সংঘবদ্ধ জার্মান শ্রমিকরা ছিল নাৎসিদের পথের প্রধান কাঁটা। সে প্রতিরোধ অপসৃত হতেই আর কেউ রইল না জার্মান গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য। ইতিহাসটা আমাদের মনে রাখতে হবে। মে দিবস তাই কেবল একটা দিন নয়, তা কেবলই শ্রমিকের দিনও নয়। তা আসলে আমাদের গণতন্ত্র আর অধিকারকে রক্ষার আন্দোলনে শেষ কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ। লক্ষ শ্রমিকের কণ্ঠে ইন্টারন্যাশনাল ধ্বনিত হলে সবচেয়ে ভয় পায় ফ্যাসিবাদী আর কুচক্রীরা, যারা প্রতি মুহূর্তে দেশের সংবিধানের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাতে চায়।
আজ মে দিন, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। জাতিসংঘ আজকের দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিকের দিন হিসেবে পালন করে। সারা পৃথিবীতে প্রায় সব দেশেই মে দিবস পালন করা হয়। বিশেষত শ্রমিক সংগঠনগুলির কাছে এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল সকলেই কি মে দিবস পালন করে, মানে আমি বলতে চাইছি সব শ্রমিক সংগঠন? উত্তরটা আন্দাজ করা খুব সোজা। ফ্যাসিস্টরা মে দিবসকে অস্বীকার করে। তাদের তথাকথিত শ্রমিক সংগঠনগুলি মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে না। উদাহরণ খুঁজতে জার্মানি বা ইতালি যাওয়ার দরকার নেই, সময়ের সারণীতে পিছিয়ে গিয়ে তিন বা চারের দশকে যাওয়ারও দরকার নেই। এই মুহূর্তে ভারতের বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠনটি, অন্তত সংখ্যার হিসেবে তাই– ভারতীয় মজদুর সংঘ– তারা মে দিবস পালন করে না। তারা শ্রমিকের দিন হিসেবে পালন করে ‘বিশ্বকর্মা দিবস’। ভারতীয় মজদুর সংঘ কারা পরিচালনা করে, তা উইকিপিডিয়া করলেই জানা যাবে। এটি সংঘ পরিবারের ও বিজেপির দ্বারা পরিচালিত শ্রমিক সংগঠন। স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য তারা অস্বীকার করে। কারণ তারা মতাদর্শগতভাবেই শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী।
দুইয়ের দশকের শেষদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মে দিবস উদযাপন হত সোভিয়েত রাশিয়া, আমেরিকা ও জার্মানিতে। জার্মান শ্রমিকরা তখন সেদেশের সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতা দখল করার এক মাসের মধ্যে রাইখসট্যাগ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দোষ চাপানো হয় কমিউনিস্ট পার্টির ওপরে। গ্রেপ্তার করা হয় সকল কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্রেট লিডারদের। তখন জার্মানিতে কমিউনিস্ট এবং সোশালিস্টদের দ্বারা পরিচালিত শ্রমিক সংগঠনগুলির বিরাট উপস্থিতি। ফলে ১৯৩৩ সালের জার্মানিতে মে দিবসের বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল। কারণ সাত লক্ষ জার্মান শ্রমিকের এই বিরাট ক্ষমতাকে দমন করতে না পারলে হিটলার বুঝেছিল তার নাৎসিবাদ নিষ্কণ্টক হবে না। জার্মানিতে ১৯৩৩-এর মে দিবস তাই ছিল একটা ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ। নেতারা সবাই জেলে ‘রাইখসট্যাগ ফায়ার ডিক্রি’র বলে হিটলারের ক্ষমতাশীল পার্টি সব ধরনের জমায়েত, মতপ্রকাশের অধিকার এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দমন করার জন্য ছিল উদ্যত। ১৯৩৩-এর মে দিবসের ঠিক আগে হিটলারের গুন্ডাবাহিনী একের পর এক ইউনিয়ন অফিস আক্রমণ করল, গ্রেপ্তার এবং গুপ্তহত্যায় সন্ত্রস্ত করে তুলল জার্মান শ্রমিকদের। শ্রমিক নেতাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল নবনির্মিত ডাশাও কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, যাতে তারা কোনওভাবেই মে দিবসের অনুষ্ঠান পালন করতে না পারে। কিন্তু হিটলার বাহিনী বুঝেছিল যে মে দিবসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই তারা চেষ্টা শুরু করল কমিউনিস্ট ও সোশালিস্টদের হাত থেকে মে দিবসকে চুরি করার। তারা বলল মে দিবসের শ্রেণি সংগ্রামের বার্তার মধ্যে লুকিয়ে আছে বিভাজনের বীজ, তাই জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তা ক্ষতিকর। তারা মে দিবসকে জার্মানি ঐতিহ্য দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করল।
…………………………………..
