একদিন পুরী থেকে মাইল ১৫ দূরে আর্টিস্ট ভিলেজ রঘুরাজপুরে গিয়ে দেখে এলাম ঘরে ঘরে রাষ্ট্রপতির সোনার মেডেল পাওয়া শিল্পীদের কীর্তিকলাপ। কেউ ঝুঁকে পড়ে জংলা কারুকার্য করা পট আঁকছে তো কোথাও বুড়ো বাবা, ছেলে ও তার বউ মিলে অন্য কাজের ফাঁকে পালা করে বাড়ির দাওয়ায় এসে রং লাগাচ্ছে কাঠের পুতুল জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামের গায়ে। লাল, সবুজ, কমলা– কে কোন রংটা দেবে সেটাও দেখলাম ভাগ করা আছে । বেশিরভাগ বাড়ির বাইরেটা দেওয়ালচিত্রে ভরপুর, থিম রামায়ণ, মহাভারত থেকে নিয়ে রাগমালা।
একে পুজোর ভরা মরশুমে পুরী, তায় ঘর ঠিক না করে এসেছি। মেরিন ড্রাইভের ওপরে সার দেওয়া জাঁকালো সব হোটেল রয়েছে, কপাল ঠুকে প্রথমে ঢুঁ মারলাম পুলিন পুরীতে, বলল– হাউস ফুল, তবে বিকেলের দিকে ওদের আরেকটা হোটেল ‘নিউ সি হক’-এ ঘর দিয়ে দিল। এটাও সমুদ্রের সামনেই। দুপুরে আমরা পুলিন পুরীতেই খেয়ে নিয়েছিলাম, কলাপাতায় শুক্তো, চচ্চড়ি, পাবদার ঝাল, খাসা রান্না! তারপর সটান পাঁচতলার ছাদে উঠে হাল্লা রাজা যেভাবে কেল্লা থেকে তাঁর সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখছিলেন, প্রায় সেই কায়দায় সামনের খোলা সমুদ্র আর ভিড় ঠাসা বালিয়াড়ির প্যানারমিক ভিউ দেখে অনেকটা সময় কাটল। সেবার একটা গোটা সকাল জোয়ারের মধ্যে সমুদ্রে নেমে পাহাড়প্রমাণ ঢেউয়ের সঙ্গে সমানে ধস্তাধস্তি চালিয়ে গেল আমার গিন্নি আর ১২ বছরের পুত্র বুবুল।
ছকে বাঁধা সাইট সিইং ছাড়াও একদিন পুরী থেকে মাইল ১৫ দূরে আর্টিস্ট ভিলেজ রঘুরাজপুরে গিয়ে দেখে এলাম ঘরে ঘরে রাষ্ট্রপতির সোনার মেডেল পাওয়া শিল্পীদের কীর্তিকলাপ। কেউ ঝুঁকে পড়ে জংলা কারুকার্য করা পট আঁকছে তো কোথাও বুড়ো বাবা, ছেলে ও তার বউ মিলে অন্য কাজের ফাঁকে পালা করে বাড়ির দাওয়ায় এসে রং লাগাচ্ছে কাঠের পুতুল জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামের গায়ে। লাল, সবুজ, কমলা– কে কোন রংটা দেবে, সেটাও দেখলাম ভাগ করা আছে । বেশিরভাগ বাড়ির বাইরেটা দেওয়ালচিত্রে ভরপুর, থিম রামায়ণ, মহাভারত থেকে নিয়ে রাগমালা। জায়গাটা গুরুকুল আশ্রম হিসেবে গড়ে উঠেছে বলে আশপাশের গাঁ থেকে বহু ছেলেমেয়ে এসে কাজ শেখে। একটা ঘরে একদল বসে তালপাতার পুঁথির ওপর পেনসিল দিয়ে খসড়া করছে, আরেক দল নতুন ভোজনালয়ের দেওয়ালে ছবির প্যানেল আঁকায় সাহায্য করছে তাদের মাস্টার বিজয় পরিদাকে। প্যানেলের বিষয়টিও লাগসই। গ্রামের হাটে তরিতরকারি কেনা থেকে নিয়ে রান্নাবান্না হওয়া অবধি পরপর খাওয়া সংক্রান্ত যাবতীয় দৃশ্য। দাঁড়িয়ে দেখলাম পরিদা মশাইয়ের দক্ষ হাতের তুলি চালানো। সবশেষে পাকড়াও করা গেল নামডাকওলা শিল্পী রবীন্দ্র মহাপাত্রকে। মুখচোরা মানুষ, বয়সও বেশি নয়, আমার প্রশ্নগুলো বুঝতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলেন, উত্তরও আসছিল খুব ভাঙা ভাঙা। তবে সার বোঝা গেল– সরকার থেকে এদের বেবাক দুয়োরানি বানিয়ে রেখেছে টুরিস্টদের। এদিকে পাঠানোর চেষ্টাই করে না ফলে স্রেফ মাউথ পাবলিসিটির ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে সবাই। গ্রামে ঢোকার মুখে চোকলা ওঠা সাইনবোর্ডখানা দেখে আমার অবশ্য আগেভাগেই সেটা মালুম হয়েছিল।
একদিন যেতেই হল বাসে করে সাইট সিইং করতে, সকাল ন’টাতেই ঝলসে দেওয়া গরমের মধ্যে কোনারকের সূর্যমন্দির দর্শন হল তারপর ধওলাগিরির মাথায় ভারত আর জাপান সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় বানানো শান্তিস্তূপ। এই পাহাড় আর তাকে ঘিরে থাকা বিশাল প্রান্তরেই হয়েছিল সেই ভয়ানক কলিঙ্গ যুদ্ধ, যেখানে মারা পড়েছিল প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্য! সদ্য শাহরুখ খানের ‘অশোকা দ্য গ্রেট’ দেখে আসা বুবুলের উত্তেজনা আর থামতেই চায় না! কারণ শোনা গেল ওই জগঝম্প মার্কা সিনেমাটির শুটিংও নাকি হয়েছিল এইখানেই। দ্বিতীয় পর্বে লিঙ্গরাজ মন্দির আর নন্দনকানন ঘুরিয়ে উদয়গিরি-খণ্ডগিরি যাওয়া হল। প্রাচীন আমলে জৈন সাধু সন্তদের নির্বিঘ্নে বসবাসের কথা ভেবে পাহাড় কেটে এখানে যেসব গুহা গড়ে তোলা হয়েছিল, তার আধ্যাত্মিক মূল্যকে পাত্তা না দিয়ে গোটা জায়গাটাকে আমরা কীভাবে পিকনিক স্পট বানিয়ে ফেলেছি– দেখে অবাক হলাম! সারাদিন ধরে ঘোরাঘুরির একঘেয়েমি কাটানোর জন্য ভিডিও কোচের ব্যবস্থা থাকে, আমরাও ছোট্ট খুপরির মতো টিভির পর্দায় টুকরো টুকরো করে ‘ভির জারা’ সিনেমাটা দেখে ফেললাম। আমার প্রথমবার, প্রীতি জিনটার বাবা যিনি হয়েছেন, তাঁর চেহারা আর অভিনয় মনে ধরলেও অভিনেতাকে আগে দেখিনি অতএব বুবুলের শরণাপন্ন হলাম। বেচারি কিছুতেই আর নামটা মনে করতে পারছে না তারপর হঠাৎ বাসসুদ্ধ সবাইকে চমকে দিয়ে মহামান্য নিউটনসাহেবের মতো চেঁচিয়ে উঠল ‘বোমান ইরানী’!