যে কোনও মুক্তি সংগ্রামেই বিরোধিতার রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে আগামী গড়ার স্বপ্নটাকেও একই সঙ্গে বুকে নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে যেতে হয়, ভগৎ সিং সেটা বুঝিয়েছিলেন। সেই জন্যই আজ গেরুয়া বাহিনী শত চেষ্টাতেও ভগৎ সিংকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসাৎ করতে পারে না।
ইতিহাস বইয়ের পাতায় এক কোণে একটা ছবি। ছোট্ট করে লেখা তিন তরুণের কথা। ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব। ২২-২৩ বছরেই যারা মুক্তি সংগ্রামে ফাঁসিকাঠ বরণ করেছিল। ইতিহাস বইয়ে যত পাতা জুড়ে ছিল গান্ধী, নেহরুর কথা, তিলকের কথা, ততটাই কম জায়গা জুড়ে ছিল এই তরুণ মুখ। মাথায় সাহেবি টুপি, চোখে আগুন। তবু ওইটুকু অংশেই যেন গান্ধী, নেহরুদের কয়েক গোল দিয়ে হিরো হয়ে উঠেছিল সেই আগুন তরুণ। একরোখা, আপসহীন ভাবে যিনি দাবি করেছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার। বলে গেছিলেন, কালাদের শোনাতে মাঝে মাঝে বিস্ফোরণ দরকার হয়।
আমরা যারা নয়ের দশকে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে ‘নেতাজি ফিরবেন’ দেখে বড় হয়েছি, তাদের অনেকেরই ইতিহাস বইয়ের ওই ছোট্ট অংশের পর ভগৎ সিং-এর সঙ্গে আরও ভালো করে পরিচয় হয় রুপোলি পর্দায়। ২০০২-এ। গুজরাত গণহত্যায় ধুঁকতে থাকা দেশে তখন টিভি স্ক্রিন জুড়ে দুই জোড়া ভগৎ সিং। অজয় দেবগন ও ববি দেওলের বেশে। ইতিহাস বইয়ের ছোট্ট অংশে না পাওয়া গল্প নিয়েই ‘লেজেন্ড অফ ভগৎ সিং’ যেন বা সেই সাহেবি টুপি আগুন চোখা ছেলেটিকেই রক্ত-মাংসের রূপ দিল। কমরেডের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার আবেগ, ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দেওয়ার উত্তেজনা, শত অত্যাচারেও অবিচল থাকা, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন রুখে দিয়ে ইনকিলাবের কথা বলা– টানটান রোমহর্ষক গল্প। পাড়াপড়শির ‘বার খেয়ে ক্ষুদিরাম’ না হওয়ার হাসিঠাট্টা, নিষেধাজ্ঞা ছাপিয়ে মন জুড়ে থাকল ভগৎ সিং-এর ইংরেজদের ভরা আদালতে মুষ্টিবদ্ধ হাতে ইনকিলাবের ডাক। জানান দিল, শুধু ক্ষমতার হাত বদল নয়, স্বাধীনতা তবেই, যবে এই দেশের শ্রমিক-কৃষকের সরকার হবে। সেই বয়সে সেই আগুন বাণী, সেই স্পর্ধাই ঢেউ খেলাত স্কুলে, পাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে ভগৎ সিং বনাম গান্ধী, সত্যাগ্রহ বনাম বিপ্লবী তর্কে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আইরিশ মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে কেন লোচের ছবি ‘‘Wind that shakes the barley’s’’-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য আছে, যেখানে ছবির মূল চরিত্র এক আইরিশ বিপ্লবী জেলে বসে মৃত্যু বরণ করার আগে তার প্রেমিকাকে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘‘It’s easy to know what you are against, but quite another to know what you are for.’’ যে কোনও মুক্তি সংগ্রামেই বিরোধিতার রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে আগামী গড়ার স্বপ্নটাকেও একই সঙ্গে বুকে নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে যেতে হয়, ভগৎ সিং সেটা বুঝিয়েছিলেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বয়স পেরতে অবশ্য ভগৎ সিং-এর সঙ্গে আরও আলাপ হয় ‘Why I am an Athiest’ লেখায়। বড় হতে হতে চারপাশের সমাজের বৈষম্যগুলো ঠেকে চিনতে থাকার সময়ে, যখন বারবার নানা ভাবে এই সমাজ, পরিবার বুঝিয়ে দিত মেয়ে হয়ে জন্মানোর কথা, তখন সেই সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক নিয়মকে প্রশ্ন করতে সাহস জোগাত, সেই সন্তর্পণে যত্নে সাজানো যুক্তি, যা বারবার বলে গেছে প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে, অযৌক্তিক সমস্ত ধ্যান ধারণাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। স্রেফ আগুন ঝড়া বাণী নয়, বজ্র কঠিন শপথ নয়, ইহ জগৎ বা পরজগতে পুরস্কৃত হওয়ার আশায় নয়, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের আদর্শে জীবন উৎসর্গ করার প্রত্যয় যে কতটা কঠিন, কতটা অনুশীলনের ফসল, তা অকপটে স্বীকার করেছিল। গণেশকে দুধ খাওয়ানোর অন্ধ উন্মাদনার কালে, বাবরি পরবর্তী দ্রুত বদলাতে থাকা দমবন্ধ হতে থাকা পরিবেশে এক দমকা মুক্ত বাতাস এনেছিল সেই বয়ান। সুদূর মঞ্চে থাকা নেতা বা রুপোলি পর্দার লার্জার দ্যান লাইফ হিরো নয়, সেই লেখায় তাঁকে মনে হয়েছিল আশপাশে বেড়ে ওঠা, হয়ে ওঠা নিজেদের মতোই সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয়, সংকোচ নিয়েও প্রতিনিয়ত সেই সমস্ত কিছুর সঙ্গে যুঝে মতাদর্শে সৎ থাকার চেষ্টা করে যাওয়া এক তরুণ।
২০০৬-এর বাংলার উত্তাল রাজনীতিতে আমাদের যে প্রজন্মের রাজনীতিকরণ হয়, ‘Rang de basanti’-র চেয়েও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের লড়াইয়ের জোয়ার নতুন করে বুঝিয়ে দেয় ‘state of war does exist and shall exist so long as the Indian toiling masses and the natural resources are being exploited by a handful of parasites’. অবশ্য রাজনীতি চিনতে-বুঝতে শেখার পর একইভাবে চোখে পড়তে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতার হারিয়ে যাওয়া অন্য টুকরোগুলো। যে টুকরো জুড়ে থাকার কথা প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, লীলা রায় (নাগ), কনকলতা বড়ুয়া, ননীবালা, দুকড়িবালা, ফুলো, ঝানো, মাতঙ্গিনী, দুর্গাবতী দেবীদের, আরও অনেক নাম না-জানা মেয়েদের রোমহর্ষক সব গল্প। সেই না থাকা পাতাগুলোর জায়গায় যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকে প্রীতিলতার মাস্টারদাকে করা সেই প্রশ্ন, ‘যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারব না’। প্রশ্ন করতে শেখায় ‘ওরা ভগৎ সিং-এর ভাই, ক্ষুদিরামের ভাই’-দের মুক্তির গানে আজও কেন প্রীতিলতার বোন, দুর্গা ভাবির বন্ধুরা ঠাঁই পায় না? যে মেয়েটা ২১ বছরে ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার নেতৃত্ব দিয়ে শহিদ হয়েছিল মেয়েদের লড়াইকে দৃশ্যত করতে, সেই আকাশে ঝড় জাগানো মেয়েদের বিপ্লবে সমান অংশীদারিত্ব স্বীকৃত হতে আরও কত প্রীতিলতাকে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ শানাতে হবে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: এই একটা লোকের মূর্তি আর কদ্দিন ধরে ভাঙবে ওরা?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এক কমরেডের থেকেই খুঁজে পাই ভগৎ সিং-এর শুকদেবকে লেখা চিঠি। যত্ন করে বন্ধুকে জানাচ্ছেন প্রেম নিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা। সেই রুপোলি পর্দা কাঁপানো ব্লকবাস্টার ভগৎ সিং, নাস্তিকতার পক্ষে তীক্ষ্ণ যুক্তি শানানো ভগৎ সিং, হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের কর্মীদের সংগঠিত করা ভগৎ সিং, দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান তোলা ভগৎ সিং, শাসকের আদালতে বোমা ফেলে গ্রেপ্তার বরণ করে সেই আদালতকেই নিজের রাজনীতি প্রচার করার মঞ্চ করে নেওয়া ভগৎ সিং, জেলে রাজনৈতিক বন্দির অধিকারের দাবিতে অনড় ভগৎ সিং– এই নানা সময়ে নানা ভাবে চেনা সেই কমরেডের আরেক দিক উন্মোচন করে সেই চিঠি। বন্ধুর কাছে অকপটভাবে যে মেনে নেয় ভালোবাসা মানুষের চরিত্রের উত্তরায়ণ ঘটায়। শুধু যুক্তি নয়, বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন আবেগের, ভালোবাসার। এক অন্য পৃথিবীর ছবি আঁকে সেই চিঠি, যে পৃথিবীতে ভালোবাসা শুধু দুই মানুষের প্রণয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না, শুধু কোনও এক ব্যক্তির প্রতি আবেগে সংকীর্ণ থাকবে না, বরং আর্য সমাজের নৈতিকতাকে ছুড়ে ফেলে এই সমাজকে নতুন তারে বাঁধবে, আমূল বদলে দেবে বন্ধুত্বের, প্রেমের রাজনীতিতে। ভগৎ সিং-এর এই চিঠি মনে করিয়ে দেয় আরেক দেশের আরেক বিপ্লবী কমরেডের লেখা। দুনিয়া কাঁপানো স্বপ্নের সোভিয়েতের বলশেভিক বিপ্লবী কোলোনতাই। বিপ্লব পরবর্তী সমাজে মানুষের সম্পর্ক, ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজতে যিনি তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য যিনি লিখে গেছেন ভালোবাসার-কমরেডশিপের কথা। ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটালে, পরিবার কাঠামো উপড়ে ফেললে যে সম্ভাবনার জন্ম দেবে, যে সর্বহারার নতুন নৈতিকতার কথা কোলোনতাই নিরন্তর বলে গেছেন, সেই ভালোবাসার কমরেডশিপের উপর আস্থা রেখেছিলেন ভগৎ-ও। জেলে বসে লেনিন পড়তে পড়তে কোলোনতাইয়ের কথা জেনেছিলেন কি না জানা নেই, কিন্তু দু’জনের আগামীর স্বপ্নে বেশ মিল পাওয়া যায়। হয়তো দুনিয়ার দুই প্রান্তে থাকা দুই বিপ্লবীর কখনও কথোপকথনের সুযোগ হলে এক নতুন সমাজের আরও বৈপ্লবিক কোনও রূপান্তরের হদিশ পেতাম আমরা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বিষাদ এবং বিরোধিতা কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে পারব এই উদ্দেশ্যেই মান্টো নিয়ে কাজ শুরু
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে যখন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদের ভালোবাসার অধিকার, মুক্ত চিন্তার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার সমস্ত কিছু হরণ করা হচ্ছে, যখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্যারিকেড গড়ে উঠছে, তখন ভগৎ সিং যেন দিন দিন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। শুধুমাত্র ২৩ বছরের স্পর্ধার জন্য নয়, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের জন্যেও শুধু নয়, বরং বিরোধিতার রাজনীতির পাশাপাশি আগামীর এই দিন বদলের স্বপ্নের জন্য। আইরিশ মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে কেন লোচের ছবি ‘‘Wind that shakes the barley’s’’-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য আছে, যেখানে ছবির মূল চরিত্র এক আইরিশ বিপ্লবী জেলে বসে মৃত্যু বরণ করার আগে তার প্রেমিকাকে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘‘It’s easy to know what you are against, but quite another to know what you are for.’’ যে কোনও মুক্তি সংগ্রামেই বিরোধিতার রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে আগামী গড়ার স্বপ্নটাকেও একই সঙ্গে বুকে নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে যেতে হয়, ভগৎ সিং সেটা বুঝিয়েছিলেন। সেই জন্যই আজ গেরুয়া বাহিনী শত চেষ্টাতেও ভগৎ সিংকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসাৎ করতে পারে না। ভগৎ সিং, প্রীতিলতারা তাই বেঁচে থাকে কনকনে ঠান্ডায় দিল্লি সীমান্তে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কৃষকের হাতে, রাজপথ জুড়ে বসে থাকা মুসলমান মেয়েদের স্লোগানে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের বুকের আগুনে, হাতে হাত রেখে গড়া শ্রমিকের ব্যারিকেডে, ইনকিলাবের লড়াইয়ে, গানে।
‘অন্ধেরে কা ইয়ে তখত হমে তাকত সে আব ঠুকরানা হ্যায়
হর সাঁস যাহা লেগি উড়ান উস লাল সুবহ কো লানা হ্যায়
শহিদো কে রাহ পর মর মিটনে কি ক্রান্তিকারী উম্মিদো মে
অ্যায় ভগৎ সিং তু জিন্দা হ্যায়…’
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।