কোনও কোনও দেশের এমন বড় সাইজের দলবল এবং আয়োজন যে পৃথ্বী থিয়েটারের ছোট মঞ্চে ঠিক মানাত না। সেক্ষেত্রে সঞ্জনা সব সময়েই তাদের অনুষ্ঠানের যথাযথ রূপ দিতে এই ফেস্টিভালের অংশ হিসেবে সারা শহর জুড়ে নাটক করাত। হর্নিমান সার্কেলে বড় জায়গায়, টাটা থিয়েটারের মতো হলে, এন. সি. পি. এ, এমনকী খোলা আকাশের নিচে চার্চের মাঠেও নিয়ে যাওয়া হত নাটককে। মনে আছে মুখোশ ব্যবহারে বিশাল বড় পাপেটের মতো চেহারার মানুষ নিয়ে একটা নাটক অদ্ভুত আলোছায়াতে হর্নিমান সার্কেলে দেখেছিলাম। আর একবার বান্দ্রার চার্চের মাঠে রণপা নিয়ে এক দঙ্গল অভিনেতা মাটিতে বসে থাকা দর্শকদের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে অবাক করা অভিনয় দেখিয়েছিলেন।
১৪.
ভালো বন্ধু থাকলে শত্রুর তো কোনও দরকারই নেই! তবে ভালো বন্ধু সচরাচর মেলা মুশকিল আজকাল। আমার এমনিতে বন্ধুভাগ্য খুব ভালো আর বেশ কয়েকজন ভালো বন্ধু ছিল, এখনও আছে। তার মধ্যে একজন, সঞ্জনা কাপুর। জেনিফার আর শশী কাপুরের কন্যা সঞ্জনা। ওঁদের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। চলচ্চিত্র জগতে কাপুর পরিবারের অবদান সবাই জানে। ভালো বন্ধু বলতে আমরা খুঁজি যার সঙ্গে মন খুলে আড্ডা দেওয়া যায়। একে অপরের মেজাজ মর্জি বোঝে এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে। বন্ধু যদি নবীন বয়সের উৎসাহী এবং মেধাবী হয়, তাহলে আড্ডার ছলে অনেক আধুনিক ইনফরমেশনের আদান-প্রদান আর নানা বিষয়ে জ্ঞানগম্যি বাড়তে থাকে। এর সব গুণগুলোই ছিল সঞ্জনার মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা ছোটদের মানসিক অবস্থা, মানে রিয়ালিটির সঙ্গে থাকতে পছন্দ করত সঞ্জনা। আর সৃজনশীল কাজ, বিশেষ করে অভিনয়, মঞ্চশিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং চিত্রকলার দিকে তার অগাধ আগ্রহ।
সঞ্জনা কাপুরের সঙ্গে আমার আলাপ হয় ওর অন্তরতম নিজের জগৎ, পৃথ্বী থিয়েটারে। শামী কাপুর, রাজ কাপুর, শশী কাপুরদের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুরের নামে নামকরণ। পৃথ্বী থিয়েটার, আড্ডা-মিতালির অসাধারণ এবং মস্ত বড় মূল্যবান এক মিলনমঞ্চ। জেনিফার কাপুরের আগ্রহে এবং তত্ত্বাবধানে আর ওঁর ভাইয়ের সাহায্যে তৈরি অভিনব, আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক এই প্রেক্ষাগৃহ। মঞ্চে আলো, শব্দ এবং অভিনেতা-দর্শকের সম্পর্কের সবকিছুই সঠিক ব্যবহার করে এই প্রেক্ষাগৃহ তৈরি। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দ ব্যবহারের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা, তাই কণ্ঠশিল্পী এবং যন্ত্রশিল্পীদের কাছেও এটা অতি পছন্দের জায়গা। ভারি সুন্দর তার স্থাপত্য। এমনভাবে জায়গাটিকে মানিয়ে আসন বিন্যাস, যেন দর্শকরা সবাই মিলে গায়ে গায়ে বসে মাঝখানে কথক ঠাকুরের মুখে কাহিনি শুনছে একাত্ম হয়ে। যেখানে সামনের সারিতে বসা দর্শক যেন অভিনেতাকে ছুঁতে পারেন। শিল্পীদের মেজাজ বজায় রাখা এবং তাদের মগ্নতায় ব্যাঘাত যাতে না ঘটে তার জন্য নিয়মানুবর্তিতায় সাংঘাতিক কঠোর। অনুষ্ঠান বা অভিনয় শুরুর ঠিক কয়েক মিনিট আগেই প্রেক্ষাগৃহের প্রবেশদ্বারটি তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেরিতে ঢোকা একেবারেই বরদাস্ত করা হয় না। এমনটা আর কোথাও দেখিনি।
