হরিসাধন দাশগুপ্ত প্রোডাকশন্সের দু’টি উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্রের কাজে রাজার সঙ্গে আমি ছিলাম, দু’টির কাজই শান্তিনিকেতন নির্ভর। এখানে উল্লেখ করছি এই কারণে যে, এর মধ্যে একটি ছবি দূরদর্শন-এর জন্য তৈরি, দিল্লি দূরদর্শন অর্থাৎ ন্যাশনাল টেলিকাস্টের জন্য। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-চিন্তা নিয়ে ! ‘Tagore’s Dream : Our Dream’। আরেকটি রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা, তথ্যচিত্রের নাম: নির্মাণ।
শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আবাল্য, কিন্তু শুটিংয়ের জন্য শান্তিনিকেতনে যাওয়া অবশ্যই দূরদর্শনে যোগ দেওয়ার পরে। প্রথমবার যখন আমি আর শাশ্বতী গেলাম মিউজিক সেকশনের অনুষ্ঠান রেকর্ড করার জন্য, জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় এবং মালতী বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রযোজনায়। ওবি ভ্যান (Outdoor Broadcasting Van) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখান থেকেই প্রোগ্রাম রেকর্ডিং হত।
আম্রকুঞ্জ, শালবীথি ছাড়াও উত্তরায়ণের ভিতরে শুটিং হয়েছিল। শ্যামলী বাড়ির সামনে বসে মোহরদি বাচ্চুদি গান গাইছেন সে স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। উদয়ন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের উপস্থাপনা করতে হয়েছিল। বাচ্চুদি (নীলিমা সেন) গান ধরলেন, ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে…’, বেদন বাঁশি যেন সত্যিই বেজে উঠল বাতাসে বাতাসে। এই প্রসঙ্গে হঠাৎ মনে পড়ল, মোহরদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)র গাওয়া ‘আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে…’ গানের রেকর্ডিংয়ের দিনের কথা, তবে সেটা শ্যামলী বাড়ির সামনে নয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কোনও এক ২৫ বৈশাখের সকালে।
ফিরি শান্তিনিকেতনে। ‘বিকেলের বৈঠক’ নামে একটা অনুষ্ঠান করত সজয় দাশগুপ্ত, সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে। তেমনই এক বৈঠক বসল শান্তিনিকেতনে, প্রতীচী বাড়ির পিছনদিকের বড় বারান্দায়। অমিতা সেন তো ছিলেনই, আর ছিলেন ষাট-সত্তর ঊর্ধ্ব বিশিষ্ট আশ্রমকন্যারা। চিত্রশিল্পী মুকুল দে’র স্ত্রী বীণাদি তখন যথেষ্ট অসুস্থ, চলাফেরায় সমস্যা, তবুও আমার অনুরোধে যোগ দিয়েছিলেন। এই বৈঠক চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার।
হরিসাধন দাশগুপ্ত প্রোডাকশন্সের দু’টি উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্রের কাজে রাজার সঙ্গে আমি ছিলাম, দু’টির কাজই শান্তিনিকেতন নির্ভর। এখানে উল্লেখ করছি এই কারণে যে, এর মধ্যে একটি ছবি দূরদর্শন-এর জন্য তৈরি, দিল্লি দূরদর্শন অর্থাৎ ন্যাশনাল টেলিকাস্টের জন্য। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-চিন্তা নিয়ে ! ‘Tagore’s Dream : Our Dream’। বহুদিন ধরে শান্তিনিকেতনে থেকে কাজ হয়েছিল। দূরদর্শনের জন্য হলেও যেহেতু ব্যক্তিগত পরিসরে তৈরি তাই বিশদে লিখছি না এ বিষয়ে।
দূরদর্শনের টিম নিয়ে তৈরি যে-তথ্যচিত্রের কথা বলব, তার নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মূল্য আছে । নাম ‘নির্মাণ’। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনা এবং স্থাপত্যচিন্তা এই হল বিষয়, যে-দিকটি নিয়ে কখনও কোনও কাজ হয়নি তার আগে। ‘দেশ’ পত্রিকায় অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি লেখা পড়েছিলাম, সেই থেকেই তথ্যচিত্রের ভাবনা আসে। সত্বর যোগাযোগ করা হলো একাধারে আর্কিটেক্ট, লেখক, চিত্রশিল্পী এই মানুষটিকে।
ঠিক হল অরুণেন্দু থাকবেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে এবং ক্যামেরার সামনেও আসবেন তিনি, সঙ্গে থাকব আমি ।
নির্দিষ্ট দিনে আদিত্য সর্বাধিকারীর নেতৃত্বে আমাদের টিম গিয়ে পৌঁছলাম শান্তিনিকেতনে, পূর্বপল্লি গেস্ট হাউসে সবার থাকার ব্যবস্থা। দলে তিনজন মেয়ে, এবার আর আমি একা নই, নন্দিনী চ্যাটার্জি প্রোডাকশনে, সায়ন্তনী মেক আপে, তিনজনে এক ঘরে। ক্যামেরাতে উৎপল মৈত্র, উৎপলের সঙ্গে আমার খুব ভালো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল, দক্ষ ক্যামেরাম্যান তো বটেই তার সঙ্গে ঠিক কী শট চাইছি, সেটা ওর মেধা দিয়ে বুঝতে পারত। এছাড়াও দলে ছিল সোমনাথ, স্বপন, প্রদীপ। অরুণেন্দু ছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতে, শুটিং স্পটে চলে আসতেন কখনও কখনও আমরা পৌঁছানোর আগেই।
যদিও রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যভাবনা আমাদের বিষয়, তবুও এই তথ্যচিত্র আমরা শুরু করেছিলাম একেবারে গোড়ার কথা দিয়ে অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে যখন ২০ বিঘে জমি কেনেন, সেই সময় থেকে। কাচঘর বা মন্দির নির্মাণের অন্তরালে মহর্ষির যে শৈল্পিক ভাবনা তার খুঁটিনাটি আছে এই ছবিতে, আছে তাঁর করা ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়ির কথকথাও।
রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে উন্মোচিত হল স্থাপত্য ভাবনার এক নবদিগন্ত। খড়ের চালের ‘নতুন বাড়ি’, ‘দেহলী’, পরে উত্তরায়ণের পাঁচটি বাড়ি ‘কোণার্ক’, ‘উদয়ন’, ‘শ্যামলী’, ‘পুনশ্চ’, ‘উদীচী’ নির্মাণের ইতিহাস ধরা আছে এতে। অরুণেন্দু আর আমি প্রতিটি জায়গা ঘুরে ঘুরে তার বর্ণনা দিয়েছি, কখনও কথা বলেছি ‘মৃন্ময়ী”র চাতালে বসে। ‘নির্মাণ’ তথ্যচিত্রে গান গেয়েছিল ঋতচেতা গোস্বামী।
আদিত্যর সঙ্গে জোট বেঁধে পরের তথ্যচিত্র ‘তব মঙ্গল আলোকে’। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এসেছিল শোকের এক ২২ শ্রাবণ, তাঁর একমাত্র দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথের সেদিন অকালমৃত্যু হয়েছিল জার্মানিতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথ্যচিত্রটি মূলত তৈরি হলেও রবীন্দ্রনাথের জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে যে দর্শন, তার স্পষ্ট রূপ পাওয়া যায় এর মধ্যে। এবারেও ক্যামেরায় উৎপল মৈত্র। আমরা শুটিং করেছিলাম ১৯৩২ সালের ওই সময়টায় রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় যে যে বাড়িতে ছিলেন, সেসব জায়গায়, বরানগরে নেত্রকোণা নামে এক বাড়িতে যার তখন ভগ্ন দশা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের বাড়িতে যা পরবর্তীতে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট’ এবং এক বৃষ্টির দিনে জোড়াসাঁকোর অলিন্দে ও ঘরে। বন্ধু ইন্দ্রাণী ঘোষ তখন প্রদর্শশালার অধ্যক্ষ, তাই আমাদের ছিল অবাধ যাতায়াত। ম্যাক্সমুলার ভবনের প্রভূত সাহায্য পেয়েছিলাম রাজু রমনের সৌজন্যে। জার্মানির যেসব ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ওঁদের থেকেই পাওয়া। রবীন্দ্রনাথ ও দীনবন্ধু এন্ডুজের ইংরেজি চিঠিগুলি পড়েছিলেন আনন্দলাল, যাঁর কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গির আমি বরাবরই মুগ্ধ। গান গেয়েছিল সোমা রায় ও ঋতচেতা। ‘নির্মাণ’-এর মতো ‘তব মঙ্গল আলোকে’র ভাষ্যরচনা ও ভয়েজ ওভার– বলা বাহুল্য আমারই।
এই সময় থেকেই বোধোদয় হয় যে, এমন কাজগুলিও হয়তো রক্ষিত হবে না আগেরগুলির মতোই, তাই টেলিকাস্টের সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে রেকর্ড করে রাখি, সেই কারণে এখনও আমার ইউটিউব চ্যানেলে আগ্রহী দর্শকের এই দু’টি তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ আছে।
আমার আর সজয়ের করা দু’টি তথ্যচিত্রের কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, প্রযোজক অলোক সেন ভরসা করে ন্যাশনাল টেলিকাস্টের এই কাজ দু’টি আমাদের দিয়ে করিয়েছিলেন। প্রথমটি ‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র’, ইংরেজি কমেন্ট্রি করেছিলেন জগন্নাথ গুহ। দ্বিতীয়টি দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত সম্পর্কে। এই কাজটি করতে গিয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী শিক্ষাবিদ হীরেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়া এবং তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া।
এ সময় আরেকটি সমমানের কাজ করেছিলাম আমরা তবে সেটি সাক্ষাৎকার মূলক অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্রের আখ্যা তাকে দেওয়া যায় না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের সাক্ষাৎকার। তাঁর বাড়িতে গিয়ে যে আড়ম্বর বিহীন সহজ জীবনযাত্রা দেখেছিলাম তা আমায় অবাক করেছিল।
এসব কাজ সংরক্ষণ করা হয়নি, কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
শুধু দই দিয়ে বিচার করলে দক্ষিণ কলকাতাকে উত্তর কলকাতা ১০ গোল দেবে! শ্যামবাজার ছাড়িয়ে সিঁথি, বরানগর, ব্যারাকপুরের দিকে যত যাওয়া যায়, সেই পথেও চমৎকার সব মিষ্টির দোকান আছে। সেখানকার রসগোল্লা মোটেই ‘স্পঞ্জ’ নয়। এবং অরিজিনাল দই তৈরি হয় সেখানে– যাকে বলে ‘পয়োধি’!