হাটসেরান্দি গ্রামে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো এখনও নিষ্ঠা ভরে হয়ে চলেছে। । এই পরিবারের সদস্যের কাছে এক চমকপ্রদ তথ্য জানা গেল, এখানকার পুজো দালানেই একদা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আর ভোলা ময়রার সেই বিখ্যাত কবিগানের লড়াই হয়েছিল– যেখানে ভোলা ময়রা অ্যান্টোনির কাছে সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল। গেয়েছিল সেই বিখ্যাত কলি– ‘আমি সে ভোলানাথ নই রে আমি সে ভোলানাথ নই’। ভাবলে অবাক লাগে, এমনই ইতিহাসের কত টুকরো আমাদের অজান্তে আমাদেরই আশপাশে ছড়িয়ে আছে!
বীরভূমের বোলপুর লাগোয়া গ্রাম হল হাটসেরান্দি। হিসেব মতো দূরত্ব বলতে কিলোমিটার ১৪-১৫ হবে। বোলপুর থেকে পালিতপুর যাওয়ার বাস রাস্তায় পড়ে এই গ্রাম। গ্রামের মুখে নেমে পায়ে হেঁটে ভেতরে যেতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগে, তবে এখন সে ভোগান্তি নেই। টোটোতে চেপে সহজেই চলে যাওয়া যায়। এ এক বিশেষ গ্রাম, যেখানে পটে এঁকে দুর্গাপুজো হয়। অবশ্যি এর কথা এখন অনেকেরই জানা। কিছুকাল আগে গ্রামে ঢোকার মুখে প্রকাণ্ড তোরণ বসেছে, লাল মাটির পথ ঢেকেছে কালো রঙের পাকা রাস্তায়। এতে গাঁয়ের মানুষের সুবিধে হয়েছে অনেক। এ গ্রামের দুর্গাপ্রতিমার গল্পই বলতে চলেছি।
ইদানীংকালে পুজোর সময় কলকাতার ধাক্কাধাক্কি ভিড় থেকে পালিয়ে যাঁরা শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নিতে চান– তাঁদের অনেকের আনাগোনা এই হাটসেরান্দি গ্রামে, এখানকার ঠাকুর দেখতে। আগেই বলেছি, এখানকার প্রতিমা পটে আঁকা। তাও সে মেদিনীপুর বা বীরভূমের অন্যান্য জায়গার মতো স্ক্রোল জাতীয় পট নয়। অর্থাৎ, এই পট ওপর থেকে নিচে নিচে নেমে আসে না। কালীঘাট পটের আদলে আঁকা চৌকো পটচিত্রও এ নয়। এমনকী এখনও সামান্য কয়েক জায়গায় যে আড়ে-লাটাই পট দেখা যায়– যা কি না অনুভূমিক রেখার মতো পাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, অনেকটা জাপানি স্ক্রিন-পেন্টিং-এর ধাঁচে, এ পটচিত্র তাও নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তবে কেমন এই হাটসেরান্দির পট?
এখানে এক বিশেষ ধাঁচায় দুর্গা মূর্তি তৈরি হয়, সেইটেই এই গ্রামের রীতি। বীরভূমের অন্যান্য গ্রামের দুর্গাপুজোর মতো মাটির প্রতিমা এ গ্রামে বিরল। আগে একেবারেই ছিল না, ইদানীং কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। এই পটের চেহারা জ্যামিতি বাক্সের চাঁদার মতো অর্ধগোলাকার। সেই পটেই দুর্গাপ্রতিমা আঁকা হয়। সে ছবি বেশ বড় আকারের, মাটি থেকে প্রায় ফুটপাঁচেক উঁচু। তার রঙের প্যালেটও মেদিনীপুর বা বীরভূমের স্ক্রোল-পটের থেকে খানিক আলাদা। খেয়াল করে দেখলে, হাটসেরান্দির দুর্গাপটের সমগ্র ব্যাক-গ্রাউন্ড জুড়ে ছড়ানো থাকে ঘন নীল রঙের উজ্জ্বল আস্তরণ। তার ওপরে প্রধানত লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙের ব্যবহার, সব মিলে সে বেশ ঝলমলে জাঁকালো ব্যাপার। দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ-অসুর-সিংহ সবেতেই এই কেবল ক’টি রঙের আনাগোনা। দেবী দুর্গা আর লক্ষ্মীর শাড়ি টকটকে লাল, গণেশের গায়ের রং, কার্তিকের জামাও লাল রঙের। সরস্বতীর কাপড় নীলচে সবুজ, যা অসুরের গায়ের রঙের বেলায় সামান্য একটু বদলে গিয়েছে। মা দুর্গার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল বাসন্তী, লক্ষ্মী এবং কার্তিকেরও তাই। সরস্বতী গণেশ সাদা রঙে আঁকা, আর দুই ভাইয়ের ধুতির রংও সাদা। বাকি রইল দেবীর বাহন সিংহ, সেখানেও ওই হলুদের রকমফের ঘটেছে। ঘন নীলের ওপরে এইসব রঙের খেলা সমগ্র পটকে যেন শিল্পীর পাকা হাতের এক আশ্চর্য ছবি করে তুলেছে। সমস্ত রং পটের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গড়ে তুলেছে এক সুসামঞ্জস্য কালার-ইমেজ, একেবারে শিল্পসম্মত চিত্রপ্রতিমা। আধুনিক ছবির ভাষায় এখানের পটুয়াদের রীতিমতো কালারিস্ট বলতে হয়। দুর্গাপ্রতিমার মাথার ওপরে কোথাও প্রথাগত চালচিত্রের দেখা মেলে, কোথাও বা তা সংক্ষিপ্ত, চালচিত্রের ফিগারগুলি ছাড়া ছাড়া করে সাজিয়ে রাখা। অর্ধগোলাকার পটের সীমায় যে চালচিত্রের আভাস, তার পাশ ঘিরে পাখির পালকের মতো রুপোলি রাংতার চূড়া সার দিয়ে সাজানো। সে যেন পটের শীর্ষজুড়ে রুপোর মুকুট।
হাটসেরান্দি গ্রামে আনুমানিক একশো ঘর ব্রাহ্মণের বাস। সেখানকার চট্টোপাধ্যায় পরিবার বিলেতি সাহেবদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন, তাদের নানা কাজের জিনিস টুকটাকি জোগাড়ও দিতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়ায় এক সাহেবের নেকনজরে পড়েছিলেন এই পরিবারের কর্তা। সেখান থেকেই শুরু। সে একপ্রকার ছোটখাটো ব্যবসা বলা যেতে পারে।
এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো বেশ প্রাচীন, প্রায় দুশো বছরের কাছাকাছি। শুনেছি, একবার সেই সাহেব বোলপুরে এসে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কর্তাকে বোলপুরে তলব করেছেন। খবর পেয়ে কত্তামশাই তো ভয়ে কাঠ, সাহেবের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা চালাবেন কী করে? শেষে মুনশিকে নিয়ে হাজিরা দিয়ে কোনওরকমে সামলেছেন সে যাত্রা। তারপরেই ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নিয়ে বোলপুরের স্কুল প্রতিষ্ঠা। ১৮৮০ সালের সেই স্কুল আজকের বোলপুর হাই স্কুল নামে পরিচিত।
ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখি, সেই স্কুল তৈরি হয়েছে রবি ঠাকুরের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঢের আগে। এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো এখনও নিষ্ঠা ভরে হয়ে চলেছে। আগের সেই জাঁকজমক কমে গেলেও নিয়মবিধির পালন চলেছে আজও। এই পরিবারের সদস্যের কাছে এক চমকপ্রদ তথ্য জানা গেল, এখানকার পুজো দালানেই একদা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আর ভোলা ময়রার সেই বিখ্যাত কবিগানের লড়াই হয়েছিল– যেখানে ভোলা ময়রা অ্যান্টোনির কাছে সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল। গেয়েছিল সেই বিখ্যাত কলি– ‘আমি সে ভোলানাথ নই রে আমি সে ভোলানাথ নই’। ভাবলে অবাক লাগে, এমনই ইতিহাসের কত টুকরো আমাদের অজান্তে আমাদেরই আশপাশে ছড়িয়ে আছে!
তবে শ’-খানেক বামুন এখানে থাকলেও এই গ্রামে মোটামুটি সদগোপদের প্রাধান্য। এছাড়া আছে বাউরি, বাগদি, সূত্রধর ও অন্যান্য সম্প্রদায়। এ তল্লাটের পুরোনো সাবেক রীতির পাকা ঘরবাড়ি আর খানকয়েক পোড়ামাটির মন্দির জানান দেয়, এ এককালের বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। তবে পুরনো মন্দির সংস্কার করতে গিয়ে তার খোলনলচে আমূল বদলে গিয়েছে। তবে প্রকৃতির সজীবতা এখনও অটুট, আজও চারদিকের সবুজ হয়ে থাকা ধানের খেত, বর্ষাশেষের ভরা পুকুর, দিগন্তে তালগাছের সারি যেন নন্দলালের পটে আঁকা একখান স্নিগ্ধ ছবি।
অবশ্য এখানে যে কথা বলার, সে হল কারা আঁকে এই অন্যধারার পটচিত্র? বেশ কিছুকাল এই গাঁয়ের সেরা পটুয়া ছিলেন কালীপদ সূত্রধর। অসাধারণ ছিল তাঁর তুলির টান। অবশ্য কেবল পট এঁকেই দিন চলত না, সারা বছর কাঠের কাজ করে দিনাতিপাত করতে হতো কালীপদকে। অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় তাঁর কথা আছে। তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র করেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। আর গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই বেড়ানো বিশিষ্ট কথাকার সুধীর চক্রবর্তী আটের দশকের শেষভাগে কালীপদ সূত্রধরের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। কালীপদ তখন এসে পৌঁছেছেন জীবনের একেবারে প্রান্তে। চোখে একেবারেই ভাল দেখতে পান না। তবুও পটের নেশাই কেবল তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মহালয়া এলেই বাঁশ বাখারি মার্কিন কাপড় দিয়ে পটের পত্তন করতে তখনও তাঁর মন ছটফট করে উঠত। এতকালের অভ্যাসবশে অন্ধপ্রায় চোখ নিয়ে মুখস্থের মতো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পটে তুলির অমোঘ আঁচড় দিয়ে চলেছেন। মনে পড়ে, সুধীরবাবুর অনুরোধে কলাভবনের পাঠশেষে এই গ্রামে এসে আমি শিল্পীর একখানা স্কেচ করেছিলাম। এই লেখার সঙ্গে রইল দ্রুত রেখার সেই স্কেচ। পটুয়ার তীক্ষ্ণ নাক, ঘোলাটে হয়ে আসা আয়ত চোখের তীব্র জিজ্ঞাসা আর অনুভূতির স্পর্শ আমিও পেয়েছিলাম। এগুলোই তো একজন সত্যিকার শিল্পীর অহংকার।
হাটসেরান্দি পটের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় না। দেবী এখানে সারাবছর ধরে পূজিতা। পরের বছর নতুন পট এঁকে পুজো সারা হলে সেই পুরনো পটখানা ভাসান দেওয়ার প্রাচীন রীতি চলে আসছে আজও।
কালীপদ সূত্রধরের মতো শিল্পীরা আজ আর নেই। তাঁর পুত্র আদরগোপাল সূত্রধরও নিয়েছিলেন সেই জীবিকা। গত হয়েছেন তিনিও, এখন তাঁর ছেলে রামকৃষ্ণ সূত্রধর কোনওমতে সেই ধারাকে বয়ে নিয়ে চলেছে। তবে এই বাজারে কেবল কয়েকখান পট এঁকে সমবচ্ছর পেটের ভাত জোটানো যায় না। তাই অন্য কাজের সঙ্গে টোটো চালিয়ে দিন গুজরান করতে হয়!
কালীপদ সূত্রধরের সেই তুলির টান, বর্ণলেপনের সেই দক্ষতা হারিয়ে গিয়েছে, সে আজ আর প্রত্যাশা করাও যায় না। শিল্পের মান ও সেই কাজের উৎকর্ষ চাপা দিতে আর সেইসঙ্গে আজকের জনরুচির প্রবল দাপটে হাটসেরান্দির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপটে এখন লাগাতে হচ্ছে চকচকে জড়ি-চুমকির ফুলকারি নকশা।
লেখায় ব্যবহৃত ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..