প্রভাতী অধিবেশনে মহালয়া প্রচারিত হওয়ার আগেও কিন্তু ওইদিনের সন্ধ্যেয় ইন্দ্রাণী রায়ের প্রযোজনায় একটি নৃত্যানুষ্ঠান হত, যা মহালয়াকেন্দ্রিক। কিন্তু, নতুন বাড়িতে আসার পরে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। এই সময় থেকেই প্রচলন হল Chroma Key-র ব্যবহার। ফলে স্বর্গ থেকে মর্তের বিভিন্ন অঞ্চল দেখানো সহজ হয়ে গেল।
১৩.
মহালয়া। ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে রেডিও-তে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা, ছোটবেলা থেকে এই ছিল রেওয়াজ আর সকলেরই মতো।
সেই অভ্যেস কিছুটা বদলে গেল দূরদর্শনে মহালয়া শুরু হওয়ার পর। মহালয়ার সকালে, বিশেষ প্রভাতী অধিবেশন আরম্ভ হত আকাশবাণীর অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার ঠিক পরেই। তাই ওই সময়ে তৈরি হয়ে বেরনোর তাড়া থাকত।
প্রভাতী অধিবেশনে মহালয়া প্রচারিত হওয়ার আগেও কিন্তু ওইদিনের সন্ধেয় ইন্দ্রাণী রায়ের প্রযোজনায় একটি নৃত্যানুষ্ঠান হত, যা মহালয়াকেন্দ্রিক। কিন্তু, নতুন বাড়িতে আসার পরে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। এই সময় থেকেই প্রচলন হল ‘Chroma Key’-র ব্যবহার। ফলে স্বর্গ থেকে মর্তের বিভিন্ন অঞ্চল দেখানো সহজ হয়ে গেল।
প্রথমবার মহিষাসুরমর্দিনী প্রযোজনা করেন জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় ও মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনে করেছেন– কল্যাণ ঘোষ, প্রদ্যোৎ, বিভাস পাল এবং বহুবার পঙ্কজদা, শর্মিষ্ঠাদি। প্রদ্যোৎ যেবার প্রযোজনা করেছিল সেবার দুর্গার চরিত্রে রূপদান করেছিলেন হেমা মালিনী। বিভিন্ন সময় যাঁরা যাঁরা এ চরিত্র করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমার পছন্দ ছিল সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, থাঙ্কমণি কুট্টির ছাত্রী।
‘মহালয়ার পুণ্যলগ্নে পিতৃপক্ষের অবসানে দেবী পক্ষের সূচনার এই শুভ মুহূর্তে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই।’ এই বলে শুরু করতাম। স্টুডিও ফ্লোরের বন্ধ ঘরে তখন যেন পুজো পুজো গন্ধ, ‘শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে’ যে সুবাস তাই যেন পাচ্ছি। ‘অশুভ শক্তির বিনাশে শুভ শক্তির জয় হোক।’ এই বলে শেষ করতাম বিশেষ প্রভাতী অধিবেশন।
‘Chroma Key’-র যে এফেক্ট, তা আমরা সাপ্তাহিকীর ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেছি অনেকবার, কখনও পাহাড়ের ঢালে বসেছি, তো কখনও ঝরনার ধারে, বেশ মজা লাগত, নিত্যনতুন বৈচিত্র আনার চেষ্টা আর কী! এখন অ্যাডভান্স টেকনোলজি-র যুগে ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তনের ব্যাপারটা জলভাত, কিন্তু তখন আমাদের কাছে নতুন ছিল।
সাপ্তাহিকী স্টুডিও ছেড়ে বেরিয়েছে বহুবার। দূরদর্শন ভবনের বিশাল বাগান তো ছিলই, তাছাড়া একবার গেলাম রায়চক। শাশ্বতী দত্ত তখন প্রযোজনা করত। গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা ফেস করতে মন্দ লাগল না। ক্রোমার ছবির চেয়ে সত্যিকারের জল তো আকর্ষণ করবেই বেশি। আদিত্য সর্বাধিকারী যখন প্রযোজনা করত তখন কোথায় না গেছি! নিকো পার্কের পাশে ঝিলমিল বলে একটা জায়গা ছিল, সেখানে জলের ওপর নড়বড়ে সাঁকোয় দাঁড়িয়ে বা ছোট বোটে করে জলে ভাসতে ভাসতেও অনুষ্ঠান সূচি বলেছি। একবার ওর ইচ্ছে হল ক্রিসমাসের আগের সাপ্তাহিকী সেন্ট পলস ক্যাথিড্রলে করবে। যে কথা সেই কাজ! পারমিশন জোগাড় করে ক্যাথিড্রাল-কে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর ধরে শুটিং হল।
……………………………………………
পুরোনো বাড়িতে দোলের দিন এক অভিনব সাপ্তাহিকীর কথা বলি। সে সময়টায় সুচন্দ্রা চৌধুরী সাপ্তাহিকী প্রযোজনা করত। ওর মনে হল নতুন রকম কিছু করা যেতে পারে। ছোট স্টুডিওর একদিকে ক্যাপশন স্ট্যান্ডে বোর্ডের ওপর রঙের প্রলেপে ছবি ফুটিয়ে তুলছে গৌতম ভৌমিক, এক পাশে দাঁড়িয়ে দেবাশিস রায়চৌধুরী ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ধরেছি যে তান…’ গাইছে। আমি সেদিন পরেছি হলুদ রঙের শাড়ি, কপালে আবিরের সামান্য আভাস। গানের শেষে আমি এলাম স্ক্রিনে, শুরু করলাম, ‘রঙের ঝড় উচ্ছ্বসিল গগনে, রঙের ঢেউ রসের স্রোতে মাতিয়া ওঠে সঘনে… বাঁধনহারা রঙের ধারা ওই যে বহে যায় রে।’
……………………………………………
একবার সাপ্তাহিকীর শুটিং হল বাঁকুড়ার ছান্দারে। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম উৎপল চক্রবর্তীর ‘অভিব্যক্তি’-কে নিয়ে একটি কাজ করতে, সেই অবকাশে চলতি সপ্তাহের শনিবারের অনুষ্ঠানটিও সেরে ফেলা গেল। তবে, সাপ্তাহিকী বেশিরভাগ সময় লাইভ হত।
আগের কোনও পর্বে বলেছি যে, সাপ্তাহিকী প্রযোজনা শুরু করেছিল প্রদ্যোৎ সমাদ্দার। ও কখনও রেকর্ডিংয়ে যেত না, বলত লাইভ করতে ওর মজা লাগে বেশি। কাজটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। যিনি প্রোডাকশন কন্ট্রোল রুমে বসছেন এবং যিনি ক্যামেরার সামনে বসছেন– দু’জনের জন্যেই। সাত দিনের অনুষ্ঠানের ক্লিপিং ঠিক ঠিক সময় নেওয়া এবং তারই মাঝে মাঝে না দেখে অতখানি বলা সহজ কাজ ছিল না। মনে রাখতে হবে, এই সময় আমাদের টেলিপ্রম্পটার আসেনি।
পুরোনো বাড়িতে দোলের দিন এক অভিনব সাপ্তাহিকীর কথা বলি। সে সময়টায় সুচন্দ্রা চৌধুরী সাপ্তাহিকী প্রযোজনা করত। ওর মনে হল, নতুন রকম কিছু করা যেতে পারে। ছোট স্টুডিওর একদিকে ক্যাপশন স্ট্যান্ডে বোর্ডের ওপর রঙের প্রলেপে ছবি ফুটিয়ে তুলছে গৌতম ভৌমিক, এক পাশে দাঁড়িয়ে দেবাশিস রায়চৌধুরী ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ধরেছি যে তান…’ গাইছে। আমি সেদিন পরেছি হলুদ রঙের শাড়ি, কপালে আবিরের সামান্য আভাস। গানের শেষে আমি এলাম স্ক্রিনে, শুরু করলাম, ‘রঙের ঝড় উচ্ছ্বসিল গগনে, রঙের ঢেউ রসের স্রোতে মাতিয়া ওঠে সঘনে… বাঁধনহারা রঙের ধারা ওই যে বহে যায় রে।’ দর্শকদের দোলের রঙিন শুভেচ্ছা জানিয়ে এলাম অনুষ্ঠানের কথা বলায়। এমন কত নব নব রূপে উপস্থাপন করার প্রয়াস ছিল আমাদের।
দোলের দিনের কথা বলতে গিয়ে বসন্তোৎসবে শান্তিনিকেতনে যখন প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলতাম,
‘আলোক রসে মাতাল রাতে বাজিল কার বেণু,
দোলের হাওয়া সহসা মাতে, ছড়ায় ফুলরেণু…’
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
সেইসব দিনের স্মৃতি ফিরে এল। এমনকী আমার অবসর গ্রহণের পরেও এই বিশেষ দিনটির জন্য ডাক পড়ত। তখন বসন্তোৎসব চলে এসেছে পূর্ব পল্লির মেলার মাঠে। লোকের ভিড় সেখানে সামলানো দায়। একবার তো এমন হল যে, অনুষ্ঠানের শেষে বেরিয়ে OB Van পর্যন্ত তো এলাম, তারপর নিজের গাড়ি অব্দি পৌঁছতে গিয়ে লোকের ভিড়ে প্রায় মারা পড়বার জোগাড়। Stampede অবস্থা থেকে কোনক্রমে উদ্ধার করে ক্যামেরাম্যান বন্ধু দেবাশিস ভট্টাচার্য। বসন্তোৎসবে লোক সমাগমের প্রাবল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বলেই বোধ হয় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে শেষ যেবার বড় করে উৎসব হল সেবারেও আমি ছিলাম সেই live coverage-এর উপস্থাপনায়, আমার প্রিয় প্রকৃতি-পরিবেশ মাঝে।
সাদা-কালোর দিনে একবার ইডেন গার্ডেন্সে ক্রিকেট খেলা চলাকালীন কমেন্ট্রি বক্সে নামী কমেন্টেটরদের মধ্যে দাঁড়িয়ে সরাসরি ঘোষণা করেছিলাম– সেও এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।