গানটা শুরু হয় একটা আশাবাদের সম্ভাবনা নিয়ে। সচ্চা দিলের কর্মীরা এগিয়ে এসো, তোমাদের ভালো খবর জানানোর আছে। তোমাদের ইউনিয়ন এসেছে তোমাদের সঙ্গ দিতে, তোমাদের কথা তুলে ধরতে। ওরকম জর্জরিত অবস্থার মধ্যেও ফ্লোরেন্স রিসের অনুপ্রেরণা জোগানোর চেষ্টা লক্ষণীয়। তাঁর এই কথাটা যেন গোপনে কানে কানে ঘুরতে থাকে শহরের আনাচেকানাচে। শ্রমিকদের গোপন মিটিংয়ে, আন্দোলনে, সভায় এই গান প্রতিটি কণ্ঠ ধারণ করে। এই গান আর কেউ একা গায় না। আর গানটি লেখেন এক মহিলা, সেই তিনের দশকে।
৩.
হুইচ সাইড আর ইউ অন, ফ্লরেন্স রিস, পিট সিগার
১৯৩০ সাল। কেন্টাকির হারলন কাউন্টির কয়লা শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কর্তৃপক্ষ অটুট, শ্রমিকদের দাবি শুনবে না। আর শ্রমিকেরাও নাছোড়বান্দা, রাস্তা ছাড়বে না। একটু একটু করে দীর্ঘায়িত হয় ধর্মঘট। শ্রমিকের রাগ ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। হারলন কাউন্টির শেরিফ, জে. এইচ. ব্লেয়ার, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাঁট করে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে, তাদের অবস্থান ভেঙে দেয়। তবুও দাবিতে অবিকল্প শ্রমিক, সব হারানো শ্রমিক, গতরে খাটা শ্রমিকদের ভেঙে ফেলা যায় না। তারা বারবার রাস্তায় নামে, বারবার কর্মবিরতির বার্তা দিতে থাকে। পাশাপাশি সরকার-পরিচালিত গুন্ডাবাহিনী শ্রমিকদের ওপর হামলা শুরু করে, রক্তাক্ত করে, মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে। তবুও শ্রমিক শ্রেণি, মরতে মরতেও দাবিতে অনড়। এই ঘটনাটাকে ইতিহাসে ‘ওয়ার অফ হারলন কাউন্টি’ বলে উল্লেখ করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যে ব্যবস্থা নেয়, ঠিক সেই কাজটিই করল তৎকালীন প্রশাসন। আন্দোলনের মুখ, আন্দোলনের নেতৃত্বের মুখ বন্ধ করা, তাকে শাসানো, তাকে সরিয়ে দেওয়া। মানুষের আন্দোলনকে এভাবেই ভেঙেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। অতীতেও, বর্তমানেও।
কয়লা শ্রমিকদের নেতা স্যাম রিস তাঁর ওপর হামলা হওয়ার খবর আগেই পেয়েছিলেন। রাষ্ট্রের এই চক্রান্ত জানতে, বুঝতে সময় লাগেনি বিক্ষোভকারীদের। স্যাম রিস আত্মগোপন করেছিলেন সময় থাকতেই। তাঁর খোঁজে ব্লেয়ারের গুন্ডারা তন্নতন্ন করে গোটা অঞ্চল ছেয়ে ফেলেছিল। কোথাও না পেয়ে শেষমেশ তারা স্যাম রিসের বাড়িতে হামলা করে। সে সময় তাঁর স্ত্রী ফ্লোরেন্স রিস বাড়িতে একা। তাঁর সামনেই গুন্ডারা তছনছ করে দেয় বাড়ি, হুমকি দেয়। স্যাম রিসকে খুঁজে না পেয়ে ওরা আবারও হামলা করবে, জানিয়ে যায়। ওই বাড়ির সামনেই তখন শ্রমিকদের একটা অংশ জড়ো হয়েছিল। তারা চুপ করে থাকে, কেউ কিচ্ছুটি বলে না। তাদের চোখের সামনেই হামলা চলে। হামলাকারীরা চলে গেলে ফ্লোরেন্স রিস দিশেহারা হয়ে, রাগে-দুঃখে ফেটে পড়তে পড়তে দেওয়াল থেকে ক্যালেন্ডারের একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে লেখেন– হুইচ সাইড আর ইউ অন বয়েজ, হুইচ সাইড আর ইউ অন।
Come all of you good workers
Good news to you I’ll tell
Of how that good old union
Has come in here to dwell
Which side are you on boys?