জুহু অঞ্চলের এই পাড়াটা চমৎকার। আরব সাগরের তীরে প্রশস্ত বালির সমুদ্রতট, জুহু বিচ, মুম্বই ভ্রমণকারীদের একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গা। পাড়াটার নাম জানকী কুটির। আসলে কাপুর পরিবারের পুরনো আদি বসতবাড়ির নাম ছিল জানকী কুটির, একই নামে এলাকার এখনকার ঠিকানা। অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী এবং ধনীদের বসবাস। চারিদিকে দারুণ বড় বড় অনেক তারাওয়ালা হোটেল, শপিং সেন্টার। বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক খাবারের কেতাদুরস্ত রেস্তোরাঁ অনেক, যাকে বলে হ্যাপেনিং প্লেস। সেরকম একটা হইহই, রইরই, সদা স্ফূর্তির জনবহুল জায়গায় টুক করে পাড়াটার মধ্যে ঢুকে পড়ে পৃথ্বী থিয়েটার। দু’দণ্ড বসার এক অদ্ভুত শান্তির পকেট।
কী নেই সেখানে? সব পেয়েছির আস্তানা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এরকম একটি বহুমূল্য পরিবেশে জনসাধারণের প্রবেশের অবাধ অধিকার। সঞ্জনার ইচ্ছায় ছাত্র-ছাত্রীদের নানারকম কর্মশিবির, নাচ গান নাটক চিত্রকলা সব সময় লেগেই আছে। সারাদিন খোলা, সন্ধেবেলা প্রায় প্রতিদিন নাটক কিংবা গানবাজনার অনুষ্ঠান। এখানে আমার যাতায়াত শুরু গত শতাব্দীর শেষ দশকে। পাশের জমিতে কাপুর পরিবারের বসতবাড়িটি তখনও ছিল। দুটোর মাঝখানে ছিল চমৎকার একটি বাঁশঝাড়। সেই বাঁশগুলোকে বাঁচিয়ে পাশে একটা চমৎকার নিজস্ব রেস্তোরাঁ, পৃথ্বী কাফে। বাঁশের টুল বা বেঞ্চি পাতা, নুড়িপাথর বিছানো জমিতে একটি রুচিসম্মত পরিবেশ। চায়ের সঙ্গে টা ছিল, মজার মজার খাবার। সাধারণের জন্য দু’টাকার কাটিং চা। পকেটে পকেটে চিত্রনাট্য, কবিতা, গল্প, ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে স্ট্রাগ্লারদের ভিড় ছিল। বড়দের সেগুলো দেখানোর জন্য এটাই মিটিং প্লেস। দারুণ সুন্দর একটা বুক শপ, সিনেমা জগৎ এবং অভিনয় জগতের দারুণ ভালো কালেকশন। সন্ধের দিকে পকেটে পয়সা থাকলে পৃথ্বী কাফেতে নতুন মজার গরম পানীয়– আইরিশ কফি। আইরিশ হুইস্কি মিশিয়ে বানানো এই কফির মাথায় ভাসমান সাদা ক্রিম। খাবার লোভ সামলানো বেশ মুশকিল তখনকার দিনে। সারাদিন খোলা। খিদে পেলে লাঞ্চ এবং ডিনারের জন্য ছিমছাম মেনু।
সঞ্জনা কাপুরের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা দেখানো এবং বিশাল কর্মযজ্ঞ সামলানোর পরিচয় আমরা পেলাম ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল’-এর সময়। আমরা নাট্যোৎসব দেখেছি দেশের, কিন্তু এত বড় আন্তর্জাতিক উৎসব আগে কখনও দেখিনি। সত্যিকারের বিশাল সে আয়োজন। একমাসব্যাপী এ নাট্যোৎসব চলত এবং তত সংখ্যার নাটকের দল থাকত। আমন্ত্রিত হয়ে বহু দল আসত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মনে আছে, প্রথম বছর শেক্সপিয়রের নাটক করে এমন একটি দল এসেছিল। তাদের বিশেষত্ব হল নাট্যকার, নির্দেশক, মিউজিক ডিরেক্টর, কলাকুশলী এমনকী, পরিবারের লোকজন একসঙ্গে নাটকের কাজ করত। পুরো দলটা তাদের সন্তান-সন্ততি সহ সারা পৃথিবীতে নাটক করে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াত। তাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হল। তারা যে কোনও দেশে গিয়ে নাটকের ঢং, মানে আঙ্গিক পাল্টে দিত। মিউজিকের বেলায় আঞ্চলিক মিউজিক এবং শব্দ, যেমন আমাদের এখানে এসে বাঁশি, শঙ্খধ্বনি, ঘণ্টা-ঘুঙুর ইত্যাদি নাটকের আবহ সংগীতে ব্যবহার করেছিল।
কোনও কোনও দেশের এমন বড় সাইজের দলবল এবং আয়োজন যে পৃথ্বী থিয়েটারের ছোট মঞ্চে ঠিক মানাত না। সেক্ষেত্রে সঞ্জনা সব সময়েই তাদের অনুষ্ঠানের যথাযথ রূপ দিতে এই ফেস্টিভালের অংশ হিসেবে সারা শহর জুড়ে নাটক করাত। হর্নিমান সার্কেলে বড় জায়গায়, টাটা থিয়েটারের মতো হলে, এন. সি. পি. এ, এমনকী খোলা আকাশের নিচে চার্চের মাঠেও নিয়ে যাওয়া হত নাটককে। মনে আছে মুখোশ ব্যবহারে বিশাল বড় পাপেটের মতো চেহারার মানুষ নিয়ে একটা নাটক অদ্ভুত আলোছায়াতে হর্নিমান সার্কেলে দেখেছিলাম। আর একবার বান্দ্রার চার্চের মাঠে রণপা নিয়ে এক দঙ্গল অভিনেতা মাটিতে বসে থাকা দর্শকদের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে অবাক করা অভিনয় দেখিয়েছিলেন। কখনও কখনও খোলা আকাশের নিচে অভিনয় করার ব্যবস্থা হয়েছে আগুন জ্বালিয়ে। এমন হয়েছে বিদেশের কোনও দলের একটা নাটক করে ঠিক মন ভরছে না কিংবা বড় আয়োজনের নাটক অন্যান্য শহরের লোকগুলোকে দেখানোর ইচ্ছেতেও সঞ্জনা সেটাকে মুম্বইয়ের বাইরে অন্য শহরে নিয়ে গিয়ে, যেমন দিল্লি, বেঙ্গালুরু, কলকাতা– এরকম নানা জায়গায় অভিনয় করিয়েছে।
পৃথ্বী ফেস্টিভাল, বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভালের সময়ে উৎসবের উদ্দাম পরিবেশ। সিনেমা জগতের, মঞ্চ জগতের যারা জুনিয়ার, যাদের হাতেখড়ি হচ্ছে কিংবা প্র্যাকটিস করার জন্য এখানে আসে, তারা সব সঞ্জনা কাপুরের চারপাশে সাহায্যের শত হাত বাড়িয়ে ঘুরঘুর করত। সবাই মিলে হাত লাগাত এই পরিবেশ সাজানো, বাগান, রাস্তাঘাট সাজানোর কাজে। দেওয়ালে সুদৃশ্য দেশ-বিদেশের নাটকের পোস্টার, সে এক দেখার মতো জিনিস। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে সুন্দর হাতের লেখায় নানা রকমের ইনফরমেশন, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে অনুষ্ঠানসূচি। তারই মধ্যে আমাদেরও কাজ থাকত। স্যুভেনির ডিজাইন, পৃথ্বী উৎসবের নিজস্ব পোস্টার ইত্যাদি। একসময় আমি করেছিলাম টিকিট ডিজাইন। ডিজাইনটার গুরুত্ব হল, দর্শক ঢোকার সময়ে তার টিকিটের একটু ছোট্ট অংশ কেটে বাদবাকি যেটা ফেরত দেবে সেটা যেন হয় একটা স্মরণিকা, যেন সংগ্রহ করে রাখা যায়। এভাবে মিলেমিশে পরিবেশ সাজানোর একটা উদ্যম। হাত লাগানো, কাজ করা অথবা না করা, কেবলমাত্র সঙ্গে থেকে ভিড় বাড়িয়ে হইচই করাটাও একটা দারুণ পার্টিসিপেশন বলে মনে হত। হলের সামনে বসে থাকতেন শশী কাপুর, সবাইকে উৎসাহ দিতেন।
তেমনি করে একদিন আমাকে পেয়ে সঞ্জনার বা সঞ্জনাকে পেয়ে আমার মাথায় ঢুকল, থিয়েটারের লবির দেওয়ালগুলোতে শুধুমাত্র পোস্টার না রেখে এটাকে একটা আর্ট গ্যালারি করা যেতে পারে। নিয়মিত চিত্রকলা বা ফোটোগ্রাফি প্রদর্শনীর বাড়তি সংযোজন। যেমন কথা তেমন কাজ। মাঝে মাঝেই আমার বাড়িতে হানা দিতে লাগল সঞ্জনা, গ্যালারি প্ল্যান করার জন্য। শিগগির সেটা কার্যকর হল। পৃথ্বী থিয়েটারে মানুষ আসার আরো একটা শাখা বাড়লো। ১৯৯৫এর আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের উদ্বোধনের দিনে গ্যালারিরও উদ্বোধন। ‘পৃথ্বী আর্ট গ্যালারি‘। শুরুতে আমার একক প্রদর্শনী। শিরোনাম, ‘দি প্লাটফর্ম‘। প্রদর্শনীর বিষয়, শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত উক্তি নিয়ে – ‘পৃথিবীটা আসলে একটা রঙ্গমঞ্চ এবং আমরা সেই রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন ভূমিকায় কুশীলব মাত্র‘। এঁকেছিলাম আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রতিকৃতি। চেহারা, কস্টিউম সবমিলিয়ে তারা যেন এক একটি চরিত্রের অভিনেতা। ছিলো পুলিশ, সাধু সন্ন্যাসীনি, সাহেব সুবো, কুলি মজুর, শিশু কিশোরী যুবা বৃদ্ধ। আর ছিলো পাগল।
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের শুরুর দিনে খাদ্য-পানীয়ের এলাহি ব্যবস্থা থাকে। কাপুরবাড়ির অনুষ্ঠান বলে কথা, শশী কাপুরের নিজস্ব আমন্ত্রণ। সেবারে তার সঙ্গে জুড়ে গেল আমার একক প্রদর্শনী। ছবির ভক্ত বা শিল্প প্রেমিক, বাড়তি লোকজন একগাদা। নাটকের লোক, আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথি, বিদেশিদের ভিড়। সব মিলিয়ে সে রাতে পৃথ্বী থিয়েটারে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সবাই হলের মধ্যে ঢুকতে পারেনি। ঘরে-বাইরে মিলিয়ে আমোদে প্রমোদে প্রায় রাত কাবার। পৃথ্বী কা০ফের মালিক তখন উজ্জ্বল দাশগুপ্ত, বাঙালি। রন্ধনশিল্প বিষয়ে দারুণ উৎসাহ। তিনি হঠাৎ এই সুযোগে তাঁর খাবারের মেনুতে একটা খেল দেখিয়ে দিলেন। ‘রাইস সিরিজ’, মানে পোলাও, বিরিয়ানি ইত্যাদি ভাত জাতীয় খাবারের যা কিছু সম্ভব করা হয়েছে এমনকী, ভাতের ফ্যানটুকু দিয়ে অল্প মশলায় চমৎকার স্যুপ এবং শেষপাতে পিঠে-পুলি-পায়েস।
শুরু করেছিলাম ভালো বন্ধুর কথা দিয়ে। মাঝখানে যা আলোচনা হল, তা যত সিরিয়াস হোক, মূলত মিলনক্ষেত্র, মেলামেশা, মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব তৈরি জায়গা খোঁজা এবং আড্ডা। পৃথ্বী থিয়েটারে এর অনেকগুলোই পেলাম। এখানে যেমন বন্ধু তৈরির জন্য আছে চা এবং বাঁশবাগানে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা, তেমনই বসে থাকা কারও পাশে গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসা এবং আলাপ করার মজা। হয়তো বসে আছেন শ্যাম বেনেগাল কিংবা নাসিরুদ্দিন শাহ অথবা অমরিশ পুরি আর অনুপম খের। যারা নাটক, সাহিত্য, কবিতা, সিনেমা ভালোবাসেন, তাদের জন্য খোলা আসর। পুনের এফ.টি.আই.আই থেকে মুম্বই এসে এখানেই তাদের ভবিষ্যতের খোঁজখবর করতে হয়। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা, দিল্লি থেকে এসে তাদেরও কিছু খোঁজখবর করতে গেলে এখানেই আসতে হয়। স্ট্রাগ্লারদের ভিড়।
এখানেই অমল গুপ্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার। চিনলাম গোবিন্দ নিহালনি কিংবা শ্যাম বেনেগালকে। তরুণ আমির খান দেওয়ালের গা ঘেঁষে মাটিতে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। এখানেই আমি কথা বলেছিলাম আমির খানের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয়েছে মারাঠি থিয়েটারের মকরন্দ দেশপান্ডে, গুজরাতি নাটকের উৎকর্ষ মজুমদার, মিউজিশিয়ান লুই ব্যাংকের সঙ্গে। বাংলার বাইরে বাংলা নাটকের মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে আলাপ এবং তাঁর দলের তরুণতর অভিনেতা গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, দেবশঙ্কর হালদার আমার বন্ধু হল এখানেই। দেবুরা আড্ডা দিতে আমার বাড়িতেও আসত। বিখ্যাত তবলা বাদক জাকির হুসেনের সঙ্গে আলাপ এবং ঘনিষ্ঠ হয়েছে অনুরাগ কাশ্যপ।
‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এর সঙ্গে যৌথভাবে এখানে চায়ের সঙ্গে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা এবং আড্ডা, ছাত্র-ছাত্রী ও বিজ্ঞানের বাইরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে। আঙিনাতে প্ল্যাটফর্ম ড্রামা অর্থাৎ কোনও ছোট দল উঠোনে নাটক করতে পারে কোনও সন্ধ্যায়, তার জন্য পয়সা লাগে না। লবিতে, প্রেক্ষাগৃহে কিংবা আঙ্গিনাতে, সিঁড়িতে অথবা নুড়ি বিছানো বাঁশতলায় বসে কবিতাপাঠ, বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান করা চলে। বন্ধু বা বান্ধবীকে নিয়ে এমনিই আসা যায়। বাঁশবাগানে বসে বাঁশি বা বেহালা বাজায় কেউ। পৃথ্বী কাফের কাটিং চা এবং সমোসা তো আছেই, আগেই বলেছি, আছে সেই আইরিশ কফি। সঞ্জনা কাপুরের আয়োজনে গ্রীষ্মের ছুটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত নাটকের কর্মশিবির ভীষণ জনপ্রিয়। এমন একটা সব পেয়েছি-র ঠেক যদি হাতের মুঠোয় এসে যায়, তাহলে বিষণ্ণতা বা মনখারাপগুলো আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। এর বেশি কী পাওয়ার আছে, এর বেশি কী চাই?
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল