কেউ কাউকে চিঠি লিখলে তার স্বত্ব কার হয় এ-ব্যাপারে আমার তখনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। বুদ্ধদেবদা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন সত্যজিতের ওই চিঠি ছাপলে তিনি রুষ্ট হবেন না। কারণ সত্যজিতের সঙ্গে এই বিতর্কের আগে পর্যন্ত তাঁর যথেষ্টই সুসম্পর্ক ছিল এবং সত্যজিতের চিঠি পেয়ে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বিতর্কেরও এখানেই ইতি। এদিকে প্রকাশক হিসেবে আমি একটু সমস্যাতেই পড়লাম।
৯.
১৯৮৪-র কলকাতা বইমেলায় ‘কোজাগর’ বেরুনোর পর তার বিপুল জনপ্রিয়তার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু ওই বছরই পয়লা বৈশাখে ফের সুধীর মৈত্র-র প্রচ্ছদ ও অলংকরণে প্রকাশ করলাম ‘প্রথম প্রবাস’। ‘প্রথম প্রবাস’ সরাসরি বই হিসেবে ছাপা হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে বই হওয়ার সময়েই ‘প্রথম প্রবাস’-এর বেশিটা লেখা। আসলে, এই লেখা ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়েছিল ‘অমৃত’ পত্রিকায়। কিন্তু তখন দেশে ‘জরুরি অবস্থা’ চলছে। সেসময়ের নিয়ম অনুযায়ী যে-কোনও লেখা ছাপার আগে সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন হত। এদিকে বন-জঙ্গল-নারীর মনের কথা ছেড়ে বুদ্ধদেব এই লেখায় শুরু করেছিলেন আমাদের দেশের সঙ্গে বিদেশের তুলনা করে একটি ভ্রমণ উপন্যাস লিখতে। কিন্তু কোনও কারণে তাঁর লেখা বিপুলভাবে ‘সেন্সরড’ হতে থাকে। প্রত্যেক সংখ্যায় লেখার অনেকটা করে অংশ এমনভাবে বাদ যেতে লাগল যে ছবি-টবি দিয়ে সেসব ঢাকতে হচ্ছিল সম্পাদকীয় দফতরকে।
বুদ্ধদেবের মেজাজ-মর্জির সঙ্গে যাদের পরিচয় ছিল তারা জানেন, এ-ব্যবস্থা মেনে নেওয়া তাঁর চরিত্র-বিরুদ্ধ হত। তখন ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মণীন্দ্র রায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি মণীন্দ্রবাবুকে জানিয়ে দেন তাঁর পক্ষে এই ধারাবাহিক চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অচিরেই সে-লেখা ছাপা বন্ধও হয়ে যায়। যদিও পত্রিকার তরফে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় তার বয়ান ছিল এরকম– বুদ্ধদেব গুহ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে লেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শুনেছি এই কল্পিত অসুখের কথা শুনে প্রচুর মানুষ, যার মধ্যে পাঠক-পাঠিকাই বেশি, তাঁকে ফোন করে চিঠি লিখে কুশল সংবাদ নিয়েছিলেন। ব্যাপারটা এখানেই থেমে গেলেও ঠিক ছিল, কিন্তু এরপর বুদ্ধদেবের বাড়িতে পুলিশ কোনো অজ্ঞাত কারণে তল্লাশিও চালায়। বুদ্ধদেবের বক্তব্য ছিল– ‘‘‘প্রথম প্রবাসে’ আমাদের দেশীয় রাজনীতিকদের যে সমালোচনা করেছিলাম, সেই সমালোচনার জন্যই এই হয়রানি।’’ বুদ্ধদেবের অন্যান্য বইয়ের মতো বিপুল বিক্রি না হলেও, এখন দেখছি এ-বইটিরও সাত-সাতটা সংস্করণ হয়েছে।
কিন্তু ‘অভিলাষ’ বেরুনোর পর বুদ্ধদেবের লেখা নিয়ে পাঠক-পাঠিকার যে উন্মাদনা দেখেছি, সেটা আবার দেখেছিলাম ‘অভিলাষ’-এর পরের বছর পুজোর মুখে ‘চান ঘরে গান’ প্রকাশিত হওয়ার পর। আগেই বলেছি, বিজ্ঞাপনে লিখেছিলাম, ‘এ বছরে বুদ্ধদেব গুহ কোনো পুজো সংখ্যাতেই এক লাইনও লেখেননি’। ‘চানঘরে গান’ কিন্তু ঠিক উপন্যাসের মতো লেখা নয়। বুদ্ধদেবদা বলতেন ওটা ‘পত্রসাহিত্য’। বাংলাদেশের ঢাকার ধানমণ্ডির এক চরিত্র ‘ফিরদৌসী আখতার’-এর সঙ্গে বালিগঞ্জ পার্ক রোডের জনৈক ‘লেখক’-এর পত্রালাপ। এ-বই শুরুতেই আমি পাঁচ হাজার কপি ছেপেছিলাম। পুজোর আগের ক-দিন আর পুজোর ছুটির পর দোকান খুলতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব বই শেষ হয়ে যায়। ১৮ নভেম্বরের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র বিজ্ঞাপনে দেখছি লেখা হয়েছিল, ‘প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ করে ৫০০০ কপি নিঃশেষিত’। তারপর এর উনচল্লিশটা সংস্করণ হয়েছে। এই বছরও ফের নতুন করে ছাপা হয়েছে ‘চানঘরে গান’।
কিন্তু ‘চানঘরে গান’ এমন একটা বই যা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠকই শুধু নয়, এ-বইয়ের লেখক-প্রকাশকও অভূতপূর্ব কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। বইটি বিক্রি এবং প্রকাশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে সত্যজিৎ রায়-এর পরিবারের পক্ষ থেকে সিটি সিভিল কোর্টের ১৩ নম্বর বেঞ্চে একটি মামলা দায়ের করা হয়। আমার বাইশ বছরের প্রকাশক জীবনে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। বিষয়টা একটু খুলেই বলা যাক : সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হন ২৩ এপ্রিল ১৯৯২ সালে, আর ‘চানঘরে গান’ প্রকাশিত হয় সেই বছরেরই সেপ্টেম্বরে। আমরা অবশ্য কোর্টের চিঠি পাই ডিসেম্বর মাসে। ‘চানঘরে গান’-এ বুদ্ধদেব একটি চিঠিতে ফিরদৌসী আখতার ‘তোড়া’কে লেখেন, ১৯৮২ সালের ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার ২৭ সেপ্টেম্বর আর ১ অক্টোবর প্রকাশিত অমল ভট্টাচার্য স্মৃতি বক্তৃতার লিখিত রূপ প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব তার উত্তরে টেলিগ্রাফে একটি লেখা ছাপতে দেন, ‘A novelist’s pen in not the lens of a camera’ নামে। বুদ্ধদেবের এই লেখা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সত্যজিৎ রায়ের বাংলায় লেখা একটি চিঠি ‘চানঘরে গান’-এ ছাপা হয়েছিল। মামলার মূল বক্তব্য ছিল সত্যজিতের লেখা চিঠি এই বইতে অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং তাঁদের মতে সত্যজিতের চিঠিকে এভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করা চলবে না। মুশকিল হল, কেউ কাউকে চিঠি লিখলে তার স্বত্ব কার হয় এ-ব্যাপারে আমার তখনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। বুদ্ধদেবদা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন সত্যজিতের ওই চিঠি ছাপলে তিনি রুষ্ট হবেন না। কারণ সত্যজিতের সঙ্গে এই বিতর্কের আগে পর্যন্ত তাঁর যথেষ্টই সুসম্পর্ক ছিল এবং সত্যজিতের চিঠি পেয়ে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বিতর্কেরও এখানেই ইতি। এদিকে প্রকাশক হিসেবে আমি একটু সমস্যাতেই পড়লাম। তাই গোটা ব্যাপারটা আমাদের সংস্থার অ্যাডভোকেট নবী চৌধুরীকে জানালাম। আইন-আদালতের ব্যাপারে নবীদা এখনও আমার সব থেকে বড়ো সহায়। তিনি গোটা