‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে ঋত্বিকের এই অভিনয় সম্ভবত আর কারও করা সম্ভব ছিল না। যেভাবে তিনি হাঁটতেন, যেভাবে তিনি চলতেন, যেভাবে কথা বলতেন এবং যেভাবে তাঁর সহকর্মী, সহমর্মী ও সহজীবী মানুষদের ঠাট্টা করতেন– সেটা সেলুলয়েডে চিরদিনের মতো উৎকীর্ণ হয়ে গেল। আপনি ভাবুন সেই অসামান্য দৃশ্য, যেখানে উৎপল দত্তের কাছে তিনি দশ টাকা চাইছেন, অনেক বেশি টাকা পাওয়া সত্ত্বেও। এই লোভ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন, কেননা তাঁর মনে হল, ওইসব মদ খেলে তাঁর লোম পুড়ে যাবে। তিনি জানালেন, ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। এই যে বুদ্ধিজীবীর দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ছড়িয়ে দেওয়া– এ হাসি তিনি ছাড়া আর কে হাসতে পারতেন।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
কবিরা ও শিল্পীরা যে কী করে ভবিষ্যৎ দেখতে পান! একটি কবিতায় উপলব্ধির এক গাঢ় মুহূর্তে আধুনিক স্পেনীয় কবি লোরকা বুঝেছিলেন, তাঁর গুপ্তহত্যা সম্পন্ন হয়েছে। আর কোথাও তাঁর দেহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঋত্বিক যে কী অবিশ্বাস্য প্রজ্ঞায় বেঁচে থাকার ৫০ বছরের মধ্যে বুঝলেন নিয়তি তাঁকে ডাক দিচ্ছে, যেমনভাবে একদা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের আগে ব্রহ্মচারীরা নিজের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করতেন, তেমনভাবেই ঋত্বিক ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ বানালেন। মহাকালের দিকে দুই চোখ মেলে দিলেন নিরভিমান– ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’।
বছর ২০ আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে সতর্কীকরণের বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। তবু কোন মূঢ় দুঃসাহসে তিনি নিজের উলঙ্গ আত্মায় অস্ত্রোপচার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন– এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার অধিকার পর্যন্ত আমার নেই। বস্তুত, এ ছবির নীলকণ্ঠ বাগচি, ‘নীলকণ্ঠ’ নামটি বলা বাহুল্য রূপকাশ্রিত, স্বয়ং মহাকালের নাম। কিন্তু আমরা খেয়াল করি না বাগচি পদবিটি অস্তিত্বের মূল পর্যন্ত এগিয়েছে। ঋত্বিকের ক্ষেত্রে ঘটক উপাধি, তিনি মূলত বাগচি। এবং এই যে নিজেকে দেখার স্বভাব তাঁর– এটা ‘কোমল গান্ধার’-এ শুরু হয়েছিল। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের আত্মজীবনী। তবুও কোমল গান্ধারের ভৃগু তিনি ছিলেন না। অবিনাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই অভিনয় করেছিলেন ঋত্বিকের মুদ্রাদোষ-সহ। কিন্তু নীলকণ্ঠকে আমার অবিশ্বাস্য মনে হয়, কেননা সেখানে ঋত্বিক ঘটক স্বয়ং এবং তাঁর যাবতীয় অঙ্গভঙ্গি, তাঁর চুল পাকানো, তাঁর মদ্যপানের পর ঠোঁট মুছে ফেলা– এই সমস্ত কিছুই অবিকল। ঋত্বিক নিজেকেই অবিরল দেখতে চাইছেন। জীবন ও আখ্যানের মধ্যে যে দেওয়াল, তা ধসে গেছে। গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জি রোডে সাবেকি বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে আসছেন ভবানীপুরেরই নর্দার্ন পার্কে। আমরা একেবারে সরাসরি ঋত্বিককে এই সড়ক-পরিক্রমায় দেখেছি বাস্তবেও। আর সবচেয়ে সাহসের কথা, ভারতীয় শিল্পীরা যা সবসময় গোপন করে যান, নিজের দাম্পত্য অশান্তি, তাকে কী অসামান্য সাহসে তিনি প্রকাশ করেছেন। দেখতে পাই, গঙ্গার ঘাটে ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’ গানটির সঙ্গে সঙ্গে সমরেশ বসুর ভূমিকায় উৎপল দত্ত বলছেন, যে লোকটা সারাজীবন উদ্বাস্তু-উদ্বাস্তু করে এল, সে আজকে কেমন দূরে সরে রয়েছেন। ঋত্বিক আসলে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন, যেভাবে মহাশিল্পীরা যুগে যুগে নিজেদের অবলোকন করে এসেছেন, যেভাবে ‘লাস মেনিনাস’ (১৬৫৬) ছবিতে ভেলাসকেথ রাজা ও অন্তঃপরিচারিকাদের ছবি আঁকার সময় নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, ঋত্বিক ঘটক তেমনই একটা সিনেমা করার সময় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। শুধু অন্তর্ভুক্ত করলেন না, নিজেকেই প্রধান তদন্তের বিষয় করে তুললেন। এত বড় আত্মপরীক্ষা সিনেমায় সম্ভব নয়। ফেলিনি-র ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ ত্রুফোর ‘৪০০ ব্লোজ’ ছবি দু’টির কথা মনে রেখেও আমার মনে হয়, ঋত্বিক আর নীলকণ্ঠ অভিন্ন হৃদয়। এই ছবিতে ঋত্বিককে যে আমরা শহর থেকে গ্রামে চলে যেতে দেখি, এর একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে।
আসলে নীলকণ্ঠ নিজে রুদ্রদেব বা ভোলানাথ– এক প্রান্তিক অস্তিত্ব। সিনেমাতেও ঋত্বিক যেমন অবহেলিত, একাকী, তাঁর অন্যান্য বন্ধু-সহকর্মী যখন কলকাতা শহরে নানা ভোজসভা, নানা পুরস্কার সভা অলংকৃত করতে থাকেন, তখন ঋত্বিক নির্জনে সময়ের শিলালিপি হয়ে থাকেন। একমাত্র রাত্রির নৈঃশব্দ্য ছাড়া আর কেউ তাঁকে খেয়াল করে না। এই যে নীলকণ্ঠ চলে গেলেন কলকাতা শহর ছেড়ে, তাঁর সঙ্গী হল এক ইঞ্জিনিয়ার। শেষ বয়সে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পছন্দ করতেন। আমার মনে হয় না, বেকার ইঞ্জিনিয়ারটিকে নচিকেতা হিসাবে ভাবা তাঁর খুব আকস্মিক ছিল। তিনি ভাবছিলেনই ইঞ্জিনিয়ারদের ও পেশাদারদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আর তাঁর সঙ্গী হল বঙ্গবালা নামে এক নীড়চ্যুত পাখি। এই তরুণী রূপসী বাংলার প্রতিমা। এই যে একজন যুবক ও একজন যুবতীকে নিয়ে ঋত্বিক বুড়ো আংলার মতো পথে পা দেন, তার একটা প্রতিচিত্র হতে পারে জসিমউদ্দিনের নকশি কাঁথার মাঠ। কিন্তু ঋত্বিক সময়ের সহবাস করতে চেয়েছেন। তিনি যখন কেওড়াতলা শ্মশানের পারে বসে মদ খাচ্ছেন, তখনও নীলকণ্ঠ ভুলে যায় যে, সে একজন বড় প্রতিভা! কিন্তু এই যে খ্যাতির আগুনকে স্বেচ্ছায় পরিহার করা, কুকুরের ডাক, মাতালের খোঁয়াড়ি– এই সবকিছুই আমাদের আশ্চর্য অভিভূত করেছিল। এমনকী, মুহূর্তের জন্য বলে দেওয়া যায়, নবারুণের ‘কাঙাল মালসাট’-এর উৎস এই নৈশ মদ্যপান। এই যে তিনি কারখানার বাইরে শ্রমিক নেতার ভাষণের মধ্যে কুকুরের ডাক গুঁজে দেন, আমাদের সমস্ত রাজনীতি ব্যভিচার মনে হয়। তার পারে বঙ্গবালার গান শুনতে থাকেন ঋত্বিক। নীলকণ্ঠের সেই প্রতিচ্ছবি অতীশ দীপঙ্করের চেয়েও পুরনো মনে হয়। সাহেবি কায়দা নিলে মনে হয়, তিনি ওয়েস্টল্যান্ডের টাইরেসিয়াস। নরক ভ্রমণ যার ভবিতব্য। কিংবা ধরা যাক, জঙ্গলে হঠাৎ নকশাল দলের মধ্যে তাঁর আটকে থাকার মুহূর্ত সমূহ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনাচক্রে কবি ভারভারা রাও এই দৃশ্যটি দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন– how could he imagine all these things? so prophetic! প্রশ্নটা প্রজ্ঞানের নয়। আমাকে যে অবাক করে, তা রজনীর মধ্যযামে সমস্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনকে একটি সন্দর্ভের মতো ব্যবহার করার প্রয়াস। পার্টির ভুলভ্রান্তি ও নিজের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করেন না।
শেষ মুহূর্তে যখন আমাদের বন্ধু অনন্য রায়, যিনি নকশাল নেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁর সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন, তখন তিনি আসলে কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন? গ্যেটে বলেছিলেন, All Poets speak to themselves, thy world only overhears… সমস্ত মহৎ কবিই নিজের সঙ্গে কথা বলেন, আমরাই শুধু আড়াল থেকে শুনি। আসলে তো ঋত্বিক ঘটক নিজেকে বলছিলেন। অনন্য এখানে উপলক্ষ মাত্র। তিনি নিজে নিজের গুরু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’ গল্পটাকে মৃত্যুর আগে উদ্ধৃত করতে চান, কারণ তিনি মনে করেন ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ দলিল। এই সমস্ত রাত্রির অভিনয়কে অনেকবার ভেবে দেখেছি, আসলে লিওনার্দোর আঁকা ‘লাস্ট সাপার’ ছবিটির পুনরাবৃত্তি। কিছু একটা করতে হবে তো– বলে লেন্সে মদ ঢেলে দেন। তাঁর সমস্ত ব্যর্থতা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। যখন তিনি ‘এ ব্যাটা ধরে ফেলেছে’ বলে হাসেন, নিজের অমিতাচার নিজেই ক্ষমা করতে পারেন না। তখন আমরা বুঝি এক দেবতা ভুলক্রমে মানুষ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর উচ্চারণ ছিল সত্য। এবং সেই সত্যের জন্যই তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ কোনও সিনেমা নয়, নিষ্ঠুর আত্মজীবনী।
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে শেষ মুহূর্তে বলা এই সংলাপ কখনওই ভুলব না– ‘ভোরের আলোয় একবার সত্যের মুখ দেখতে চাই’। এই আকাঙ্ক্ষা তাঁর পূর্ণ হয়েছিল কি পূর্ণ হয়নি, তা আমরা জানি না। কিন্তু দীর্ঘকায় শরীর আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে ‘এল গ্রেকো’-র খ্রিস্টের মতো। ওই যে বীরভূমের শালবনে মাতাল নীলকণ্ঠের ওই গমনাগমন– তা আসলে হিন্দু রূপকথায় শিবের মতো এক শ্মশানের পরপারে বসে থাকা মানুষ, যিনি বর্তমানকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় দেখছেন, এবং একই সঙ্গে ‘কুমারসম্ভব’-এর মতো সম্ভাবনা মূহূর্ত দেখছেন। এ ছবির শেষ উলুধ্বনিতে এ নির্মাণের সমালোচনা করার ধৃষ্টতা আমার অন্তত নেই। এই শুটিংয়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু বিঠোফেনের যে পঞ্চম সিম্ফনি তিনি আমাদের জন্য রেখে গেলেন, তাতে মনে হয় একদিন আকাশে ঝড় উঠবেই। কমিউনার্ডস উইল স্ট্রর্ম হেভেন। আমরা বুঝি যে, নীলকণ্ঠ বাগচি সেইরকম মানুষ– চূড়ান্ত ধার্মিকরা যেমনভাবে ঈশ্বরে অর্পণ করেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠা, পরিবারগত নিষ্ঠা, ইত্যাদির চেয়েও তিনি আদর্শকে বেশি মূল্য দিয়ে গেলেন।
ঋত্বিকের এই অভিনয় সম্ভবত আর কারও করা সম্ভব ছিল না। যেভাবে তিনি হাঁটতেন, যেভাবে তিনি চলতেন, যেভাবে কথা বলতেন এবং যেভাবে তাঁর সহকর্মী, সহমর্মী ও সহজীবী মানুষদের ঠাট্টা করতেন– সেটা সেলুলয়েডে চিরদিনের মতো উৎকীর্ণ হয়ে গেল। আপনি ভাবুন সেই অসামান্য দৃশ্য, যেখানে উৎপল দত্তের কাছে তিনি দশ টাকা চাইছেন, অনেক বেশি টাকা পাওয়া সত্ত্বেও। এই লোভ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন, কেননা তাঁর মনে হল, ওইসব মদ খেলে তাঁর লোম পুড়ে যাবে। তিনি জানালেন, ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। এই যে বুদ্ধিজীবীর দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ছড়িয়ে দেওয়া– এ হাসি তিনি ছাড়া আর কে হাসতে পারতেন। অথবা মধুর প্রহসন জেনেও আর কে সিউড়িতে শিক্ষিকা স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি করার মুহূর্ত খুঁজে পেতে পারতেন। এ দেখে আজ আমার নীলকণ্ঠের দিকে তাকিয়ে মনে হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতা ‘মধুক্ষরণের মতো ভালবাসা দিয়ে গেলে ভুল বাংলা দেশে’। এই হলাহল পান করার অধিকার তো একমাত্র তাঁর। একমাত্র তিনিই, নীলকণ্ঠ বাগচি ওরফে ঋত্বিক ঘটক।
ঋ-ফলার অন্যান্য লেখা
……………………………………………………………
দেবজ্যোতি মিশ্রর লেখা:তিতাস শুকোয়, কান্না শুকোয় না, সুরও না
সোহিনী দাশগুপ্তর লেখা: গীতা আর নীতার তফাত আদর্শচ্যুত মানুষ আর আদর্শে বেঁচে থাকা মানুষের তফাত