টলিউড ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে একডাকে চেনে। হেয়ারস্টাইলিং-এ তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিন দশক ধরে হেমা মুন্সি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। নেপথ্য শিল্পীর ভাবনা, পথচলা সামনে এল। কথোপকথনে শম্পালী মৌলিক।
প্রায় ৩০ বছর ধরে হেয়ার স্টাইলিস্ট হিসাবে কাজ করছেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে। শুরুটা কীভাবে?
আমি নিজে কখনও ভাবিনি আর্টিস্টদের সাজাব। আমার বাবা সরোজ মুন্সি মেকআপ শিল্পী ছিলেন। আমি বরং ছোটবেলায় ভাবতাম বড় হয়ে গোয়েন্দা হব (হাসি)। পাকেচক্রে এই কাজেই চলে এলাম।
আপনার বাবা যখন কাজ করতেন, তখন তাঁর সঙ্গে স্টুডিওতে যেতেন নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ, যেতাম। মুভিটোন-এ এবং আরও কিছু জায়গায় যেতাম। ওখানে স্টুডিওর ডানদিক ধরে টানা মেকআপ রুম ছিল, বারান্দা ছিল। আমি তখন ছোট। যেতাম, খেলতাম, বেল পাড়তাম। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় এনটিওয়ান-এ যেতাম। এইরকম আর কী! খুব আবছা মনে আছে।
তাও একটু জানতে চাই…
বাবাকে দেখেছি উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করতে। নিতাইকাকুকেও দেখেছি। ওঁরা সকলে মিলে একটা টিম ছিল। বাবার মুখেই শুনেছি, আমি যখন ‘মাতৃভবন’ হাসপাতালে জন্মেছিলাম, সেদিন উত্তমকুমারের সঙ্গে বাবার শুটিং ছিল। সুপ্রিয়া দেবীও ছিলেন সেই ছবিতে। আমার জন্মের কারণে মা তখন ভর্তি। উত্তমকুমার আর সুপ্রিয়া দেবী ‘পদ্মিনী’ গাড়ি চেপে বম্বে ডাইংয়ের নতুন টাওয়াল কিনে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। আর আমাকে তোয়ালে মুড়ে হাসপাতাল থেকে কোলে করে বাড়ি এনেছিলেন ওঁরা। (জোরে হাসি)
সিনেমায় প্রথম বড় ধরনের কাজ কোনটা?
আমি যখন কাজ শুরু করেছি সব ছবিই বড় ধরনের। তবে আমি শুরুতে অ্যাসিস্ট করতাম হেয়ার স্টাইলিস্ট মীরা নন্দীকে। উনি ছোটখাটো সব ছবিতেই আমাকে সঙ্গে রাখতেন। শুরুতে আমি প্রচুর বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি। এখনও করি। শুরুতে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতেই আমার উল্লেখযোগ্য কাজ। ‘পাতালঘর’-ও করেছিলাম শুরুর দিকে। সেই সময় বিজ্ঞাপনের যাঁরা পরিচালক ছিলেন, তাঁরাই পরে সিনেমা পরিচালনায় আসেন। সেইসব সিনেমায় তখন আমি কাজের সুযোগ পাই।
ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে প্রথম কাজ কোন ছবিতে?
‘শুভ মহরৎ’। তারপরে ওঁর অনেকগুলো ছবিতেই করেছি। ‘শুভ মহরৎ’-এ রাখী গুলজার, শর্মিলা ঠাকুর, নন্দিতা দাস সকলের হেয়ার স্টাইল-ই করেছিলাম। ‘নৌকাডুবি’, ‘খেলা’, ‘সানগ্লাস’-এর কাজও আমার। ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনীত ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এও কাজের সুযোগ হয়েছিল।
প্রদীপ সরকারের সঙ্গেও তো আপনার গভীর যোগ ছিল।
বহু বিজ্ঞাপনে ওঁর কাজ করেছি। তারপর যখন ‘পরিণীতা’ করেন, বম্বেতে শুটিং ছিল। হিরোইন বিদ্যা বালান। এ প্রসঙ্গে বলি, তার আগে আমি বিদ্যার সঙ্গে শুভা মুদগলের একটি অ্যালবামে কাজ করেছিলাম। যেখানে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের আদলের একটি চরিত্রে বিদ্যাকে দেখানো হয়েছিল। সেই লুকের হেয়ার আমি করেছিলাম। তো এবার বিদ্যা যখন ‘পরিণীতা’ করবেন, বম্বেতে ৬০/৭০ বার লুক সেট করা হয়েছিল। কিন্তু বিধু বিনোদ চোপড়ার কিছুতেই বাঙালি মেয়ের লুক হিসাবে ওটা পছন্দ হচ্ছিল না। শেষে প্রদীপ সরকার এবং ওঁরা সকলে মিলে কলকাতা থেকে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আমি হেয়ার করার পর লুক ফাইনাল হয়েছিল। নয়তো ওটা বম্বের টিমের করার কথা ছিল। (হাসি)
৩০ বছর তো লম্বা জার্নি…
কিন্তু এখনও আমার মনে হয় প্রত্যেক দিনই নতুন দিন, নতুন কিছু শিখছি। আমাদের ফ্যাশন বিষয়টাই তাই। ৩০ বছর কাজ করেছি এমন মনে হয় না কখনও। কারণ, নতুন চরিত্রে প্রাণ দিতে হয়, প্রত্যেকবার নতুন করে।
ইদানীংকালে জয়া আহসানের প্রায় সব ছবির হেয়ার স্টাইল আপনার করা। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সঙ্গেও কাজ করেছেন। এত নামী সব শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন, মনে ধাক্কা দেওয়ার মতো কোনও অভিজ্ঞতা?
