বিদেশি প্রোডাক্ট ‘শ্যাম্পু’র গান গাইতে গিয়ে অবাক জলপান! এই বিলিতি ‘শ্যাম্পু’ নামের মস্তিষ্ক মর্দনের তরল পদার্থটির জন্ম এদেশে– ভাবা যায়! শুধু এদেশ বলেই নয়, সেই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়। এই শ্যাম্পু নামের উৎস কী? সেখানেও এদেশের ভাষা!
আগের লেখায় বাঙালির ব্র্যান্ড বাজানো শেষ করে এবার বিদেশি ব্র্যান্ডের গপ্প বলার কথা। সেই মতো বিষয় বাছতে গিয়ে দেখলাম অধুনা মনুষ্যজাতি আপাদমস্তক ব্র্যান্ড দিয়ে মোড়া। তাই ঠিক করলাম মাথা দিয়ে শুরু করে পা পর্যন্ত যাব। মাথা মানে তেল, শ্যাম্পু ইত্যাদি। তেলটি বড্ড দেশীয়। তাই বিদেশি ‘শ্যাম্পু’ দিয়ে শুরু করতে গিয়ে আবারও হোঁচট আর বিস্ময়! এখানেও বাঙালি!
যাই হোক, সে গপ্প পরে বলছি।
কিন্তু বিদেশি প্রোডাক্ট ‘শ্যাম্পু’র গান গাইতে গিয়ে অবাক জলপান! এই বিলিতি ‘শ্যাম্পু’ নামের মস্তিষ্ক মর্দনের তরল পদার্থটির জন্ম এদেশে– ভাবা যায়! শুধু এদেশ বলেই নয়, সেই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়। এই শ্যাম্পু নামের উৎস কী? সেখানেও এদেশের ভাষা! কিমাশ্চর্যম অতঃপরম!
সংস্কৃত ‘চপতি’ অপভ্রংশ হয়ে হিন্দিতে এল চম্পি, চাম্পি বা চাম্পু , এবং সেই ‘চ’ ঘষা খেতে খেতে ‘শ’-এর সোমে এসে থিতু হয়ে ‘শ্যাম্পু’ নামে প্রতিষ্ঠিত হল। পুরাকাল থেকেই রিঠা, আমলা, সিকাকাই প্রভৃতির সঙ্গে নানাপ্রকার ঔষধি গুণসম্পন্ন জড়িবুটি মিশিয়ে একটি তরল পদার্থ প্রস্তুত হত, যা মাথা থেকে পা পর্যন্ত মর্দন করলে শরীর সুস্থ তো থাকতই অনেক রোগেরও উপশম হত। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে এই দেশি প্রাকৃতিক ‘শ্যাম্পু’ ব্যবস্থারই চল ছিল অবিভক্ত বিশাল ভারতবর্ষে ও তৎসংলগ্ন দেশগুলিতে।
এইবার মঞ্চে নামলেন এক বাঙালিবাবু। তখন এদেশে কলোনিয়াল কালচার প্রবেশ করেছে। সেই সময়ে ১৮১৪ সালে শেখ দিন মহম্মদ নামে এক বাঙালি পরিব্রাজক, চিকিৎসক ও উদ্যোগপতি তাঁর আইরিশ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলেন ও দেশীয় শরীর মর্দন প্রণালী প্রয়োগ করে ‘শ্যাম্পুইং’-এর ব্যবসা শুরু করলেন। খবরের কাগজে তিনি এই শ্যাম্পুইং-এর শারীরিক উপকারিতা নিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেও পিছপা হলেন না। বিষয়টি নিয়ে ইউরোপেও ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়ে গেল, কেমিক্যাল ব্যবহারের ভাবনাও শুরু হল। ১৮২৭ সাল নাগাদ এক জার্মান কেমিস্ট, নাম হ্যান্স সুয়োট্রকফ কেমিক্যাল ইত্যাদি ব্যবহার করে আধুনিক ‘শ্যাম্পু’র জন্ম দিলেন, যা জার্মানির সব ওষুধের দোকানে বিক্রি হতে শুরু হল। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ইউরোপবাসী আধুনিক শ্যাম্পুর সদ্ব্যবহার শুরু করে দিলেন এবং হ্যান্স সুয়োট্রকফের নামে ‘সুয়োট্রকফ শ্যাম্পু’ এক বঙ্গসন্তানের হাত ধরে প্রথম শ্যাম্পু ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হল।
কিন্তু বিশ্বের বাজার? ১৯৩০ সালে প্রোক্টর আ্যন্ড গ্যাম্বল তাদের তৈরি ‘ড্রেনে’ নামের ক্যেমিকাল শ্যাম্পু সারা বিশ্বে বিপণন করতে শুরু করল, এবং এই ‘ড্রেনে শ্যাম্পু’-ই ধরাধামে প্রথম ব্র্যান্ডের মুকুট মাথায় পরল। যথারীতি শুরু হল ব্র্যান্ড-যুদ্ধ। হবে না-ই বা কেন? বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মাথা, চন্দ্রলুপ্তদের বাদ দিলেও, প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের শ্যাম্পু মার্কেটের হাঁড়িকাঠে বলি প্রদত্ত!
শুধু একটি ব্র্যান্ডই বছরে প্রায় ৪ কোটি মানুষের ঘাড় ধরে মাথাটা (এখানে ব্র্যান্ড উহ্য) নিজের দখলে রেখেছে।
এবার একটু নিজের ঘরের দিকে তাকাই। শ্যাম্পুর আঁতুড়ঘর আমার দেশে প্রায় ১৪২ কোটি মাথার ওপর শ্যাম্পু কোম্পানিদের রাডার ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। Rural/Urban ভাগাভাগিতে urban population অনেক কম। ফলে শ্যাম্পুর ব্যবহারও কম। শহরকেন্দ্রিক। এর নেপথ্যে আরও একটা কারণ জল। Hard Water চুল চ্যাটচ্যাটে করে দেয়, শুধু ধুলো ময়লা নয়। অধিকাংশ শহরের জলই Hard Water, তাই শ্যাম্পুর চাহিদা থাকবেই। তাও নয় নয় করেও এদেশে শ্যাম্পুর বাজারের ঊর্ধ্বগতি লক্ষণীয়।
এ তো গেল ব্র্যান্ডের ইতিহাস-ভূগোল, কিন্তু শ্যাম্পুর নামকরণের কথা বলতে গিয়ে একটা বিখ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্রের অতীব বিখ্যাত গানের কথা মন থেকে সরাতে পারছি না। মনে আছে ‘পিয়াসা’ সিনেমার কথা? ওখানে জনি ওয়াকারের সেই গান–
শুন্ শুন্ শুন্… আরে বেটা শুন্
ইস চাম্পি মে বড়ে বড়ে গুণ…
শাম্পুর আদি নাম ‘চাম্পি’ এই বিখ্যাত গানে কেমন ঠাঁই করে নিল।