খালেদ চৌধুরী সেই কংক্রিটের জঙ্গলকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এক অনন্য ভঙ্গিমায়। একটা বিমূর্ত, অন্য রকমের ছবি। বহুতলের গায়ে অজস্র জানলা। দূর থেকে মনে হত, সেগুলো বুঝি অনেক ওপরে, নাগালের বাইরে কোথাও। ছোট্ট বাড়িটাকে ঘিরে এই বহুতলের অবস্থান, তাকে যেভাবে খালেদ চৌধুরী ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা দেখবার মতো ছিল। গোলযোগ বাঁধল অন্য জায়গায়!
২০.
খালেদ চৌধুরী এবং তাপস সেন– মঞ্চের দুই কিংবদন্তির কথা বলছিলাম। স্বনামধন্য দুই ব্যক্তিত্ব। যাঁদেরকে কাছ থেকে দেখার এবং একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে।
উভয়ের চরিত্রে একটা দারুণ মিল ছিল। নিজেদের পরিসরে অর্থাৎ কাজের জায়গায় মেনে মানিয়ে নেওয়া কিংবা আপস করার মানসিকতা তাঁদের একদমই ছিল না। কিন্তু তাঁরা উভয়েই একে অপরের ওপর নির্ভর করতেন ভীষণ ভাবে। নান্দীকারের একটা নাটক ছিল ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’ বলে, কথাপ্রসঙ্গে সেই নাটকের কথা আগেও উল্লেখ করেছি, বিখ্যাত নাটক ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’-এর বাংলা এই ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’ নাটকটি। ভীষণ জনপ্রিয় ও মঞ্চসফল নাটক। সেখানে একটি চরিত্রে আমি অভিনয় করতাম। পাশাপাশি করতাম নানা টেকনিকাল কাজও। অভিনয়ের পাশাপাশি সেসবেও আমার আলাদা একটা উৎসাহ ছিল শুরু থেকেই। এই ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’ নাটকের মঞ্চসজ্জা করেছিলেন খালেদ চৌধুরী। আর আলোকসম্পাতে ছিলেন তাপস সেন।
নাটকটির প্রসঙ্গে দু’-চার কথা বলি। যারা নাটকটি দেখেছেন, তারা নিশ্চয় জানেন, নাটকটি একটি বাড়ির গল্প। বাড়িটিকে কেন্দ্র করেই গল্প অর্থাৎ নাটকের কাহিনি আবর্তিত হয়। ঠিক ওই বাড়িটির পাশেই গজিয়ে উঠেছে একটা কংক্রিটের জঙ্গল! তার পাশে বাড়িটিকে ছোট লাগে। একসময় অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাড়িটিকে এখানে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু আজ পাশের ওই অট্টালিকা, ওই বিরাট বহুতলের সামনে যেন ছোট হয়ে গিয়েছে বাড়িটি। আশেপাশের কংক্রিটের জঙ্গল যেন ওর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মঞ্চে সেই দৃশ্যটি পশ্চাদপটে নির্মাণ করেছিলেন খালেদ চৌধুরী।
মঞ্চের মাটি থেকে ওপর পর্যন্ত অর্থাৎ ওপরের সিলিং থেকে ঝুলছে যে ঝালরগুলো, সেই পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল বিশাল চিত্রপট। অনেকগুলো বহুতল, পাশাপাশি। দেশ-বিদেশের মেট্রোপলিটান শহরগুলোয় যেমন ধরনের হাই-রাইজিং বিল্ডিং দেখতে আমরা অভ্যস্ত, ঠিক তেমনই। দেশলাই বাক্সের মতো খোপ খোপ জানলা, স্তরে স্তরে সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে সাজানো সেই বহুতল– আকাশছোঁয়া।
খালেদ চৌধুরী সেই কংক্রিটের জঙ্গলকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এক অনন্য ভঙ্গিমায়। একটা বিমূর্ত, অন্য রকমের ছবি। বহুতলের গায়ে অজস্র জানলা। দূর থেকে মনে হত, সেগুলো বুঝি অনেক ওপরে, নাগালের বাইরে কোথাও। ছোট্ট বাড়িটাকে ঘিরে এই বহুতলের অবস্থান, তাকে যেভাবে খালেদ চৌধুরী ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা দেখবার মতো ছিল। গোলযোগ বাঁধল অন্য জায়গায়!
