। একই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমাকেও যেতে হয়েছে। অভিনয় করব কি করব না, সেই সংশয় আমাকেও গ্রাস করেছে। জীবনে এই যে ঘাত-প্রতিঘাত, নানা ঘটনার বিচ্ছুরণ, স্বপ্নভঙ্গ থেকে নতুন স্বপ্ন গড়ে ওঠা, মনের নানাবিধ পরিবর্তন– এই সমস্তকিছু বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে অভিনেতা হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। হয়েছি বলেই আমি যে অভিনয়টা ২২ বছর বয়সে করতাম, করে যে প্রতিক্রিয়া পেতাম, তা হয়তো আজও পাই, কিন্তু সেই অভিনয় যে আজ অন্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে পারি। অভিনয়ের বয়স অভিনেতাকে সেই স্তরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?