আধারের থেকে তথ্য নাকি চুরি করে আন্তর্জালের জালিয়াতরা গ্রামগঞ্জের ব্যাঙ্কের ছোট ছোট কিয়স্ক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে আমার-আপনার। বায়োমেট্রিক্স চলে যাচ্ছে তাদের হাতে। তাহলে উপায়? ঝটিতি অ্যাপে-ওয়াবসাইটে গিয়ে বায়োমেট্রিক্সে ঢুকে দেখা গেল, ছোট্ট একটা ‘টিক’ দিলেই ব্যাপারটা মিটবে। এটুকু আগে বললেই পারত! বাস্তবটা হল, বলেনি কেউ।
হঠাৎ করেই পকেট ফাঁকা! সে পুজোর আগে বউয়ের ইক্কতে, ছেলের কিটোতে, মেয়ের বিনুনিতে আর আপনার স্যান্ডো গেঞ্জিতে টাকা যাবে। সে তো গিয়েই থাকে। পরিবার-পরিজন– এই নিয়েই তো মধ্যবিত্তের টাকা-আনা-পাইয়ের গল্প। মা আসবে, দাম বাড়বে, এ তো থিওরিতেই রয়েছে। তার আগে যে এমন হট করে অ্যাকাউন্ট খালি হয়ে যাচ্ছে, তার কী হবে?
টাকা নিয়ে বাঙালি বরাবরই উদাসীন। কিন্তু অ্যাকাউন্টের টাকা কয়েক সেকেন্ডে ফাঁকা হয়ে যাওয়ার শোক তো প্রেমিকার বিয়ের বউভাত খাওয়ার মতোই বিস্বাদের। মানছি, ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’র মতো ক্যাচলাইন আউড়ে শোক কমানোর একটা ব্যবস্থা রয়েছে বটে ব্যর্থতার শাস্ত্রে, কিন্তু ব্যাপারটা এত ব্যাপক আকার নিয়েছে যে, তা দিয়ে মন শান্ত করা যাচ্ছে না। আসলে, সবই তো বিলিয়ে দিয়েছি। নাম, বাপের নাম, মাথা গোঁজার ঠিকানা, দশ সংখ্যার যোগাযোগ। সঙ্গে দিয়েছি চোখের মণি, দশ আঙুলের ছাপ। সবই তো নিয়েছে। জীবনের জটিল-কুটিল মাপজোক সব উজাড় করে দেওয়ার পর এই ছিল প্রতিদান!
কোনও এক বিকেলবেলায় যেভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যর্থ প্রেম হাঁটা দেয় বিয়ের ডেট জানিয়ে, সেভাবেই স্রেফ কলা দেখিয়ে আমার শরীরের ছাপ অন্য কেউ তুলে নিয়েছে। সেই বায়োমেট্রিক্সের চক্করে আমার অ্যাকাউন্টের টাকা পাখা মেলে হানিমুনে যাচ্ছে অন্য কারও সঙ্গে। মুরগি হওয়ার দুঃখ এক, আর মটকা গরম হওয়ার আরেক। আরে বাবা, লাইনে দাঁড় করিয়েছিলে, দাঁড়িয়েছি। একবার রেশন কার্ডের জন্য। একবার ভোটার কার্ডের জন্য। একবার আধার কার্ডের জন্য। লাইন মেরে মেরেই তো সময় পার। এছাড়া তো পাসপোর্ট, লাইসেন্স, জীবনের ট্রেন ‘বন্দে ভারত’-এর মতো গতিশীল না হোক, জীবন সেই কু-ঝিকঝিক লাইনের মতোই রয়ে গেল।
আধারের আঁধারে সব তথ্যই রয়েছে। সেই তথ্য নাকি চুরি করে আন্তর্জালের জালিয়াতরা গ্রামগঞ্জের ব্যাঙ্কের ছোট ছোট কিয়স্ক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে আমার-আপনার। বায়োমেট্রিক্স চলে যাচ্ছে তাদের হাতে। তাহলে উপায়? জানা গেল, আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক্স যেখানে রয়েছে, সেখানে ঢোকার রাস্তা আটকাতে হবে। ঝটিতি অ্যাপে-ওয়াবসাইটে গিয়ে বায়োমেট্রিক্সে ঢুকে দেখা গেল, ছোট্ট একটা ‘টিক’ দিলেই ব্যাপারটা মিটবে। সেটা দেওয়ার পরই মনে হল, এটুকু আগে বললেই পারত! কে বলবে? কেনই বা বলবে? বলা কি উচিত ছিল না? বাস্তবটা হল, বলেনি কেউ। কেউ মানে আধার করাতে জোর দিয়েছিল যারা, তারা। কই, একবারও বলে দেয়নি তো। অপশন তো রয়েছে বায়োমেট্রিক্সের গা-ঘেঁষেই। স্রেফ একটা ‘টিক’-এর দরকার। ইশ, আগে জানলে…
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রও নিজের চোখে দেখেননি। রাষ্ট্রও দেখে না। না দেখুক, শুনতে পাচ্ছে কি!
মানছি, যে কোনও ব্যবস্থাই একশো শতাংশ ফুল প্রুফ হতে পারে না। তা কথাটা শুনতে ভালো। কিন্তু ফুল না হোক, হাফ প্রুফও কি আশা করতে নেই? আর যদি সত্যিই বাসরঘরে সাপ ঢোকার মতো ফুটো থাকে, তাহলে সেটা আগে থেকে জানা থাকলে লাভ বই ক্ষতি তো নেই। না কি, কম্পিউটার জগতে ভাইরাস আর অ্যান্টি-ভাইরাসের মাঝে ধূসর জায়গার খেলার মতোই রহস্যজনক। জানা আছে, এমনটা হতে পারে। কিন্তু জানানোর ইচ্ছা নেই। তাহলে কুরু-পাণ্ডবের এই ইন্দ্রজালের লড়াইয়ে আমাদের হাতে থাকল শুধুই পেনসিল!
তা পেনসিলটাও ভালো করে চুষতে পারছি না। কারণ, বায়োমেট্রিক্স না হয় অফ করলাম। কিন্তু যেখানে যেখানে আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক্স লাগে, তার কী হবে? পাসপোর্ট, ভিসা, জমি-বাড়ি কেনাকাটা না হয় ছেড়েই দিলাম। রেশন তুলতে গেলে একবার বায়োমেট্রিক্স খোলো, একবার বন্ধ করো। এ-ও শোনা যাচ্ছে, আগেই আঙুলের ছাপ চুরি গিয়েছে। তাই অফ করেই বা কী হবে। তাহলে তো ডেটা সিকিওরিটির পিছনে যা যা ছিল সবাই প্রয়াত হয়েছেন। না না, কেউ দায়িত্ব নিক, এমনটা একেবারেই চাইছি না। মালের দায়িত্ব আরোহীর মতোই, টাকার দায়িত্ব নিজের নিজের। কিন্তু এত ভজকট সিস্টেম তো আমাদেরই কালঘাম ছোটাচ্ছে। তাহলে গ্রামে-গঞ্জে, অল্পশিক্ষিত বা না-শিক্ষিত মানুষের তো ভাঁড়ে মা ভবানী। কে করে দেবে বায়োমেট্রিক্স লক আর কেই-বা তা খোলার জন্য মুখিয়ে থাকবে?
তবে নিজেরাও তো আর কম খলিফা নই। এতদিন ধরে যত্রতত্র আধার কার্ড ভিজিটিং কার্ডের মতোই বিলিয়ে এসেছি। আধারের শেষ চারটে সংখ্যা দিলেই হত, কিন্তু সবটাই দিয়েছি। যিনি চাইছেন, তিনিও জানেন না কেন চাইছেন। আমি দিচ্ছি, আমিও জানি না কেন দিচ্ছি। কোনও দরকার ছিল না ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধারের লিঙ্ক করানোর, যদি না আধার এনাবেল্ড পেমেন্ট সিস্টেম আমার কাজে লাগে। তা সত্ত্বেও করেছি। না জেনেই। তাই তথ্য বেহাত হয়ে গিয়েছে বলে এখন আর বাজার গরম করে লাভ কী।
তাহলে নেড়া এবার বেলতলায় গিয়েছে, আর যাবে না। অন্তত প্রবাদে তো তা-ই বলে। নেড়া একবারই যায়। কিন্তু তা তো মনে হচ্ছে না। আবার কোনও না কোনও না জানা বা না জানানোর ফাঁক গলে ফের টাকা লোপাটের আয়োজন হবে না তো? এই রে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে না কি? এক্কেবারে যেন না বাড়ে। আরে, লক্ষ্মী তো চঞ্চলা। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। মানে আজ আপনার অ্যাকাউন্টে, তো কাল অন্য অ্যাকাউন্টে। বড় মানুষের কথামতো টাকা না হয় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু পরের লাইনে মানুষ ধরার কথা। যে মাল নিয়ে পগার পার হল, তাকে ধরব কী করে? টাকার মায়ায় যে সাইবার ফ্রডের ছায়া পড়ছে, সেই কায়া অবিনশ্বর হতেই থাকবে, ‘দেখ বাবাজি, দেখবি নাকি দেখরে খেলা দেখ চালাকি, ভোজের বাজি ভেলকি ফাঁকি পড় পড় পড় পড়বি পাখি-ধপ্…’