খালেদ চৌধুরীকৃত এই ক্যানভাস দেখে তাপস সেনের মাথায় হাত। বললেন, ‘গোটা ব্যাপারটাই চমৎকার হয়েছে। কিন্তু এই ক্যানভাস তো স্টেজের পিছনের সবটাই ঘিরে ফেলেছে! আমি ব্যাকলাইটটা বসাবো কোথায়? আলোই তো দিতে পারব না মঞ্চে।’
…………………………………………..
আমাদের নির্দেশক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, তাঁরও একই অবস্থা। তিনি দু’জনের মাঝখানে ছিলেন। কীভাবে এই তর্কের এবং সমস্যার মীমাংসা সম্ভব, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আমাদের সঙ্গেও আলোচনা করছিলেন। আমরা যারা ওঁর সহযোগী ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম সমস্যা কতটা গভীরে। খালেদবাবুর ওই অসাধারণ সৃষ্টি, সেটা কাটলে সত্যি দৃশ্যপটের ভারসাম্য নষ্ট হবে, আবার তাপসদার কথাতেও যুক্তি আছে। মঞ্চে ব্যাকলাইটেরও প্রয়োজন। তাহলে কী হবে? এই নিয়ে ভীষণ দোলাচলতা।
…………………………………………..
তাহলে উপায়? নিরুপায় তাপস সেন তখন খালেদ চৌধুরীকে গিয়ে ধরলেন। অনুরোধের স্বরে বললেন, তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেছেন, তার মধ্যে যে জানালাগুলো আছে, সেগুলো কেটে খোপ খোপ করে কি ফোঁকড় তৈরি করা যায়? তাপসদার সেই প্রস্তাব খালেদবাবুর মনঃপূত হল না একেবারেই। শুনেই নস্যাৎ করে দিলেন। এত সুন্দর একটা ক্যানভাস, তার ভিতরটা ওইভাবে কাটলে ভারসাম্যটাই যে নষ্ট হয়ে যাবে। ব্যাপারটা মোটেই ঠিক হবে না, নিশ্চিত ছিলেন খালেদবাবু। তাপস সেনকে অন্য কোনও উপায় ভেবে বার করার পরামর্শই তিনি দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাপসদাও নাছোড়বান্দা। তিনি তাঁর ভাবনা থেকে সরবেন না। ওই ক্যানভাস কেটেই আলো বসানো হোক, তাতেই ব্যাপারটা ঠিকঠাক হবে বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। আমি সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে এই দুই প্রবাদপ্রতিমের খুনসুঁটি আর একে অপরের প্রতি সৎ থেকে নিজেদের চাহিদাটুকু আদায় করে নেওয়া আপ্রাণ চেষ্টাটুকু দেখছিলাম। মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম, এই রে, এই বুঝি গোলমাল লাগল!