Which side are you on?
My daddy was a miner
And I’m a miner’s son
And I’ll stick with the union
Till every battle’s won
They say in Harlan County
There are no neutrals there
You’ll either be a union man
Or a thug for J.H. Blair
Oh, workers can you stand it?
Oh, tell me how you can
Will you be a lousy scab
Or will you be a man?
Don’t scab for the bosses
Don’t listen to their lies
Us poor folks haven’t got a chance
Unless we organize
গানটা শুরু হয় একটা আশাবাদের সম্ভাবনা নিয়ে। সচ্চা দিলের কর্মীরা এগিয়ে এসো, তোমাদের ভালো খবর জানানোর আছে। তোমাদের ইউনিয়ন এসেছে তোমাদের সঙ্গ দিতে, তোমাদের কথা তুলে ধরতে। ওরকম জর্জরিত অবস্থার মধ্যেও ফ্লোরেন্স রিসের অনুপ্রেরণা জোগানোর চেষ্টা লক্ষণীয়। তাঁর এই কথাটা যেন গোপনে কানে কানে ঘুরতে থাকে শহরের আনাচেকানাচে। শ্রমিকদের গোপন মিটিংয়ে, আন্দোলনে, সভায় এই গান প্রতিটি কণ্ঠ ধারণ করে। এই গান আর কেউ একা গায় না। আর গানটি লেখেন এক মহিলা, সেই তিনের দশকে।
ফ্লরেন্স রিস গানটিতে বাড়ির বাইরে থাকা সেই খনি শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে গানটি ধরেন। তিনি বলেন, তোমরা পক্ষ নাও, চুপ করে থেকো না, ইউনিয়ন আছে, ভয় পেও না। আমাকে ওরা হুমকি দিয়ে গেল, আমার ঘর ওরা লন্ডভন্ড করে গেল, তবুও তোমরা কিছু বললে না। যদিও তোমাদের আমি জিজ্ঞেস করছি তোমরা কোন দলে, তবুও আমি আসলে তোমাদের বলতে চাইছি যে ভয় পেও না। আমার দিকেই থাকো। আমি শ্রমিক পরিবারের মানুষ, আমি জানি শ্রমিকের চিন্তা, শ্রমিকের দাবি।
১৯৪১ সালে উডি গাথরি আর পিট সিগার ব্যান্ড তৈরি করেন– ‘দ্য অ্যালম্যানাক সিংগার্স’। এই ব্যান্ডে গানটা প্রথম রেকর্ড করা হয়। আরও ২০ বছর পরে, পিট সিগারের গান যখন ‘নিষিদ্ধ’ করা হল, তখন তিনি ‘উইভার্স’ বলে একটা ব্যান্ড তৈরি করেন। তখন আবার নতুন করে গানটির রেকর্ডিং হয়। এই সময়, গানটি গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, নিমেষে শ্রমিক শ্রেণির জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে। গান চলতেই থাকে, গানটা চলতেই থাকে। তারও বেশ কিছু দিন পরে, যখন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছে, তখন ‘ফ্রিডম সিংগার্স’ এই সুরটা নিয়েই গানের কথা বদল করে গাইতে শুরু করে– Come all you Negro people/ lift up your voices and sing/ will you join the Ku Klux Klan/ or Martin Luther King?