ব্যাপারটা শুনে বললেন, চিঠি যখন এসেছে তখন তো কোর্টে যেতেই হবে। তাই আমাদের পক্ষে নবীদা আর বুদ্ধদেবের হয়ে আইনজীবী সমরাদিত্য পাল মামলা লড়তে শুরু করলেন। কয়েকটা হিয়ারিং-এর পর বুদ্ধদেবদা বললেন, আমার বই তো আর সত্যি-সত্যিই মানিকদার চিঠিটার জন্য বিক্রি হয় না। তাই ওই চিঠি আর ছাপার দরকার নেই। তুলে দাও। ওখানে সাদা পাতা ছেড়ে দেবে, আর তাতে লিখবে, ‘এখানে সত্যজিৎ রায়ের উত্তর ছিল’। এর পরের হিয়ারিং-এ জজসাহেব বলেন, চিঠিই যখন নেই তখন আর মামলা চালানোর কী প্রয়োজন! সেই বইতে আজও চিঠির পাতাগুলো সাদা রেখে, ‘এখানে সত্যজিৎ রায়ের উত্তর ছিল’, এমনটাই ছাপা হয়। কিন্তু নবীদার কাছে সেসময় শুনেছিলাম, আইন অনুযায়ী চিঠির কপিরাইট দু’-তরফেরই হয়। চিঠি ছাপতে গেলে যিনি লিখছেন এবং যিনি পাচ্ছেন উভয়েরই সম্মতি প্রয়োজন। আমার ধারণা আমি যেমন কপিরাইট আইনের ব্যাপারটা সেসময় ভালো জানতাম না, বুদ্ধদেব গুহও বিষয়টা জানতেন না। নইলে হয়তো এই চিঠি বইতে ছাপতেই দিতেন না।
তবে মামলাটা চলেছিল অনেক দিনই। ‘চানঘরে গান’ নিয়ে লিখতে গিয়ে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসের একটা চিঠি পেলাম, অপু ততদিনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। উচ্চমাধ্যমিকের পর তার ইচ্ছে হয়েছিল দেরাদুনে এরোন্যটিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। কোর্টে একটা হিয়ারিং-এর দিন আমার অপুকে নিয়ে দেরাদুনে যাওয়ার কথা ছিল, সেকথা জানিয়ে নবীদাকে এই চিঠিটা লিখেছিলাম। অপু অবশ্য এক বছর দেরাদুনে থেকে ওখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিল না বলে কলকাতায় ফিরে আসে। এখানে এসে বাড়ির কাছেই আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজে কর্মাস নিয়ে ভরতি হয়। অপুর সঙ্গেও বুদ্ধদেবদার খুবই নিকট সম্পর্ক ছিল। পরের দিকে অপুকে লেখা (০৫. ০৫. ২০০৯) বুদ্ধদেবের একটা চিঠি পাচ্ছি যেখানে তিনি লিখছেন,
‘কল্যাণীয়েষু অপু,
একটি কাজে ‘সমুদ্র মেখলা’ পড়তে পড়তে নিজের লেখা পড়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এই বই এর প্রচার দরকার। যে পড়বে, সেই মুগ্ধ হবে। এই বই ভালভাবে বিজ্ঞাপিত হওয়া দরকার।…’
‘সমুদ্র মেখলা’ ১৯৯৯ সালে ছেপেছিলাম। তার আগেই বুদ্ধদেবের আত্মজীবনী ‘ঋভু’ চারটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম খণ্ড ছেপেছিলাম ১৯৯২-এর বইমেলার সময়, মলাট করেছিলেন বুদ্ধদেবের প্রিয় শিল্পী সুধীর মৈত্র। পরে ২০০৬ সালে ‘ঋভু’র অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
বুদ্ধদেবদা যে শুধু নিজের লেখা নিয়েই আত্মমগ্ন থাকতেন এমন নয়। অন্য লেখকদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেও জানতেন। ১৯৮৫ সালে আমার কাছে রাঁচি নিবাসী লেখক চারুব্রত মুখোপাধ্যায়ের একটি পাণ্ডুলিপি আসে। পাণ্ডুলিপিতে ওড়িশা ও ছোটোনাগপুরের অরণ্য-পর্বতের কথা দেখে আমি বুদ্ধদেবদাকে দিয়েছিলাম পড়ে মতামত দেবার জন্য। উনি সে-পাণ্ডুলিপি পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে চারুব্রতবাবুকে চিঠিতে (১৫ .০৬. ১৯৮৫) লেখেন,
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
