সংসদে পাশ হয়ে গিয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল। যা নিশ্চিত করছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে ৩৩ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে মেয়েদের। প্রশ্ন জাগে, যে বিলের সমগ্র কৃতিত্বই দাবি করতে চাইছে মোদি সরকার, সেই বিল বাস্তবায়িত হলেও কি সহনেত্রীদের প্রতি কটূক্তি, অশালীন ভাষা প্রয়োগ করে চলবেন বিজেপির নেতৃবর্গ? একদিকে মহিলা সংরক্ষণ বিল, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিসরে নেত্রীদের প্রতি ক্রমাগত স্লাট-শেমিং। আর সেই অসংগতিই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে, সংরক্ষণ উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু মহিলারা ফের নতুন করে ভোটযুদ্ধের বোড়ে হয়ে উঠছেন না তো!
সদ্য সহ-সাংসদ দানিশ আলিকে ধর্ম তুলে কটূক্তি করেছেন বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরি। তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ঘৃণাভাষণ, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা, ইসলামোফোবিয়া– কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে বাগে পেয়ে যাবতীয় তির ছুড়ে দিচ্ছে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলো। নতুন সংসদ ভবনের পরিস্থিতিটা যখন এইরকম, তখন পুরনো সংসদ ভবনে ফেলে আসা ইতিহাস খানিক ঘেঁটে দেখা গেল, রমেশের এহেন কীর্তি নতুন নয় মোটেও। তার মধ্যে অন্তত দু’টি ঘটনা এমন পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে তাঁর নিশানায় ছিলেন মহিলা সাংসদরা। ২০১৫ সালে, মহিলাদের প্রতি অসম্মান এবং যৌন অবমাননাসূচক মন্তব্যের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে তৎকালীন স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের কাছে অভিযোগ জানান পাঁচ নেত্রী– এনসিপি নেত্রী সুপ্রিয়া সুলে, কংগ্রেসের রঞ্জিত রঞ্জন ও সুস্মিতা দেব (সেই সময়ে কংগ্রেস সাংসদ), তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষ এবং বাম নেত্রী পিকে শ্রীমতী টিচার। কিন্তু তাতে কী? ২০১৭ সালে অবৈধ সন্তানের প্রসঙ্গ তুলে ফের সোনিয়া গান্ধীর দিকে ধেয়ে আসে রমেশের মন্তব্য। সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য অবশ্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্রনারায়ণ সিং কংগ্রেস সভানেত্রীকে ‘ইতালীয় নর্তকী’ বলতে ছাড়েননি। যেটা বলার তা হল, এত কিছুর পরেও স্বমহিমায় দলে রয়ে গিয়েছেন রমেশ, এমনকী, এবার মন্ত্রীসভায় রদবদলের আবহে তাঁর নামও শাসক দলের বিবেচনায় ছিল। আর এ কথা মনে করে নেওয়ার পরই বলা যাক, এই ঘটনার আগের দিনই ওই সংসদেই পাশ হয়ে গিয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল। যা নিশ্চিত করছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে ৩৩ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে মেয়েদের। অর্থাৎ হিসেবমতো রমেশদের পাশে এসে বসতে চলেছেন আরও বেশি সংখ্যক নারী সাংসদ। প্রশ্ন জাগে, যে বিলের সমগ্র কৃতিত্বই দাবি করতে চাইছে মোদি সরকার, সেই বিল বাস্তবায়িত হলেও কি সহনেত্রীদের প্রতি এ জাতীয় ভাষাই প্রয়োগ করে চলবেন বিজেপির নেতৃবর্গ? একদিকে মহিলা সংরক্ষণ বিল, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিসরে নেত্রীদের প্রতি ক্রমাগত স্লাট-শেমিং, এই দুইয়ের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান। আর সেই অসংগতিই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে, সংরক্ষণ তো উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু মহিলারা ফের নতুন করে ভোটযুদ্ধের বোড়ে হয়ে উঠছেন না তো!
সত্যি বলতে, মোদি যতই নিজেকে ঈশ্বরের বরপুত্র দাবি করে বরাভয় মুদ্রায় মহিলা সংরক্ষণ বিলটি ঝুলিয়ে রাখুন না কেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ১৯৮৯ সালেই রাজীব গান্ধী সরকার পঞ্চায়েত ও পুরসভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করার বিল এনেছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সরকারের আমলে এই বিল আনার চেষ্টা করা হলেও কখনওই তা সফল হয়নি। সেই যে মল্লিকা সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে মেয়েরা কখনও রাজা হয়নি। প্রজাও হয়নি। হয়েছে রাজার বউ আর প্রজার বউ।’ সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে বলেই বোধহয়, মহিলাদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ মেনে নিতে বরাবরই অস্বস্তিতে পড়েছে এ দেশ। তা সত্ত্বেও কিন্তু একজন জয়ললিতা, একজন সুষমা স্বরাজ, একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, একজন মায়াবতী ধূমকেতুর মতোই ভারতের রাজনৈতিক আকাশে উঠে এসেছেন। অর্থাৎ সংরক্ষণের সুবিধা ছাড়াই এ দেশ একাধিক উল্লেখযোগ্য নেত্রীকে পেয়েছে, পেয়েছে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রীকেও। তবুও যে আকস্মিকভাবে মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ এবং পাশ হয়ে গেল, তার নেপথ্যে ঠিক কোন ধরনের তাগিদ কাজ করছিল? যে বিল এত দীর্ঘসূত্রী, এত বিতর্কিত, তা নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কীসের? বিশেষ করে যেখানে খোদ সরকার পক্ষই জানিয়ে দিচ্ছেন যে এই দশকের শেষে পৌঁছে হয়তো বিলের প্রয়োগ সম্ভব হবে, যেহেতু জনগণনার কাজ শেষ না হলে বিলটিকে বাস্তবায়িত করা যাবে না। যদিও সোনিয়া বলছেন, বিল রূপায়ণে দেরি হলে মহিলাদের প্রতি অন্যায় করা হবে, রাহুল অবিলম্বে এই সংরক্ষণ চালু করার পক্ষে সওয়াল করছেন, মহুয়া মৈত্র বলছেন যে, গোসংরক্ষণের জন্য যদি গরু শুমারি দরকার না হয়ে থাকে, তবে এই ক্ষেত্রেও আদমশুমারির জন্য অপেক্ষা না করে এখনই সরকারি নীতি হিসাবে সংরক্ষণ চালু করে দেওয়া হোক। কিন্তু লাগাতার বিরোধী বক্তব্যের সামনেও কানে তুলো আর মুখে কুলুপ আঁটার অভ্যাস বিজেপির আছেই, এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। যদি এত বছর অপেক্ষাই করতে হয়, তাহলে কি চব্বিশের নির্বাচনে মহিলা ভোট টানার লক্ষ্যেই এই অস্বাভাবিক দ্রুততা? এই বিলকে হাতিয়ার করে মোদি-সহ বিজেপির জোরদার আত্ম-আস্ফালন দেখলে তেমন সন্দেহ উঠতেই পারে। ঠিক যেভাবে কিছুদিন আগেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রসঙ্গে মুসলিম মহিলাদের আস্থা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছিলেন মোদি, কিংবা ঘরোয়া গ্যাসের দামে একঝটকায় কমিয়ে দিয়েছিলেন ২০০ টাকা ভরতুকি দিয়ে, সেই সবের লক্ষ্য তো আসলে একটাই। গদি দখলের টানাপোড়েনে মহিলা ভোটারদের সিদ্ধান্তও যে গেমচেঞ্জার হতে পারে, সে কথা এতদিনে বুঝে নিয়েছে বিজেপি।
