মহাকুম্ভে মোনালিসারা সহজলভ্য। হাতের নাগালের মধ্যে, মেলার মাটিতে বসে মালা বিক্রি করছে সে। আমাদের শহর কলকাতারই রক্ষণশীল পরিবারে এখনও কান পাতলে স্পষ্ট শোনা যায়, ‘অমন ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে– অত রাতে রাতে বাইরে থাকা কেন বাপু?’ ২০২১-এর NCRB (National Crime Records Bureau)-র রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে দৈনিক ধর্ষণ সংখ্যা ৮৬; এবং এটা শুধুমাত্রই সরকারি হিসেবে। ফলে এই দেশে ‘সুন্দরী’ তকমা পাওয়া আহ্লাদের চেয়ে ভয়ের বেশি। দীপিকা পাডুকোনের সৌন্দর্য সুরক্ষিত, কারণ তার পাশে দেহরক্ষক থাকে। অথচ মহাকুম্ভের কোটি মানুষের সমারোহে, মোনালিসার সৌন্দর্য মানুষ খাবলে নিতে চায়; কারণ তা বর্মহীন, অসুরক্ষিত।
লিওনার্দোর মোনালিসাকে নিয়ে মানুষের উন্মাদনা ইতিহাস খ্যাত। ১৫০০ শতকের সেই হাসি সযত্নে সুরক্ষিত ল্যুভর জাদুঘরের দেওয়ালে। এদিকে ২০২৫-এর ভারতে, এবারের মহাকুম্ভ মেলায় রাতারাতি শোরগোল ফেলে দিলেন অন্য মোনালিসা, জ্যান্ত মোনালিসা। ইন্দোর থেকে বাপ-ভাই-দিদার সঙ্গে মহাকুম্ভে রুদ্রাক্ষের মালা বিক্রি করতে আসা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে মোনালিসা।
এখন প্রতিটা মানুষের হাতে স্মার্টফোন, যার ক্যামেরার শাটার কোনও গণ্ডি মানে না। ফুল, পাহাড়, প্রকৃতি, পোর্ট্রেটের মায়া কাটিয়ে– রাজপথে কুপিয়ে খুন, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনার পরবর্তী অসহায় শরীরের পড়ে থাকা অবধি তার অবাধ বিচরণ– অনেকটা ঠিক লোকনাথ বাবার মতো।
এইরকমই গোপনীয়তার সীমা না-মানা এক লেন্সে বন্দি হল মহাকুম্ভের মোনালিসার মুখ, ছড়িয়ে গেল ইনস্টাগ্রামে। এখন বিস্ফোরণের সহজ নাম ‘ভাইরাল’। রাতারাতি ভাইরাল হলেন তরুণী, নিম্নবিত্ত পরিবারের ষোড়শী কন্যার শ্যামবরণ চেহারায়, কটা চোখের রূপটানে উদ্বেল গোটা দেশ, দেশের সব সমাজমাধ্যমে মোনালিসার রূপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছবি-ভিডিও-রিল।
মহাকুম্ভে যোগ দেওয়া কোটি কোটি পুণ্যার্থী আবেগে ধেয়ে যাচ্ছে, মালা কেনার নামে মোনালিসার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চেয়ে। এরপর তারা আসে ছবির বিনিময়ে মালা কিনবে, এই শর্ত নিয়ে। তবুও তো বিক্রি হবে– রুটিরুজির চিন্তায় তাও মেনে নিয়েছিল মোনালিসা। কিন্তু অচিরেই দেখা যায়, মালা কেনারও আর প্রয়োজন বোধ করছে না মানুষ। অসময়ে, ব্যক্তিগত তাঁবুতে এসে দাবি করছে মোনালিসার বাবা নাকি সম্মতি দিয়ে তাদের পাঠিয়েছে মেয়ের সঙ্গে ছবি তোলার জন্যেই। বাধা দিতে গেলে মার খাচ্ছে তরুণীর ভাই। এরপর দেখা গেল, সহজলভ্য মোনালিসাকে নিজের ইন্সটাগ্রামের প্রোফাইলে বন্দি করাতে বাধাপ্রাপ্ত পুণ্যার্থীর দল মোনালিসার হাত ধরে, জামা ধরে টানছে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
অতএব রোজগারের চিন্তা শিকেয় তুলে, মুখোশে মুখ, আর জ্যাকেটে শরীর ঢেকে, পুলিশের পাহারায় বাড়ি ফিরতে হল ইন্দোরের মোনালিসাকে। মহাকুম্ভ সামাল দেওয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সৌন্দর্যের জন্য ভাইরাল হয়েও, সেই জনপ্রিয়তাই মেয়েটিকে বাধ্য করল রুজির পথ ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে। শুধু তাকে ভালো লেগেছিল পুণ্য করতে আসা মানুষদের। আমাদের দেশের ভালো লাগার অপর নাম গোপনীয়তা না মানা, অসম্মান, টানাটানি, ছুঁতে চাওয়া, সম্মতি না চাওয়া, ভোগ করা, গিলে খাওয়া।
