অভিনয়ের সময় কোনও চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে, সেই চরিত্রের কোনও উপকরণ বা এমন কোনও জিনিস যখন আমরা ব্যবহার করি, তা আমাদের যাপনের মধ্যে ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। মনে হয়, ওই চশমা ছাড়া আমার চলবে না। এই নয় যে ওই চশমায় আমাকে খুব মানানসই লাগবে, বা আমায় খুব ভালো দেখতে লাগছে। বরং পাওয়ারের হেরফেরের জন্য ওই চশমা পরে শুরুর দিকে খুব একটা স্বচ্ছন্দবোধও করতাম না। কিন্তু ওই চশমা পরে অন্য একটা অনুভূতি হত। আমি আমার ভিতরে অভিনয়ের রাস্তাটাকে স্পষ্ট দেখতে পেতাম, যে পথ ধরে আমি হেঁটে যাব আমার অভিনয়ের মানুষটির কাছে, যে মানুষটি আমি হয়ে উঠতে চাইছি।
১৭.
অভিনয় একটা প্রক্রিয়া। যার সঙ্গে জুড়ে থাকে অনেক কিছু। অভিনয়ের উৎসের সঙ্গে সেই অনুষঙ্গ জড়িত। মন, মগজের তালমিল তো থাকেই, তার সঙ্গে যোগ হয় আবেগ। পাশাপাশি থাকে নানা শিল্পমাধ্যমের উপস্থিতি। সর্বপরি থাকে দর্শকের উপস্থিতি। তার বাইরেও থাকে অভিনয়ের উপকরণ, তা যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, ফেলে দেওয়ার নয়।
থিয়েটার বা মঞ্চ-অভিনয়ের ক্ষেত্রে এই ছোটখাটো জিনিস অর্থাৎ উপকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটা নাটকের উপস্থাপনায় সংলাপ-আলো-মঞ্চসজ্জা যেমন থাকে, তার সঙ্গে থাকে মেকআপ, রঙের মতো আনুষাঙ্গিক বিষয়। এর পাশাপাশি থাকে বেশ কিছু খুঁটিনাটি ব্যাপার, যা আমার কাছে খুব আপন বলে মনে হয়। সেই উপকরণ একজন অভিনেতাকে মৃত্যু ও জীবন উল্টেপাল্টে দেখার সুযোগ করে দেয়। পৌঁছে দেয় চরিত্রের সন্নিকটে। আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো খুব সহজ, সাধারণ। হয়তো চোখে পড়ে না। কিন্তু অভিনেতা যখন অভিনয় করেন এবং গল্পের বুনোট এমনভাবে থাকে, তখন ওই জিনিসটা তার কাছে অভিনয়ের উৎসভূমি হয়ে ওঠে কখনও কখনও। সেই উপকরণ হয়ে ওঠে অভিনেতার অ্যাক্টিংয়ের একটা পিলার বা কাঠামো।
‘রুদ্ধসঙ্গীত’ বলে একটি নাটকে আমি অভিনয় করতাম। দীর্ঘকাল অভিনয় করেছি। সেখানে মঞ্চে অভিনয়ের সময় আমি একটা চশমা ব্যবহার করতাম। নাটকটিকে অনেকেই দেবব্রত বিশ্বাসের বায়োপিক বলে থাকেন বটে, যদিও আমি সেভাবে নাটকটিকে দেখি না। যাই হোক, নাটকটি যাঁকে কেন্দ্র করে, সেই দেবব্রত বিশ্বাস, তিনি যে ধরনের চশমা পরতেন, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আমিও ঠিক সেই রকমই একটা চশমা স্টেজে ব্যবহার করতাম। তখন আমার বয়স কম ছিল, ফলে যে চশমাটা অভিনয়ের সময় ব্যবহার করতাম, তার সঙ্গে আমার নিজের চশমার যে পাওয়ার তার কোনও মিল ছিল না। তবুও একটা সময় পর সেটাই হয়ে উঠেছিল আমার ভীষণ প্রিয় একটা উপকরণ।
একটা কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। চশমাটা যখন টেবিলের ওপর রাখা থাকত কিংবা মঞ্চে অভিনয়ের আগে যখন সাজঘরে প্রস্তুত হচ্ছি, সাজপোশাক ঠিক করছি, তখন ওই চশমাটার দিকে তাকালে অদ্ভুত একটা টান অনুভব করতাম। যেন সে হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে! একটা সম্পর্ক যেন আমাদের মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মনে হত, এই চশমাটা আমার নিত্যসঙ্গী। এই চশমা আমার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকে, আমার অনুভূতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, মিশে যেতে চায় আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।
……………………………………………….
‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকটি যাঁকে কেন্দ্র করে, সেই দেবব্রত বিশ্বাস, তিনি যে ধরনের চশমা পরতেন, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আমিও ঠিক সেই রকমই একটা চশমা স্টেজে ব্যবহার করতাম। তখন আমার বয়স কম ছিল, ফলে যে চশমাটা অভিনয়ের সময় ব্যবহার করতাম, তার সঙ্গে আমার নিজের চশমার যে পাওয়ার তার কোনও মিল ছিল না। তবুও একটা সময় পর সেটাই হয়ে উঠেছিল আমার ভীষণ প্রিয় একটা উপকরণ।
……………………………………………….
কিন্তু একটা সময় আসে যখন নাটকের শেষে সাজঘরে ফিরে চশমাটা খুলে রাখতে হয়। ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা অনেকেই চশমা পরি। কিন্তু সেই চশমা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিত্যসঙ্গী, তাকে কি এতটা গুরুত্ব দিই? কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে তো তেমনটা হয় না। অভিনয়ের সময় কোনও চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে, সেই চরিত্রের কোনও উপকরণ বা এমন কোনও জিনিস যখন আমরা ব্যবহার করি, তা আমাদের যাপনের মধ্যে ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। মনে হয়, ওই চশমা ছাড়া আমার চলবে না। এই নয় যে ওই চশমায় আমাকে খুব মানানসই লাগবে, বা আমায় খুব ভালো দেখতে লাগছে। বরং পাওয়ারের হেরফেরের জন্য ওই চশমা পরে শুরুর দিকে খুব একটা স্বচ্ছন্দবোধও করতাম না। কিন্তু ওই চশমা পরে অন্য একটা অনুভূতি হত। আমি আমার ভিতরে অভিনয়ের রাস্তাটাকে স্পষ্ট দেখতে পেতাম, যে পথ ধরে আমি হেঁটে যাব আমার অভিনয়ের মানুষটির কাছে, যে মানুষটি আমি হয়ে উঠতে চাইছি।
তাই এই চশমা আমার কাছে স্রেফ একটা অভিনয়ের উপকরণ নয়, বরং তা মঞ্চে অভিনয়কে আবিষ্কারের চাবিকাঠি। চশমার চেহারাটাই বা তার স্পর্শটাই আমাকে আলাদা আনন্দ দিত, ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা সঞ্চার করত। ওই চশমা পরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন চরিত্রের আরও সংলগ্ন হয়ে পড়তাম। আবার যখন অভিনয় শেষে সাজঘরে ফিরে চশমা খুলে রাখতাম, মনটা বিষণ্ণ হয়ে যেত। যেন সে আমায় ছেড়ে যেতে রাজি নয়। কিন্তু অভিনয় তো শেষ হয়ে গিয়েছে। আমাকে এবার অভিনেতার সত্তা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছি, এই যে আলগোছে চশমা খুলে রাখা, বা সাজসজ্জা খুলে রাখা, তা কিন্তু সাবলীল ভাবে হয় না। কোথাও যেন আটকে যায়। আসলে আটকে থাকতে চায় যেন সেই উপকরণগুলো, যা অভিনয়ের সময় আমার সত্তার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। এই যে নাছোড় ভাব, এটা আসলে বন্ধুত্বের টান। চশমাটা যেন আমায় বলতে চায়– হোক না অভিনয় শেষ, আরও কিছুক্ষণ পরে থাকলে ক্ষতি কি! আমার মন তখন বলে, অভিনয় তো আজকের মতো শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার তো খুলে রাখতেই হবে। তবু মন সায় দেয় না। নিজেকে বোঝাই, এ দেখাই তো শেষ নয়, এ তো সাময়িক বিরতি। ক’দিন পর আবার দেখা হবে। শুধু চশমা কেন, গায়ে লেপ্টে থাকা ঘামে-ভেজা পাঞ্জাবিটাও যেন লগ্ন হয়ে থাকতে চায় আমাদের শরীরের সঙ্গে।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………….
এই খুলে রাখা আবার কাছে টেনে নেওয়া– এসবের মধ্যেই আমরা অভিনেতারা একটু দম নিয়ে নিই। নিজেকে গুছিয়ে নিই পরের অভিনয়ের আগে। কিন্তু যখনই সেই চশমা বা পাঞ্জাবি, তাকে স্পর্শ করি আমার মনে একটা রোমাঞ্চ জাগে। এই যে একটা প্রাণহীন জিনিস, সেই অর্থে যার প্রাণ নেই, তাকে যদি গ্রহণ না করি, বা তুলে না নিই তাহলে সে-তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। তা সত্ত্বেও একটা টান রয়ে যায়। চশমাটা যেন হাতছানি দিয়ে আমায় বলে, গ্রহণ কর আমায়। আমায় নাও। বাঁচাও। আর নিজে বাঁচো।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৬। মৃত্যুর পর কী ঘটছে, একমাত্র মঞ্চ অভিনেতার পক্ষেই জানা সম্ভব
পর্ব ১৫। মঞ্চ থেকে প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, এমন নয়
পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?