ওই প্রতিক্রিয়াশীল জমায়েতের শেষে বাড়ি ফিরে রাইখসকট্যাগ প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবলস তাঁর ডাইরিতে লিখলেন, ‘টুমোরো উই উইল অকুপাই দ্য ইউনিয়ান হাউজেস। রেজিস্টেন্স ইজ নট টু বি এক্সপেক্টেড এনিহোয়ার।’ পরদিন, অর্থাৎ ২ মে শ্রমিকের রক্তে রাঙা হল জার্মানি। নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শেষ দুর্গের পতন হল।
……………………………………
দূর বিদেশের ইতিহাস আর সমকালীন স্বদেশের বর্তমানের দিকে তাকিয়ে কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছেন কি? পাওয়াটাই স্বাভাবিক। ১৯৩৩-এর মে দিবসের পরপর বিরাট সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হল শ্রমিক সংগঠনগুলির ওপরে। জার্মান শ্রমিকদের বাধ্য করা হল কমিউনিস্ট এবং সোশালিস্ট সংগঠন ত্যাগ করে নাৎসি পার্টি পরিচালিত জার্মান লেবার ফ্রন্টে যোগদান করতে। ঐতিহাসিক মে দিবসে শ্রমিকের স্বার্থকে পদদলিত করে হিটলার বাহিনী পাল্টা জমায়েত করল, বলল জার্মান শ্রমিকের কাছে নাৎসি রাষ্ট্র নিঃশর্ত আনুগত্য চায়। ওই প্রতিক্রিয়াশীল জমায়েতের শেষে বাড়ি ফিরে রাইখসকট্যাগ প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবলস তাঁর ডাইরিতে লিখলেন, ‘টুমোরো উই উইল অকুপাই দ্য ইউনিয়ান হাউজেস। রেজিস্টেন্স ইজ নট টু বি এক্সপেক্টেড এনিহোয়ার।’ পরদিন, অর্থাৎ ২ মে শ্রমিকের রক্তে রাঙা হল জার্মানি। নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শেষ দুর্গের পতন হল। ইউনিয়ন অফিসগুলোর ওপর থেকে নামিয়ে দেওয়া হল কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা পতাকা। সেখানে জোর করে ওড়ানো হল স্বস্তিকা পতাকা।
সংঘবদ্ধ জার্মান শ্রমিকরা ছিল নাৎসিদের পথের প্রধান কাঁটা। সে প্রতিরোধ অপসৃত হতেই আর কেউ রইল না জার্মান গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য। ইতিহাসটা আমাদের মনে রাখতে হবে। মে দিবস তাই কেবল একটা দিন নয়, তা কেবলই শ্রমিকের দিনও নয়। তা আসলে আমাদের গণতন্ত্র আর অধিকারকে রক্ষার আন্দোলনে শেষ কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ। লক্ষ শ্রমিকের কণ্ঠে ইন্টারন্যাশনাল ধ্বনিত হলে সবচেয়ে ভয় পায় ফ্যাসিবাদী আর কুচক্রীরা, যারা প্রতি মুহূর্তে দেশের সংবিধানের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাতে চায়। আসলে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও জাতপাতের বিভাজনকামী পরিচয়ের গণ্ডিতে আমাদের বেঁধে ফেলতে চায় ফ্যাসিবাদ, মে দিবসের শ্রমিকের ঐক্য তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। সামাজিক বিভেদ আর উগ্র জাতীয়তা– যে দুটো ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারীর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা, সেখানেই আঘাত হানে মে দিবস। সুদূর শিকাগোর কবেকার ১৮৮৬ সালের হে মার্কেটের শহিদরা লক্ষ-কোটি প্রাণের স্পন্দন হয়ে ফ্যাসিবাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা আন্তর্জাতিক, মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীটা পুঁজিবাদীরা চালায় না, পৃথিবীটা চালায় শ্রমিক জনতা।
১৯৫১ সালের আমেরিকা। ম্যাকারথিজমের থাবা চেপে বসেছে মার্কিন জনগণের গলায়। কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে প্রতিবাদী শিল্পী-সাহিত্যিকদের। মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীলরা দাঁত-নখ বের করে মে দিবসের বিরোধিতায় নেমে পড়ল। এরকম এক সময়ে কবি হাওয়ার্ড ফাস্ট একটি প্রবন্ধ লিখলেন মে দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে। প্রশ্ন তুললেন, WHY DO THEY FEAR the worker’s holiday? Why, when a hundred days in the year are celebrated, is the one day that the American working class has chosen as its own day hated and maligned? Why do they scream that May Day is subversive, a foreign importation…। হ্যাঁ, অনেক জল গড়িয়েছে, সময় পাল্টেছে। অনেক কিছু বদলেছে আমাদের চারপাশে, কিন্তু অনেক কিছু আবার বদলায়ওনি। আরএসএস পরিচালিত ভারতীয় মজদুর সংঘের সাধারণ সম্পাদক ব্রিজেশ উপাধ্যায় মে দিবসের বিরোধিতা করে বলছেন, মে দিবসের ধারণা বিদেশি, তা নাকি ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না! যারা কিছুদিন আগেই দেশের কৃষকের ঘাম-রক্ত বিদেশের মাল্টিন্যাশনাল পুঁজির কাছে বেচে দিতে আইন পাশ করেছিল, তাদের কাছে দেশপ্রেম আর ভারতীয়ত্বের পাঠ না নেওয়াই সমীচীন। তাই আবার ফিরে আসি হাওয়ার্ড ফাস্টের কথায়। তিনি রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু অস্বীকার করে শ্রমিকের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন মে দিবসে একত্রিত হওয়ার। মে দিবস তাঁর কাছে শান্তি, স্বাধীনতা, সাম্য, কালো মানুষের অধিকারের জন্য সোচ্চার হওয়ার দিন। বললেন, We march for the Constitution on May Day! আজকের ভারতে কবি হাওয়ার্ড ফাস্টের এই কথাগুলো কী আশ্চর্যরকম সত্যি!
আশ্রমে মেলার মাঠে যুযুৎসু দেখে রানী চন্দ তাঁর অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। 'মনে হল যেন আমাদের একটা রুদ্ধ দিক খুলে গেল– যেখানে অজস্র আলো অবাধ হাওয়া। যেখানে দিন নাই রাত্রি নাই– খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই যে আমি আছি, ভয় নেই কারুর।'