কারণ, এই মোনালিসা সহজলভ্য। হাতের নাগালের মধ্যে, মেলার মাটিতে বসে মালা বিক্রি করছে সে।
আমাদের শহর কলকাতারই রক্ষণশীল পরিবারে এখনও কান পাতলে স্পষ্ট শোনা যায়, ‘অমন ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে– অত রাতে রাতে বাইরে থাকা কেন বাপু?’ ২০২১-এর NCRB (National Crime Records Bureau)-র রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে দৈনিক ধর্ষণ সংখ্যা ৮৬; এবং এটা শুধুমাত্রই সরকারি হিসেবে। ফলে এই দেশে ‘সুন্দরী’ তকমা পাওয়া আহ্লাদের চেয়ে ভয়ের বেশি। দীপিকা পাডুকোনের সৌন্দর্য সুরক্ষিত, কারণ তার পাশে দেহরক্ষক থাকে। অথচ মহাকুম্ভের কোটি মানুষের সমারোহে, মোনালিসার সৌন্দর্য মানুষ খাবলে নিতে চায়; কারণ তা বর্মহীন, অসুরক্ষিত। যেন সমাজের এই শ্রেণির মধ্যে এরকম রূপ বিস্ময়। আসলে শ্রেণি বোধটাও আমাদের এতটা অন্তর্বর্তী বঁড়শি, যে নিম্নবিত্ত, অপুষ্টির মধ্যে আমরা সুন্দরকে খুঁজি না। বরং এখানে সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া মানে সহজেই তাকে ছুঁয়ে-খাবলে-ছিঁড়ে আশ মিটিয়ে নেওয়া যায়। কারণ মোনালিসার শ্রেণিচরিত্র এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে, যেভাবে প্রান্তিক কোনও মেয়ের ধর্ষণের কথা খবরের কাগজে ধরা পড়ে না। শহরের রাস্তায় প্রতিবাদ হয় না। গরিব ঘরের মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, পিতৃতান্ত্রিকতা তাও শিখিয়েছে।
এই দুঃসাহস কোনও একজন পুরুষ মানুষের নয়; হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পুরুষের মনন– যা সমাজমাধ্যমের বিপুল, অগণিত প্রোফাইলে মেয়েটির ছবি শেয়ার হওয়ার ফলে মোনালিসাকে জনগণের সম্পত্তি হিসেবে ন্যায্য করে ফেলেছে। ফলে তরুণীর দেহ এখানে পৌরুষের শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণ ফলানোর একটা ক্ষেত্র মাত্র। ইতিহাস জুড়ে, নারীর দেহ পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্মীয়, আইনি এবং সামাজিক নিয়ম দ্বারাই। কাজেই একজন নগ্ন নারীও শিল্প গ্যালারিতে সম্মানজনক হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে যে নারী মেলায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ১০০০ জনের সঙ্গে ছবি তুলছে, তাকে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত মনে করাই যায়, তাই না? সেই নারীশরীরে যথেচ্ছ টানা-হ্যাঁচড়া করা যায়, কারণ হাজার হাজার মানুষকে নিজের সঙ্গে ছবি তোলার সম্মতি দিয়েছে যে নারী, সে নিজের শরীরের ওপরও অধিকার হারিয়েছে।
মোনালিসার ক্ষেত্রে, তার ভাইরাল হওয়াই, তার ওপর হওয়া এই আক্রমণের ন্যায্যতার সিলমোহর। এর থেকেই বোঝা যায়, ‘সম্মতি’ কথাটার অর্থ কতটা অজানা আমাদের দেশের মানুষের কাছে। তাকে ব্যকরণের অন্তর্গত করে তোলার জন্য অনেক অনেক পথ আমাদের হাঁটা বাকি; অথবা আমরা কেবল উল্টোদিকেই হাঁটছি।