তিনের দশকের একটা ট্রেড ইউনিয়নের গান ৩০ বছর বাদে ছয়ের দশকে ‘ব্ল্যাক সিভিল রাইট্স’ আন্দোলনে অভিযোজিত হয়ে গেল। গানটার কথা সময়ের দাবি মেনে নিল, কালো মানুষদের প্রাণের গানে পরিণত হল। এক সাধারণ নারী, কাছ থেকে দেখেছিলেন শ্রমিক আন্দোলন, তিনি শ্রেণি বৈষম্য দেখে জ্বলে উঠেছিলেন, ধীরে ধীরে তিনি সঞ্জিত হচ্ছিলেন শ্রমিক শ্রেণির রাগে, পাল্টা ফিরিয়ে দেওয়ার জেদে, বদলে ফেলার অদম্য সাহসে। তিনি সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িত নন, কিন্তু তাঁকে ছাড়া সারা পৃথিবীর শ্রমিক আন্দোলন সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু তিনি দূরেও থাকেননি, আজীবন আন্দোলনেই জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর সেদিনের সাহস আজও কতশত সব-হারানো মানুষের গীতিলেখ হয়ে উঠেছে। তাই এই গানে যেমন স্লোগানধর্মিতা আছে, তেমনই একটা রোমান্টিসিজমও আছে। ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন’ লাইনটার সুরটা খেয়াল করলেই দেখা যাবে কীভাবে মাধুর্য এসে পড়ে। কাতর একটা ডাকও রয়েছে। গানের সুরটি ফ্লোরেন্স একটি বহু পুরনো Baptist hymn সুরের ধাঁচে বেঁধেছিলেন। আসলে ফ্লরেন্স রিস তো গান লেখার জন্য, সুর দেওয়ার জন্য এই গান সৃষ্টি করেননি, কোনও সাংগীতিক হিসেবনিকেশ ছিল না তাঁর, রাগ-অভিমান-দুঃখের মতো কিছু পবিত্র ও সৎ অনুভূতির প্রকাশ ছিল। তাই এই সুরে এত টান, এত আহ্বান।
১৯৮৪ সাল নাগাদ, ইংল্যান্ডে যে কয়লা শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়, আবার গানটা ফিরে আসে। যতবার শ্রমিকেরা আন্দোলন করে, এই গানটাও তাদেরই সহযোদ্ধা হয়। এবারও গানের কথা কিছুটা এদিক-ওদিক হয়। কথায়-বক্তব্যে কিছু সাম্প্রতিক অনুষঙ্গ আসে। কিন্তু অকপট থেকে যায় ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন’। এর থেকে সহজ ও জোরালো প্রশ্ন আর হয় না– পরিষ্কার করে বলো তুমি কোন দিকে। আর নিরপেক্ষ থাকা যায় না, তোমাকে পক্ষ নিতে হবে। পক্ষ কি নিয়েছ? জোর গলায় জানাও তোমার মতাদর্শ। তোমার চিন্তার খোরাক কে দেয়, তুমি জানাও। অবাক লাগে এই ভেবে যে, প্রায় একশো বছর হতে চলল এই গানটির, তবুও এই একই প্রশ্ন আমাদের করে যেতে হচ্ছে। নিরপেক্ষ থাকার মাশুল আমাদের এখনও দিয়ে যেতে হচ্ছে।
যতদিন বৈষম্য এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে, ততদিন সাধারণ মানুষ, গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষ, সমানাধিকার চাওয়া মানুষ এই গান গেয়ে যাবে। এই গানের সততাই গানটির কালোত্তীর্ণ হওয়ার কারণ। এই গানে নেই কোনও নান্দনিকতার বাধ্যবাধকতা, সাহিত্যমূল্যে পাশ করার দাবি, নেই কোনও উচ্চবিত্তের ভাবনাবিলাস। বব ডিলন-এর ১৯৬৫ সালের গান ‘ডেসোলেশন রো’-তেও এই গানের অনুষঙ্গ রয়েছে।
এবার আসি আটের দশকে। ইতিমধ্যে কেটে গেছে ৫০ বছর। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক কেন লোচ Durham-এর কয়লা খনির শ্রমিকদের নিয়ে বানানো তাঁর তথ্যচিত্রের নাম দিলেন ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন’।
একটা গান, একটা সহজ প্রশ্ন, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, আরও অনেক যুগ ধরে চলবে।
…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২। আহা ফুল, কবরের ফুল, মাটিকে অমন ভালোবেসে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থেকো না
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন