অপেক্ষার মর্ম যেন রোববার ডট ইন-এর জন্য নতুন করে বুঝতে পারি। যেন একটা মস্ত বাড়ির নানা মহলের মতোই ওরা পোর্টাল সাজিয়েছে। অনেকরকম রং ঠিকরে বেরোয় সেখানে। প্রতিদিন যেন নতুন করে চিত্ত রেঙে ওঠে। শুনি লেখাপড়া নাকি কমে গেছে। তবে, পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, এমন অনেক লেখাই তো লেখা হচ্ছে, যা না পড়ার মতো দুঃখ আর নেই। রবীন্দ্রনাথকে লেখা ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর চিঠি।
ছদ্ম-চিঠিতে সরোজ দরবার
রবিকাকে…
কমলালয়
২ নং ব্রাইট স্ট্রিট, বালিগঞ্জ
১৮.০৮.২০২৪
বাঁধানো দুটো খাতা উলটে-পালটে দেখছিলাম। গত বছরের একটা চিঠিতে চোখ পড়ে গেল। সব চিঠিই মুসাবিদা করে রাখি। সংখ্যা তো কম নয়! আট বছরে দুশো পেরিয়েছে। তেমন হিসাব করে আগে দেখিনি। এখন মনে মনে ভেবে দেখলাম, এগারো দিন অন্তর একটা করে চিঠি।
বর্ষার তো ঠিকঠিকানা নেই আজকাল। ক’দিন মেঘের কোলে রোদ হাসছিল বলে শরৎকালের কথা মনে পড়ছে। এমন আলোখেলা শরতে কোন চিঠি এসেছিল খুলে দেখতে, ফিরে পড়তে ইচ্ছে করে। দেখতে দেখতে চোখে পড়ল, এক শরতের চিঠিতেই লেখা– ‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি। …তোকে আমি যখন লিখি, তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি….’। এ-কথা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। এই জন্য নয় যে, আমার প্রশংসা আছে। পড়ি আর ভাবতে থাকি, আমার রবিকাকার গভীরতম সত্য কথাগুলো একই রকম আমার প্রাণেও গভীর সত্য হয়ে বেজে উঠছে তো! নইলে এ সব তো নেহাতই অক্ষর!
প্রায় একই সময়ের পাতাগুলো এদিক ওদিক করতেই চোখে পড়ল, ঠিক বচ্ছরকার আগের চিঠিটি। ‘রোববার ডট ইন’ পড়ার নেশাটা কেন যে আমায় হঠাৎ পেয়ে বসল, ঠাহর করতে পারতাম না। এখন সবটাই জলের মতো। ইদানীং দুপুরের ঝিমকিনিটুকুও গিয়েছে। লেখা প্রকাশ হলেই আগেভাগে পড়ে না ফেললে স্বস্তি নেই। দেখছি, আগের চিঠিতে এর স্বাতন্ত্রের কথা জানিয়ে লেখা,
‘যেখানে লেখার ভিতর ভাবনা ও ভাবানোর উপাদান থাকে– এই শেষোক্ত জিনিসটিকে রোববার ডিজিটাল নাম দেওয়া যেতে পারে।’ এক বছরের পড়বার অভিজ্ঞতায় জানি, কথাখানা চিরকালের সত্যি। ‘বালক’-এ আমার প্রথম বেরনো লেখাটি ছিল জন রাস্কিনের অনুবাদ। অনুবাদ করতে বেশ লাগে। জাপানযাত্রীর ডায়রি, গীতাঞ্জলির ভূমিকা অনুবাদেও অন্তরের ভিতরকার সেই আনন্দের সাক্ষাৎ পেয়েছি। ‘রোববার ডট ইন’ রুশ সাহিত্যের অনুবাদ কর্মকাণ্ড নিয়ে যে ধারাবাহিকটি করল তা আমায় বেশ আকৃষ্ট করেছে। আরও অনেক কলাম-ই ছিল। কবির সত্য আর সমাজের সত্যের ভিতর যে আগুনের পথ-পরিক্রমা, তাও ওদের একখানা ধারাবাহিকে নিয়মিত পড়েছি। অন্য লেখাগুলোও মনকে প্রফুল্ল করেছে। ফুল হোক বা সুর, যে কোনও প্রকাশের তো সেই গন্তব্যই থাকা উচিত। এই খাতারই এক চিঠিতে দেখছি লেখা, ‘আমরা ইচ্ছে করলে, চেষ্টা করলেও প্রকাশ হতে পারিনে– চব্বিশ ঘণ্টা যাদের সঙ্গে থাকি তাঁদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত।’ অথচ কতজন আছেন যাঁরা, যেন আমাদের অন্তর স্পর্শ করেই অন্তরের নিভৃতিটুকু প্রকাশ করতে পারেন তাঁদের লেখায়। সেখানে আমিও খুঁজে পাই নিজেকে। বুঝি আমার ভিতর যে অপ্রকাশের বেদনা, তা আশ্রয় পায় অন্য কারও প্রকাশে। তাই আমরা অন্যের লেখা পড়ি। অন্যের জীবনকথায় দৃষ্টি দিই। ওরা একবার একজন চা-বিক্রেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। জীবন কত না আশ্চর্য! আর একজন মানুষের খোঁজ দিল, যিনি কাগজ সংগ্রহ করেন। আর এই যে আমাদের বাদ্যযন্ত্রগুলো, এগুলো যে কে কীভাবে তৈরি করেন তা তেমন করে আগে ভাবিনি। ‘রোববার ডট ইন’ সে-কথাও ভাবাল। পড়তে পড়তে মনে হল মা-কে সম্পাদনা করতে দেখেছি। ‘সবুজপত্র’ও দেখি। সেই রীতি যে সময়ের ভিতর ডুব দিয়ে এখনও এমন অতল অনুভবস্পর্শী হয়ে উঠতে পারে, আবার একই সঙ্গে আধুনিক, তা এই নিত্য সাহচর্য বিনে নতুন করে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আর, সবার উপরে আবিষ্কার করলাম যাঁকে, তিনি শুধু রবিকা নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কত না ভাবে পাওয়া, নতুন করে, নব নব রূপে। ছাতিমতলায় বসতে আজও তো ভারি ভালো লাগে।
ক্রমে বুঝতে পেরেছি, রোববার ডট ইন-এর জন্য আমার ভিতরে একটা ভালোবাসার ক্ষেত্রই জন্মেছে। তার জন্য তাই চেয়ে থাকি। এককালে একটি ছেলে নাকি নীরবে আমার দর্শন প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে থাকত। সেই নিয়ে ‘মায়ার খেলা’য় গান অব্দি হয়ে গেল– ‘সখী, প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে। / তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে॥ /যদি শুধায় কে দিল কোন্ ফুলকাননে, / মোর শপথ, আমার নামটি বলিস নে॥’
অপেক্ষার মর্ম যেন রোববার ডট ইন-এর জন্য নতুন করে বুঝতে পারি। যেন একটা মস্ত বাড়ির নানা মহলের মতোই ওরা পোর্টাল সাজিয়েছে। অনেকরকম রং ঠিকরে বেরোয় সেখানে। প্রতিদিন যেন নতুন করে চিত্ত রেঙে ওঠে। শুনি লেখাপড়া নাকি কমে গেছে। তবে, পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, এমন অনেক লেখাই তো লেখা হচ্ছে, যা না পড়ার মতো দুঃখ আর নেই।
সেদিনের চিঠিতে যে সন্ধান রাখা ছিল, আজ সেই পথ ধরে বছর পেরিয়ে ভালো লেখার উপহারে আমার ডালি পূর্ণ। একটা কথা তাই বলার ইচ্ছে, নাম বলতে আমার আর শপথ নেই; ওদের জন্য মাথার একটি কুসুম দিতে সাধ হয়, সত্যি।
বব
১৮.০৮.২০২৪
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved