অধিকাংশ জাতক গল্পে কে যে বোধিসত্ত্ব, সে-কথা উল্লেখ না থাকলেও দিব্যি বোঝা যায়। এ আর শক্ত কী, যিনি সবচেয়ে প্রাজ্ঞ, উচ্চতম মানবিক গুণসম্পন্ন– তিনিই বোধিসত্ত্ব। আবার কোনও গল্পে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও তর্ক করতে ইচ্ছে করে। আজকের গল্পে যেমন আগাম বলে দেওয়া আছে, সেই জন্মে চিত্রকূটে পর্বতের ৯,০০০ সুবর্ণ হাঁসের দলপতি ছিলেন বোধিসত্ত্ব; কিন্তু মন বলে, কেন বাপু, সেনাপতি সুমুখ কম যান কীসে?
এই গল্পে ঢুকতে হবে বারাণসীরাজ সংযমের প্রধানা মহিষী ক্ষেমার শয়নকক্ষ দিয়ে। কয়েকজন ব্যক্তিগত দাসী পরিবৃত হয়ে সুবিশাল পালঙ্কে তিনি ঘুমোচ্ছেন। ভোরবেলা হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসে তিনি বললেন, ‘ধর ধর! উড়ে গেল!’
এক দাসী খাবার জলের পাত্র এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্বপ্ন দেখছিলেন, রানিমা?’
রানী বললেন, ‘এর চেয়ে সত্য আর হয় না। এক সোনার হাঁস কেমন মিষ্টি গলায় আমায় ধর্মকথা শোনাচ্ছিল। এমন হৃদয়-ছোঁয়া কথা আমি আগে কখনও শুনিনি।’
রাজাকে বললেন, ‘অমন সোনার হাঁসের কাছে আবার সৎকথা শুনতে না পেলে আমার জীবনই বৃথা। যেমন করে হোক আপনি ব্যবস্থা করুন।’
রাজা পাত্র, মিত্র, অমাত্য, পণ্ডিত, ব্যাধ, পর্যটক– প্রত্যেকের সঙ্গে আলোচনা করলেন। একটা বিষয় বোঝা গেল, ‘সোনার কেল্লা’-র মতো ‘সোনার হাঁস’-ও আসলে সোনার বরণ হাঁস। কিন্তু তেমন হাঁস তো কেউ দেখেনি। সুতরাং কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যাবে না সেটা নিশ্চিত।
শেষকালে এক কৌশল নেওয়া হল। নগরের উত্তরে নির্জন সমতলে এক বিশাল সরোবর খনন করা হল। সেখানে স্বচ্ছ জল, পঞ্চ বর্ণের পদ্ম, নানা জাতের গুল্ম। শিকার তো দূরের কথা, সেখানে মানুষদের ধারে-কাছে যাওয়াও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে, আমাদের মহারাজ সংযম দেশ-বিদেশের পাখিদের জন্য এই অভয় সরোবর নির্মাণ করলেন। রানিমার নামে এর নাম রাখা হল ‘ক্ষেম সরোবর’।
এক অভিজ্ঞ ব্যাধকে দায়িত্ব দেওয়া হল দেখাশোনা করার। রাজা তাকে বললেন, ‘কেমন কী পাখি আসছে তীক্ষ্ণ নজর রাখো, সোনা রঙের হাঁস দেখতে পেলেই আমাকে খবর দেবে।’
পাখিদের মুখে মুখে রটে গেল, এখানে ভয় নেই কোনও। তাই দূর-দূরান্ত থেকে পাখি আসতে আরম্ভ করল। হাঁসও এল কত রকমের: তৃণহংস, পাণ্ডুহংস, মনঃশিলাহংস, পাকহংস– কত নাম তাদের! এবং শেষ পর্যন্ত চিত্রকূট পর্বত থেকে এসে হাজির হল সুবর্ণহংসের সারি।
দলপতি বোধিসত্ত্ব প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, মানুষদের নানা ছলাকলা, কী দরকার জনপদে গিয়ে? কিন্তু তাঁর দলের সদস্যরা নানা সূত্রে এই সরোবরের সুখ্যাতি শুনে শুনে সেখানে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। তাই অনুমতি দিতেই হল। নিজে সামনে থেকে, সঙ্গে সেনাপতি সুমুখকে নিয়ে তিনি সদলে হাজির হলেন ক্ষেম সরোবরে।
উত্তেজিত ব্যাধ রাজাকে খবর দিল, ‘আপনার কৌশল ফলপ্রসূ। সোনার হাঁস এসেছে আমাদের সরোবরে।’
রাজা বললেন, ‘ওদের মধ্যে শ্রেষ্ঠটিকে তুমি ফাঁদে ধরে আমার কাছে নিয়ে এসো। প্রচুর পুরস্কার পাবে। দেখো প্রাণে মেরো না যেন।’
কয়েক দিন সুবর্ণহাঁসদের আসা-যাওয়া দেখে ব্যাধ সপ্তম দিন এক নিপুণ ফাঁদ পাতলে। আর তাতেই আটকা পড়লেন বোধিসত্ত্ব– দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে সুদর্শন। তাঁর সোনার বরণ দেহ ক্ষোভে স্ফীত হচ্ছে, তাঁর গলা বেষ্টন করা তিন নিখুঁত লাল রেখা যন্ত্রণায় কেঁপে উঠছে। তবু তিনি সঙ্গীদের জানতে দিলেন না। ভাবলেন, ওরা আতঙ্কিত হয়ে খালি পেটে পালাতে গিয়ে মাঝপথেই আরও বিপদে পড়বে। খাওয়া ও জলকেলি শেষ করে খুশি মনে তারা যখন ফিরছে তখন তিনি সংকেত দিলেন। স্থিতধী সুমুখ সবাইকে রওনা করে দিয়ে ফিরে এলেন বোধিসত্ত্বের কাছে।
ব্যাধ তখন সাদা ফুলে ঢাকা বিশাল খাঁচা নিয়ে প্রস্তুত। সুমুখ বললেন, ‘তুমি আমাকে মারো। আমাদের রাজাকে ছেড়ে দাও।’
ব্যাধ বললে, হত্যার জন্য নয়, রাজা-রানিকে সুবর্ণহংস একবার দর্শন করানোর জন্য এত কুশলী আয়োজন।
সুমুখ বললেন, ‘তবে অপেক্ষাকৃত ছোট আরও একটি খাঁচা নিয়ে এসো। আমিও আমাদের রাজাকে আগলে তোমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাব।’
রাজদরবারে এসে সুমুখ বললেন, ‘‘মহারাজ, ‘অভয় সরোবর’ হিসেবে ঘোষণা করার পরও ফাঁদ পেতে আমাদের ধরা কি আপনার রাজোচিত কাজ হল?’’
বন্দি, নিঃসহায় এক সেনাপতির গলায় এমন দৃপ্ত দোষারোপ শুনে ঢোক গিলে সংযম বললেন তাঁর উদ্দেশ্যের কথা, ক্ষমা চাইলেন তাঁদের এই চাতুরির জন্য। তারপর সমাদরে বোধিসত্ত্ব আর সুমুখকে নিয়ে গেলেন অন্দরমহলে। রানিমার স্বপ্ন সত্যি হল।
ভক্তিভরে বোধিসত্ত্বর কাছে ধর্ম আলোচনা শোনার পর রাজা প্রাসাদের ছাদ থেকে তাদের দু’-জনকে বিদায় জানালেন। দুই সুবর্ণ হাঁস উড়ে চলল আর এক পুণ্যের দিকে।