ঠিকই। জয়া আহসানের সঙ্গে সদ্য ‘দশম অবতার’-এর কাজ করেছি। ঋতুদির সঙ্গে ‘মায়াকুমারী’ ছাড়া আরও অনেক কাজ করেছি। দারুণ অভিজ্ঞতা। আর্টিস্ট কাজে খুশি হয়েছেন এমন অভিজ্ঞতা যেমন আছে, আবার সন্তুষ্ট হচ্ছেন না তেমনও আছে। আমি চেষ্টা করি পরিচালকের ভাবনাকে রূপ দিতে। মানে তাঁর ভিশনকে সত্যি রূপদান করাটাই আমাদের কাজ। আমার বেশি ডাক আসে পরিচালকের তরফ থেকে। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করি, তারা ছবির চরিত্রের মতোই হয়ে ওঠে। যে কারণে একেবারে কমার্শিয়াল ছবিতে খুব একটা কাজ করি না। খুব চড়া মেক আপের ধারার কাজে আমি অভ্যস্ত নই। তবে একেবারে তেমন করিনি, এমনটা নয়।
অতনু ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়– এঁদের ছবিতে তো কাজ করেছেন?
হ্যাঁ, অনীক দত্ত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি এঁদের সঙ্গেও কাজ করেছি। এখন চলছে শিলাদিত্য মৌলিক আর প্রতিম ডি গুপ্তর কাজ। অনীকদার কাজটা এবার শুরু হবে।
‘বিনোদিনী অপেরা’-তে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কেশসজ্জার নেপথ্যেও তো আপনার হাত?
হ্যাঁ, রমরম করে চলছে ওটা। সুদীপ্তা চক্রবর্তী একেবারে বাঘিনী! আমরা তো উইংস-এর ধার থেকে দেখি, ব্যাকস্টেজে কাজ করি বলে সামনে থেকে দেখার সুযোগ পাই না। সাংঘাতিক কাজ করেছে।
এক্ষেত্রে বলব আপনি তো নেপথ্য কারিগর। মূর্তিতে প্রাণ দিচ্ছেন, কিন্তু স্বীকৃতি তো সেভাবে মেলে না। খারাপ লাগে না?
(হাসি) আমি কখনও কোনও অ্যাওয়ার্ড-ও পাইনি। এই কাজগুলো করেই আনন্দ। এমন ছোট ছোট কিছু উপহার আমি পেয়েছি, রেখে দেওয়ার মতো, ওটাই প্রাপ্তি। যেমন– বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের ‘তিন কাহন’ বলে একটা ছবিতে করেছিলাম এবং ‘মানিক বাবুর মেঘ’-এর উনি প্রযোজক ছিলেন। ওঁর সঙ্গে একটা দু’দিনের বিজ্ঞাপন করেছিলাম কিছুদিন আগে। সব কাজ শেষে ওঁর স্ত্রী মোনালিসা মুখোপাধ্যায় একটা ফুলের তোড়া আমার জন্য এনেছিলেন। এইগুলো বেশি মূল্যবান আমার কাছে পুরস্কারের থেকেও। এগুলো কেউ দেখতে পায় না, স্টেজেও উঠতে হয় না।
এন্ড ক্রেডিট স্ক্রোলিং-এর সময় যখন নেপথ্য শিল্পীদের নাম দেখানো হয়, বেশিরভাগ দর্শক উঠে পড়ে। আক্ষেপ হয় না?
ঠিকই। আমরা ব্যাকস্টেজের কাজ করি কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এখন দেখি, আমার নাম ছবির শুরুর দিকে যাচ্ছে। এটা খুব ভাল লাগার জায়গা। আগে এমন ছিল না সত্যি। শেষ অবধি আমরা নিজেরা দাঁড়িয়ে থাকতাম যদি আমার নামটা দেখানো হয়। এই যে সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তখন মনে হয়, কোথাও একটা পৌঁছেছি হয়তো। পুরস্কার প্রাপ্তি নিশ্চয়ই সম্মানের কিন্তু মানুষের যে ভালবাসা পেয়েছি, সেটাই আমার কাজের স্বীকৃতি। আর সেটে আমি কুলি-কামিনের মতো কাজ করতে পারি। এতটুকু বসতে পারি না। (হাসি)
এতগুলো বছরে ইন্ডাস্ট্রির বদলটা কীভাবে দ্যাখেন?
মনুষ্যেত্বের ভাগ কমে গিয়েছে এখন ইন্ডাস্ট্রিতে। আগে যে একতা ছিল, সেটা আর নেই। আগে কিছু হলে সবাই দলবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করত এখন সেটা নেই। খারাপ লাগে। একতা থাকলে আরও উন্নতি হত।
কোনও অপূর্ণ ইচ্ছে?
কিছু পূরণ করার চেষ্টা করছি। আগে একা করতাম। কোভিডের পর প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন বন্ধু মিলে একটা ছোট এনজিও করেছি। বাচ্চাদের জন্য, গরিব মানুষদের জন্য আমরা নিজেদের পয়সায় কাজ করি। অভিনেতা, প্রযোজক সকলের থেকে সাহায্যও পাচ্ছি। নিজের একটা ছোট্ট স্টুডিও তৈরি করছি। বয়স হচ্ছে, একদিন সরে যেতে হবে।
আপনি তো লেখেনও ভাল। বই লেখার ইচ্ছে নেই?
আমার বই আর কে পড়বে! ওই গল্পটল্প লিখে রেখেছি। তবে একজন আমাকে নিয়ে লিখেওছেন। তাঁর ছবি বানানোর পরিকল্পনা আছে। (হাসি)