আমাদের নির্দেশক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, তাঁরও একই অবস্থা। তিনি দু’জনের মাঝখানে ছিলেন। কীভাবে এই তর্কের এবং সমস্যার মীমাংসা সম্ভব, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আমাদের সঙ্গেও আলোচনা করছিলেন। আমরা যারা ওঁর সহযোগী ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম সমস্যা কতটা গভীরে। খালেদবাবুর ওই অসাধারণ সৃষ্টি, সেটা কাটলে সত্যি দৃশ্যপটের ভারসাম্য নষ্ট হবে, আবার তাপসদার কথাতেও যুক্তি আছে। মঞ্চে ব্যাকলাইটেরও প্রয়োজন। তাহলে কী হবে? এই নিয়ে ভীষণ দোলাচলতা।
শেষমেশ কিন্তু তাপসদার কথাই মান্যতা পেল। অনেক টালবাহানার পর শেষে খালেদবাবুর অনুমতি নিয়ে প্রায় রাতারাতি তাপস সেনের উদ্যমে, তাঁর নির্দেশ মতো আমরা, যারা সেটের কাজে ছিলাম, সেই বিরাট ক্যানভাসের সব জানলার কপাট কেটে উন্মুক্ত করে দিলাম। করলাম বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই আতঙ্ক সেটের সবাইকে গ্রাস করে বসল, কাল সকালে যখন খালেদবাবু আসবেন, এসে দেখবেন তাঁর সৃষ্টির এই দশা আমরা করেছি, তখন ওঁর মুখের অবস্থা কেমন হবে!
পরদিন বেশ সকালে তাপস সেন এলেন। এসে নিচ থেকে ফুটলাইট-সহ নানা ধরনের রঙিন আলোর ব্যবস্থা করলেন, সেই আলো ক্যানভাসের উন্মুক্ত জানলা বেয়ে দর্শকাসনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে একটা মায়াবি পরিবেশ তৈরি করল মঞ্চের চারপাশে। প্রতিটি জানলা দিয়ে উদ্ভাসিত আলো, মনে হল, ওই কংক্রিটের জঙ্গলে বুঝি প্রাণ আছে! গোটা ক্যানভাসটাই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। যা ছিল তা সুন্দর ছিল, কিন্তু যা হল তা যেন একে অপরকে জড়িয়ে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দিল আমাদের চোখের সামনে।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
আরও পরে এলেন খালেদবাবু। ঢুকেই দেখলেন পুরো ব্যাপারখানা। আমরা অদূরে দাঁড়িয়ে তখন ভয়ে কাঁপছি। কিন্তু তিনি রাগলেন না। শুধু তাঁর মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল– ‘বাহ্’! এই শব্দটুকু। তাঁর চোখেও দেখলাম মুগ্ধতার পরশ। তাপসদা তখন হাসতে হাসতে মজা করে বলছিলেন, ‘দেখলে তো, আমি কেমন করতে পারি?’
খালেদ চৌধুরী কী বলেছিলেন? বোধহয়, গাম্ভীর্যের আগল ভেঙে তাঁকেও হাসিমুখে বলতে শুনেছিলাম, ‘আমি যদি ক্যানভাসটাই না আঁকতাম, তাহলে তুমি কি সুযোগ পেতে এমন চমৎকার আলোর কারসাজি করার?’– আজ, এতদিন পর, তা আর স্পষ্ট মনে নেই!
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯। তাপস সেন কিংবা খালেদ চৌধুরী নিজের সৃষ্টির জন্য আপস করেননি কোনও দিন
পর্ব ১৮। প্রাণহীন উপকরণের স্পর্শেই প্রাণ পায় আমার অভিনয়
পর্ব ১৭। যে চশমায় নিজেকে মানানসই লাগে না, তবুও যা পরে থাকতে ইচ্ছে করে
পর্ব ১৬। মৃত্যুর পর কী ঘটছে, একমাত্র মঞ্চ অভিনেতার পক্ষেই জানা সম্ভব
পর্ব ১৫। মঞ্চ থেকে প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, এমন নয়
পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
কবির কোনও ভ্যানিটি ছিল না। যেখানে সেখানে বসে পড়তেন চায়ের ঠেকে। কেউ চাইলেই এক টুকরো কাগজে কোনও কবিতার লাইন লিখে দিতেন। তারপর সেটার কী হত, জানতেও চাইতেন না। এমনিই ছিল তাঁর সরল জীবন-যাপন। সেই প্রয়াত কবি অরুণ চক্রবর্তীকে নিয়ে এই বিশেষ স্মৃতিচারণা।