মোনালিসার, মেয়েটির অস্তিত্ব বা পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। এইখানে মনে করা যাক ২০২৪-এর, উত্তরপ্রদেশের বোর্ড পরীক্ষার, শ্রেষ্ঠ ফল করা ছাত্রী প্রাচী নিগমের কথা। ৯৮%-এরও বেশি নম্বর পেয়ে শিরোনামে আসা সীতাপুরের মেয়েটি রাতারাতি সমাজমাধ্যমে খ্যাতি পেল, তার মেধার জন্যে নয়; তার মুখমণ্ডলীতে অযাচিত কেশরাজির জন্য। আবারও, সোশ্যাল মিডিয়ার সমবেত ট্রোলিং নিমেষের মধ্যে মেয়েটির পরীক্ষার সাফল্য, তার মেধাকে নস্যাৎ করে দিয়ে জাগিয়ে রাখল তার মুখ, তার ছবি নিয়ে করা অজস্র আক্রমণের মন্তব্যকে| থেকে গেল A.I নির্মিত ‘কী হতে পারিত’ ছবি সব। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, অর্জিত বলে নারীর কিছুই থাকছে না আর; দৈহিক সৌন্দর্যই নির্ধারণ করে দিচ্ছে তার খ্যাতি, তার সম্মান, এমনকী তার অস্তিত্বও। চেহারাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে নারীর একমাত্র পরিচয়।
অথচ, গুগলেই খুঁজে দেখুন ‘ডলি চাওয়ালা’-কে। দেখবেন ধন-ধান্য কমেন্টে মোড়া একজন পুরুষ চা বিক্রেতা, গলায় সোনার হার পরে নামছে ল্যাম্বরঘিনি থেকে, উঠে পড়ছে বিজনেস ক্লাস প্লেনে, ছবি তুলছে বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে। তার জীবনের অর্জিত পুঁজি– তার দোকানে বিল গেটস একবার চা খেয়েছিলেন তৎকালীন ভারত সফরে, এবং তার মেধা বলতে তার হাওয়ায় হাত-পা উড়িয়ে উড়িয়ে চা বানানোর কায়দাটুকু। লক্ষণীয় যে, এই ছবি বা পোস্টের নীচে কিন্তু আক্রমণ, তার চুল-চেহারা নিয়ে বিশ্লেষণ, ট্রোলিং কোনওটাই নেই। চা খেতে এসে কেউ তার হাত ধরে টেনে তার শরীরে হাত দেয়নি। ফলে তাকে ফিরে যেতে হয়নি শহর ছেড়ে নিজের গ্রামে চা বিক্রি করতে, বরং তার এই সোশ্যাল মিডিয়া খ্যাতি তাকে পৌঁছে দিয়েছে বিভিন্ন আলোকিত মঞ্চে– মসৃণ করেছে তার উপার্জনের সিঁড়ি।
পুরুষের মান তার সৌন্দর্যে নয়, সুন্দর কেবলমাত্র নারীর মূল্যায়নের মুদ্রা। সেখানে তার ক্ষমতায়, মেধায় অর্জিত বাকি সমস্ত কিছু মূল্যহীন। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘চিত্রাঙ্গদা’ লিখলেন, তিনি কিন্তু আখ্যানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজকুমারীর সমস্ত সংলাপ দিয়েছিলেন শুধু চিত্রাঙ্গদাকেই। তার চিত্রনাট্যে কোথাও সুরূপা-কুরূপার আলাদা উল্লেখ নেই। এই একই শরীরে দুই চরিত্রের নির্মাণও রাজকুমারীর অস্তিত্ব মূল্যায়নের স্বার্থে, সমাজের করে দেওয়া, শ্রোতাদের করে নেওয়া। যে রাজকুমারী (কুরূপা) শস্ত্র বিদ্যায় তুখোড়, শিকারে দুর্দান্ত, সামনের সারিতে যুদ্ধ করে পরাহত করেন শত্রুদের; বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রেম। তার পুরুষালি বেশভূষার জন্য তাকে পরিহাস করে, ‘অবোধ বালক’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। অথচ এই চিত্রাঙ্গদাই অর্জুনের ধ্যান-জ্ঞ্যান-চিন্তামণি হয়ে উঠলেন; মদনের বরে যথেষ্ট রমণীয়, তথা যথেষ্ট নারী হয়ে ওঠার পর (সুরূপা)।
এখানে রূপেরও ‘কু’ ও ‘সু’ স্থির হল বীরপুরুষ অর্জুনের গ্রহণের নিরিখে। একইভাবে আমরা দেখেছি, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর রাহুল, বেস্টফ্রেন্ড অঞ্জলিকে ফিরিয়ে দিয়ে প্রেমিকা হিসেবে বেছে নিচ্ছে ‘রমণীয় এবং নারীসুলভ’ টিনাকে; আবার ভাগ্যের জোরে টিনার অকাল মৃত্যুর পর, এই অঞ্জলিকেই প্রেম নিবেদন করছে সে যখন শিফন শাড়ি পরে হয়ে উঠল যথেষ্ট নারী।
যে দেশের পুরাণ থেকে সমকালীন সাহিত্য বা সিনেমা, সর্বত্রই এই বিষম লিঙ্গ বৈষম্য, নারী অস্তিত্বের বিপন্নতা– সেখানে মোনালিসারা মিউজিয়াম বা চার দেওয়ালের মধ্যেই থেকে যাবে চিরকাল। শুধু চেষ্টা করে যেতে হবে নিজের অস্তিত্ব স্থাপনের লড়াইটা জারি রাখতে। এ লড়াই নিজের জন্য, আগামীর জন্য।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..