দে’জ পাবলিশিং এর সুধাংশু দে আমাকে আপনার ‘অরণ্যের মহাকাব্য’র পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দিয়েছিলেন। এই মাত্র পড়ে শেষ করলাম। আমি এই লেখা, অবশ্যই ছাপতে অনুরোধ করব তাঁকে। আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানবেন। খুবই ভালো লেখা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভর করা, আন্তরিক এবং হাস্যরসসম্পৃক্ত। সবচেয়ে বড় কথা এইই যে আমি-ময়তা একেবারেই নেই। মনে হয় আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়ই হবেন। লেখার বিষয়বস্তুর সময়কাল লক্ষ্য করেই এ কথা বলছি। বয়সে বড় না হলেও, গুণেও আপনি শ্রদ্ধাস্পদ। আপনার লেখায় বর্ণিত বেশির ভাগ জায়গাতেই একসময় যাবার এবং শিকার করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তবে শিকারের চেয়ে বন এবং বনের মানুষরাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। আজও করে। আপনার অভিজ্ঞতা নিবিড় এবং প্রতক্ষ্য। এই বই প্রকাশিত হলে নিশ্চয়ই সমাদৃত হবে। আমার অগ্রিম অভিনন্দন সে কারণেও রইল। পেশায় অন্য জগতের লোক হলেও আমিও একটু লেখালেখি করি। আপনি আমার কোনো লেখা পড়েছেন কি না জানিনা। রাঁচীর কাছে ম্যাকলাক্সিগঞ্জে আমার একটি বাংলো ছিল। সেটি বিক্রী করে দিয়েছি প্রায় বছর দশেক হতে চলল। তখন খুব ঘনঘনই যেতাম ওদিকে। এখনও যাই : তবে বছরে দু তিনবার। অসম্ভব না হলে আমার চিঠির প্রাপ্তিসংবাদ জানাবেন। ডাকের যা গোলমাল আজকাল। অনেকদিন পর, আপনার লেখা পড়ে বহু পরিচিত জায়গায় পৌঁছে যাবার সুযোগ হয়েছিল। খুবই NOSTALGIC লাগছে।
গুণমুগ্ধ, বিনত ইতি
বুদ্ধদেব গুহ’
কেবল একটি চিঠি লিখেই থেমে যাননি বুদ্ধদেবদা ঠিক দু’-দিন পরে ফের একটি চিঠিতে লিখলেন,
‘আপনার লেখাটি কাল আবার পুরোটা পড়লাম। এখনও ঘোরের মধ্যে আছি।
দেখার চোখ আছে অনেকেরই কিন্তু আপনার চোখ দার্শনিকের। ঘোরের মধ্যে থাকার একটি কারণ এইই যে আমার অতি পরিচিত বহু জায়গাই আপনার কলমের মাধ্যমে নতুন করে দেখলাম। এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে আপনি ঠিক যেভাবে দেখেছেন তার সঙ্গে আমার দেখা তুলনীয় নয়।…
অবশ্য এ লেখা কল্পিতও হতে পারে। যদি মনে করি যে কল্পিতই (তা হতে
পারে না বলেই আমার বিশ্বাস) তাহলেও এ মহৎ সাহিত্য হয়ে উঠেছে।…’
সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একজন লেখকের পাণ্ডুলিপি পড়ে এত প্রশংসা করে লিখতে বোধহয় বুদ্ধদেবদাই পারতেন। যাইহোক, চারুব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখাটি ১৯৮৭-র বইমেলায় প্রকাশিত হয়। পাণ্ডুলিপিতে ‘অরণ্যের মহাকাব্য’ নাম থাকলেও বই করার সময় তার নাম হয়, ‘অরণ্য-পথিক’। ২০১৯-এ বইটি আবার নতুন করে ছাপা হয়েছে।
একইভাবে বুদ্ধদেবদা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন দেবেশ রায় প্রসঙ্গে। তখন সবে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধদেব গুহ আমাকে এক কপি ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। আমি সে-বই যথা সময়ে দিয়েও আসি। বই পড়া হলে তিনি লিখলেন,
‘কল্যাণীয়েষু
সুধাংশু,
“তিস্তাপারের বৃত্তান্ত” পড়লাম। এটি একটি অসাধারণ বই। বিজ্ঞাপনে শঙ্খদার (শঙ্খ ঘোষ এর) মন্তব্য দেখেই উৎসুক হয়ে তোমার কাছ থেকে বইটি নিই। এরকম একটি বই বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখা হয়নি। মহৎ সাহিত্যর যে সব গুণ থাকা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটি গুণই এই উপন্যাসের আছে। এই বই নিশ্চয়ই পুরস্কৃত হওয়া উচিত। তবে উচিতকর্ম তো এ পোড়াদেশে বড় একটা ঘটে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগ্যতার সঙ্গে পুরস্কারের কোনোই সাযুজ্য থাকে না। এরকম একটি বই প্রকাশ করতে পেরেছো যে তাতে প্রকাশক হিসেবে তোমার মর্য্যাদা নিশ্চয়ই বাড়লো। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নয়, বইয়ের মানই একজন প্রকাশককে সম্ভ্রান্ত করে তোলে।
আমার অভিনন্দন জেনো।…’
বাংলা সাহিত্যের নামী লেখক-সমালোচকেরা তাঁর সম্পর্কে প্রায় নীরব ছিলেন বলে বুদ্ধদেবদার মনের কোণে কোথাও একটা অভিমান ছিল। হয়তো সকলে নয়, কিন্তু বেশিরভাগ সমালোচকই তাঁর লেখা নিয়ে মন্তব্য করতেন না। যদিও পাঠকের যে-ভালোবাসায় তিনি অভিষিক্ত হয়েছিলেন তা তাঁর সব দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল। তবে একবার শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, বুদ্ধদেবদা সেই চিঠি পেয়ে এত খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে সেটি দিয়ে বলেছিলেন ফাইলে রেখে দিও। আজ সেই চিঠিটাও হাতে এসে গেল। সালহীন সেই চিঠিতে অন্নদাশঙ্কর লিখছেন,
‘শ্রী বুদ্ধদেব গুহ
প্রীতিভাজনেষু,
আপনার ২০ নভেম্বরের চিঠির উত্তর দিতে অযথা বিলম্ব হলো এর জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ইতিমধ্যে আমার গৃহিণীর Cancer ধরা পড়ে ও তাঁকে বোম্বাইতে পাঠাতে হয়। তিনি আপাতত সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী অন্য কারণেও। আপনার পাঠানো দু-খানি মাত্র বই আমার কাছে পৌঁছেছিল। উপন্যাসটি পড়ে দেখার আগেই হাত বদল হয়। যিনি নিয়ে যান তিনি দিয়ে যান না। আমিও ভুলে যাই তাঁর নাম। প্রবন্ধের বইটি (‘জর্নাল’ বোধ হয়) আম্মার টেবিলের পাশের shelf এই ছিল। কিন্তু একদিন shelf টি ঘর বদল করে ও বইটি লাইব্রেরি [তে] আরও [?] রক্ষিত হাজারটা বইয়ের সঙ্গে মিশে যায়। এখন খুঁজে বার করতে আমার অনেক সময় লাগবে। খুঁজে পেলে আপনাকে জানাব। কিন্তু নানা ধান্দায় আমি জড়িত। দেরি হতে পারে। আপনার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা আমি পড়েছি ও পড়ছি। ‘বোঁদে’দার গল্প এমনি অসাধারণ সৃষ্টি। যেমন তার বিষয়, তেমনই তার ভাষা ও শৈলী। ‘অবরোহী’তে আপনি প্রমাণ দিলেন যে আপনি একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষাশিল্পী। তা ছাড়া একজন Connoisseur তো বটেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর সগোত্র। আমার চোখে ছানি পড়ছে। লেখা ও পড়া কমিয়ে দিয়েছি। আমার প্রীতিপূর্ণ নমস্কার উভয়কে।
ইতি আপনাদের অন্নদাশঙ্কর রায়’
চিঠির শেষে অন্নদাশঙ্কর রায় ‘উভয়কে’ প্রীতিপূর্ণ নমস্কার জানিয়েছেন মানে নিশ্চয়ই বউদির কথাই বলতে চেয়েছেন।