প্রয়োজনমতো সনাতনী নারীর পক্ষে সওয়াল চালালেও বর্তমানে বিজেপির কেন্দ্রীয় মহিলা নীতি অনেকটা লেনদেনের উপরেও চলছে। আর সেই দেওয়ার হিসেবেই থাকছে মহিলাদের সামনে কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধার তাস বিছিয়ে দেওয়া। ভোটের লড়াইয়ে তাস বিছানো নতুন কথা নয়। কিন্তু অনগ্রসর মহিলাদের সংরক্ষণ ঠিক কী হিসাবে হবে, সেই বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে, বিল কবে চালু হবে তার কোনও নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি না দিয়েই, বিরোধী বিতর্কের অবকাশ মাত্রকে সমূলে বিনাশ করে যেভাবে এই গুরুতর বিলটিকে পাশ করানো হল; তা গণতন্ত্রের উদযাপনের বদলে কোথাও গিয়ে গণতন্ত্রের পৃথক স্বর লোপের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে গোড়ার কথাটিই আরেকবার মনে করে নেওয়া যাক। বিরোধী নেত্রীদের কণ্ঠরোধ করতে চেয়ে বারে বারেই তাঁদের চরিত্রহননের পথটিকেই সহজ বলে মনে করেছেন বিজেপি নেতারা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে যেমন দিল্লির আপ নেত্রী অতীশী মার্লেনা অভিযোগ করেছিলেন, বিজেপি প্রার্থী গৌতম গম্ভীর তাঁর বিরুদ্ধে যৌন কুৎসা-সংবলিত লিফলেট বিলি করছেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা সেই লিফলেটে জ্বলজ্বল করছিল ‘প্রস্টিটিউট’ শব্দটি। আবার প্রধানমন্ত্রীর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি নিয়ে বিরোধীদের রসিকতার পালটা দিতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুৎসিত ইঙ্গিত করেছিলেন বিজেপির রাজ বব্বর। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ‘স্কার্টওয়ালিবাই’ বলাও এঁদের কাছে জলভাত। কিন্তু এই মুদ্রাদোষ কি কেবল একটিমাত্র সংসদীয় দলেরই? প্রধানমন্ত্রী রাফাল অভিযোগের উত্তর এড়াতে সংসদে আসছেন না, ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর পৌত্র রাহুল বলে বসলেন, ‘ছাপান্ন ইঞ্চি চওড়া বুকের প্রধানমন্ত্রী এক মহিলার পিছনে লুকিয়ে পড়েছেন’। মহিলাটি এখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, নির্মলা সীতারমন। প্রিয়াঙ্কার অপমানের জবাব দিতে গিয়ে কংগ্রেস বিজেপিকে পালটা খোঁচা দিল, ‘হেমা মালিনী ছাড়া তো ওদের দলে কোনও সুন্দরী নেই, তাই প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে ওদের ঈর্ষা।’কোনও মহিলার রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়িয়ে তাঁকে যেন সম্পত্তি বলেই গণ্য করে দল, এহেন বক্তব্যে কি সেই আভাসই মেলে না? আর সেই কর্তৃত্ব জারি থাকে বলেই তো অতীশীকেও নিজের স্বনির্বাচিত মার্লেনা (মার্ক্স ও লেনিন-এর সংমিশ্রণে তৈরি শব্দ) পদবি ছেড়ে দলের নির্দেশে বাবার পদবিতে ফিরতে হয়। ভারতীয় রাজনীতি এখনও যে পিতৃতন্ত্রের ভাষায় কথা বলে, যে নারীবিদ্বেষের ভাষা জনতার বড় অংশের মগজও অধিকার করে আছে, সেই রাজনৈতিক পরিসরে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ কি আদৌ মহিলাদের ক্ষমতায়নের স্বাদ এনে দেবে? নাকি কোনও নারী প্রার্থীকে শিখণ্ডী করে আসলে বিরোধী ভোট কাটার হাতিয়ার, কিংবা তাঁর বকলমে হোমরাচোমরা নেতার ক্ষমতা দখলের অস্ত্র হয়ে উঠবে এই সংরক্ষিত আসন? মহিলা সংরক্ষণ বিল শেষ পর্যন্ত নারীকে অর্ধেক আকাশের অধিকার দেবে, না তার জন্য পিতৃতন্ত্রের বরাদ্দ করা টোপ মাত্র হয়েই থেকে যাবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।