আমি দে’জ পাবলিশিং থেকে বুদ্ধদেব গুহ-র সত্তরেরও বেশি টাইটেল প্রকাশ করেছি। প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল এবং সে-যোগাযোগ ছিল পারিবারিক। বুদ্ধদেব গুহ যেমন শিকার, লেখা, গান-বাজনায় বুঁদ হয়ে থাকতেন, তেমনই অতীব ভোজনরসিকও ছিলেন। আমার কাছে কয়েকটা কাজের চিঠিতেও শেষ লাইনে দেখছি লেখা, ‘মাছ কবে খাওয়াচ্ছ ?’ এই মাছ খেতে চাওয়াটা আসলে ছিল আমার স্ত্রী রীতাঞ্জলির (টুকু) কাছে। দাদাকে সে মাঝে-মাঝে মাছ রেঁধে পাঠাত। ইলিশ, গলদা, কই– এইসব ছিল তাঁর প্রিয় মাছ। এমনিতে আমি কোনোদিন বাজার করতে যাই না। আমাদের বাড়িতে বাবুই বাজার-হাট সামলায়। কিন্তু দাদার জন্য ভালো মাছ কিনতে আমাকেও যেতে হয়েছে, কখনো মানিকতলা বাজারে আবার কখনো গড়িয়াহাট বা লেক মার্কেটে। টুকুর রাঁধা তেল-কই দাদার খুবই প্রিয় ছিল। বুদ্ধদেব গুহ-র আরেকটা পছন্দের জিনিস ছিল পান– সামান্য চুন-খয়ের দেওয়া, সুপুরি-টুপুরি কিচ্ছু না। কেবল আলাদা করে একশো বিশ জর্দা। তবে দাদার উৎকৃষ্ট পানীয়ের শখও ছিল, যদিও আমি ও রসে বঞ্চিত হওয়ায় আমার সঙ্গে তা নিয়ে কখনো কথা হয়নি। আমাদের বাড়িতে, ১৩ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটেও তিনি বহুবার এসেছেন। এ-বাড়িতে শেষবার এসেছিলেন আমার নাতনি সমন্বিতা-র (রিচা) জন্মদিনে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। তখন তাঁর শরীর একেবারেই ভেঙে গেছে। চোখে প্রায় দেখতেই পাচ্ছিলেন না। তবু সেদিন বেশ কিছুটা সময় আমরা পুরোনো দিনের গল্প করে কাটিয়েছিলাম।
বুদ্ধদেব গুহ-র আরেকটা স্বভাব ছিল, যখন যেখানে যেতেন সেই হোটেলের প্যাডে আমাকে চিঠি লিখতেন। তেমনই একটা চিঠি পাচ্ছি আন্দামান থেকে লেখা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ আন্দামানে ‘ওয়েলকাম গ্রুপের বে আইল্যান্ডে’র প্যাডে,
সুধাংশু
কল্যাণীয়েষু,
দীঘার সমুদ্রপারের মানুষ তুমি, তাই একবার এখানে ঘুরে যাওয়া খুব দরকার পোর্ট ব্লেয়ারের চারপাশেই শুধু সুনীল সমুদ্র– চারদিকেই হাজার মাইলের আগে কোনো ভূখণ্ড নেই। নিকোবরও এই দ্বীপপুঞ্জেরই অন্তর্গত। একদিকে মাড্রাস (চেন্নাই), শ্রীলংকা আর উপরে কলকাতা। উত্তর পূবে বার্মা (মায়ানমার) এবং থাইল্যান্ড। ভারতের মূল ভূখণ্ডের কাছে আন্দামানের STATEGIC IMPORTANCE তাই অসীম। অনেক দেশেরই চোখ আছে এই দ্বীপপুঞ্জের উপরে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। শহরটা পাহাড়ী। গভীর জঙ্গল এখনও নানা জায়গাতে আছে। দেখেও ভালো লাগে। আর কত যে দ্বীপ তা বলার নয়। মোটর বোটে করে যাওয়া যায়। একবার সকলকে নিয়ে এখানে ঘুরে যেও। থাকার অনেকই ভাল ভাল জায়গা আছে। এলে, এই হোটেলে একদিন লাঞ্চ বা ডিনার খেয়ে যেও।
ডাইনিং হল থেকে সমুদ্রের দৃশ্য অনবদ্য।…’
আমি এখনও পর্যন্ত আন্দামান যাইনি। তবে একবার ওখানে বেড়াতে যেতে চাই। গেলে কোনও ছুটির সময় বাড়ির সবাই মিলেই যাব। আর দাদা যে হোটেলে উঠেছিলেন, সেটা এখন কীরকম আছে জানি না, তবে সুযোগ হলে সেখানেই থাকব।
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
……………………………… ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব …………………………
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম