জার্মানিতে যেটা ‘বিও’, ইংরাজিতে সেটাই ‘বায়ো’, ফরাসিতে ‘লাবাঁ’, আমেরিকা এবং আমাদের দেশে ‘অরগ্যানিক’– এখন ভাল রকম পাগলামি। এসবের দাম অনেক বেশি হয়, অরগ্যানিক শাক-সবজিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি দেওয়া হয় না বলা হয়। অরগ্যানিক বা বায়ো-গরুরা কাঁচা ঘাস, খোলভূষি খায়, হরমোন মোটে দেওয়া হয় না, আর অরগ্যানিক ডিম হল হ্যাপি চিকেনের ডিম। ওদের দেশে এসব বায়ো ফুডের দাম অনেক বেশি। সেখানে এই যে বিড়ি, যা শতকরা একশো ভাগ বায়ো, ভিতরের তামাকে কোনও কৃত্রিম পদার্থ নেই, সুগন্ধ মেশানো নেই, একটা নির্ভেজাল পাতায় মোড়া, এবং তুলো থেকে তৈরি সুতোয় বাঁধা। এহেন একটা পদার্থের অধীশ্বর আমাদের দেশ– এই উপলব্ধি হল এমারসনের দাক্ষিণ্যে এবং ভারতবাসী হিসেবে গর্ববোধ করলাম।
১৫.
এমারসনকে যখন একটা বিড়ি দিয়েছিলাম আগুন ধরিয়ে, প্রথম টানটা দিয়ে চক্ষুমুদে বলেছিল, ‘অ্যামেজিং!’, তারপর বিড়িটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। কিন্তু বেশি দেখতে গেলে সময় চলে যাচ্ছিল, বিড়িটিরও ক্রমশ বৃথা ক্ষয় হচ্ছিল, মানে বিড়ির দেহ ক্রমশ পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তার আগেই নিজের শরীরে ধোঁয়াটা ঢুকিয়ে নিচ্ছিল এমারসন। এরপর বান্ধবীর জন্য ভিক্ষে করে নেওয়া যে দু’-চারটি বিড়ি ওর কাছে ছিল, ওগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। জিজ্ঞাসা করল, ‘ইজ টোব্যাকো ইনসাইড অফ দ্য স্টাফ?’ আমি বলি, ‘ইয়েস।’ জিজ্ঞাসা– ‘টোব্যাকো ইজ র্যাপ্ট ইন এ লিফ– ইজ ইট নট?’ আমি বলি, ‘ইয়েস, ইয়েস। ইট ইজ আ লিফ।’
–‘হোয়াই দ্য লিফ হ্যাজ নট ইয়েট বিন ড্রায়েড?’
আমি বলি, সেটাই তো মজা স্যর! যে-পাতা দিয়ে তামাকটা মোড়ানো হয়েছে, সেই পাতার একটা স্পেশাল কোয়ালিটি আছে। পাতা ভেঙে যায় না, অনেক দিন পর্যন্ত নরম থাকে। ফেটে গিয়ে তামাক বেরিয়ে যায় না।
–‘হোয়াট ইজ নেইম অফ দ্যাট লিফ?’
–কেন্দু। কেন্দুপাতা।
–‘খেন্ডুপ্যাটা? ও! এক্সিলেন্ট। ওনলি ইন্ডিয়া প্রডিউসেস খেন্ডুপ্যাটা?’
–‘আই বিলিভ।’
–‘ও! গ্রেট আফটার র্যাপিং দ্য লিফ ইজ বাইন্ডেড বাই থ্রেড?’
– ‘ইয়েস, ইয়েস।’ কেন্দুপাতায় তামাক ভরে সুতো দিয়েই বাঁধা হয়। লাল সুতোর বিড়ি, সবুজ সুতোর বিড়ি। লাল সুতোর বিড়ি বেশি কড়া হয়।
এমারসন বলে, ‘আন্ডারস্টুড। দ্য কালারস অফ দ্য থ্রেড স্পিকিং অ্যাক্ট কোয়ালিটি অফ দ্য বিড়ি।’
এরপর গভীরভাবে কিছু ভাবল। তারপর বলল, ‘অল দিজ প্রোডাক্টস মাস্ট বি হ্যান্ডমেড?’
আমি বলি, ঠিকই ধরেছ এমারসন। এসব হাতে তৈরি। মুর্শিদাবাদ জেলার মেয়েরা ঘরে ঘরে বিড়ি বানায়। অন্যত্রও বানায়। সব হাতে।
এমারসন বলে, ‘অ্যান্ড এগেইন দিজ অল আর বিও।’ ‘বিও’ মানে ‘বায়ো’। সার ছাড়া, পোকা মারার ওষুধ ছাড়া যেসব তরিতরকারি হয়, সেগুলিকে ওরা বলে ‘বিও ভেজিস্’। বিও মুরগিও আছে। যে মুরগিগুলি পোলট্রির খাঁচায় থাকে না, ঘুরে বেড়ায়, ভোরবেলা ‘কোক্কর কো’ ডেকে সূর্যকে ওঠায়, খুঁটে খায় পোকামাকড় কিংবা এটা ওটা, অন্য খাবারও অবশ্য দেওয়া হয়। সোজা কথায় আমাদের দেশি মুরগি।
বার্লিনে আমি একটি গাইড পেয়েছিলাম, ওর নাম সাস্কিয়া। প্রথম কয়েকটা দিন ও আমাকে দোকান, বাজার, বাস এবং মেট্রোর টিকিট কাটার পদ্ধতি এসব শিখিয়ে দিয়েছিল। আমাকে একটা ডিপার্টমেন্টাল শপে নিয়ে গিয়েছিল। ওখানে নানারকম ডিপার্টমেন্ট আছে। দুধের ডিপার্টমেন্টে নানা কিসিমের দুধ। গরু, মোষ, ভেড়া, উটের। হ্যাঁ, উটের দুধ আছে বইকি। আরব মুলুকের লোকজন কম আছে নাকি? তাছাড়া ফুল ক্রিম, হাফ ক্রিম, নো ক্রিম, ফ্লেভারড ফ্লেভারই কত রকম– ভ্যানিলা, কেশর, স্ট্রবেরি, এলাইচি। ঠিক তেমন ফলের মুলুক, জলের মুলুক, ওয়াইন রাজ্য। দেখলাম দুধ, জল আর বিয়ার– প্রায় একই রকম দাম। কী করে হয়, জানি না। ডিমের রাজ্যও ও’রম। হাঁসের ডিম, কোয়েলের ডিম, মুরগির ডিম। মুরগির ডিমের নানা প্রকারভেদের মধ্যে একটা হল ‘বিও এগ’। বিও চিকেনের বিও এগ। সাস্কিয়া বলেছিল, ‘বিও এগ খাও, আনন্দে থাকবে। বিকস্ দিজ এগ্স আর প্রোডাক্ট অফ হ্যাপি চিকেনস্। এই চিকেনগুলো খুব হ্যাপি থাকে, কারণ ওরা বন্দি থাকে না।’
এত কথা বলতে হল, আমাদের পাঠকদের ‘বিও’ মর্ম বোঝানোর জন্য। জার্মানিতে যেটা ‘বিও’, ইংরাজিতে সেটাই ‘বায়ো’, ফরাসিতে ‘লাবাঁ’, আমেরিকা এবং আমাদের দেশে ‘অরগ্যানিক’– এখন ভাল রকম পাগলামি। এসবের দাম অনেক বেশি হয়, অরগ্যানিক শাক-সবজিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি দেওয়া হয় না বলা হয়। অরগ্যানিক বা বায়ো-গরুরা কাঁচা ঘাস, খোলভূষি খায়, হরমোন মোটে দেওয়া হয় না, আর অরগ্যানিক ডিম হল হ্যাপি চিকেনের ডিম। ওদের দেশে এসব বায়ো ফুডের দাম অনেক বেশি। সেখানে এই যে বিড়ি, যা শতকরা একশো ভাগ বায়ো, ভিতরের তামাকে কোনও কৃত্রিম পদার্থ নেই, সুগন্ধ মেশানো নেই, একটা নির্ভেজাল পাতায় মোড়া, এবং তুলো থেকে তৈরি সুতোয় বাঁধা। এহেন একটা পদার্থের অধীশ্বর আমাদের দেশ– এই উপলব্ধি হল এমারসনের দাক্ষিণ্যে এবং ভারতবাসী হিসেবে গর্ববোধ করলাম। এবং আফশোস করলাম ভারত কেন বিড়িটা দুনিয়া জুড়ে মার্কেটিং করে না! কিউবা বিখ্যাত চুরুটের জন্য। বর্মাদেশের চুরুটেরও চাহিদা আছে। হল্যান্ড পাইপে খাওয়ার তামাক রফতানি করে সারা বিশ্বে। ভারত কেন ঘুমায়ে রয়? ‘বিও’ ব্যবসায়ে বিড়ির দৌলতে ভারতের বিশ্বপতি হওয়ার অমিত সম্ভাবনা আমরা হেলায় হারাচ্ছি! এরকম আরও কিছু সম্ভাবনা আমরা হেলায় নষ্ট করেছি। এর একটা হল মহুয়া। মহুয়া মদ্য অনেক দামি-নামী ওয়াইনের চেয়ে স্বাদে-গন্ধে শ্রেয়। এ বিষয়ে না-হয় পরে আলোচনা করা যাবে।
বিড়ির কথা হচ্ছিল। একটা ঘটনার কথা বলি। দুবাই বিমানবন্দর আয়তনে বিশাল। দুবাইতে ঘণ্টা-তিনেক বসে থাকতে হয়েছিল পরবর্তী বিমান ধরার জন্য। এর আগে ১৩ ঘণ্টা টানা উড়েছি নিউ ইয়র্ক থেকে। দুবাই থেকে কলকাতার উড়ান। আমার প্রবল ধূমেচ্ছা পায়। আমার মানিব্যাগে তিনখানি বিড়ি গোপনে ছিল। দেশলাই বা লাইটার বিমানে বহন করা যায় না। আমারও অগ্নিসূত্র ছিল না। ভাবছিলাম, কোনও ‘স্মোকিং জোন’-এ গেলে কোনও ধূমপায়ীর কাছ থেকে আগুন পাওয়া যেতে পারে। দুবাই বিমানবন্দরে ‘স্মোকিং জোন’ খুঁজছিলাম। একজন কৃষ্ণত্বক মানুষের দেখা পেলাম। গলায় ঝোলানো কার্ডে মনে হল উনি বিমানবন্দরের কর্মী। তাঁকে ‘স্মোকিং জোন’-এর সন্ধান ভিক্ষা করলাম। উনি বললেন, ‘ইয়েস, কাম উইথ মি। ডু ইউ হ্যাভ এনি একস্ট্রা ওয়ান ফর মি?’ আমি বলি, ‘ইয়েস, নো প্রবলেম।’ উনি আমাকে সঙ্গে করে ওই ধূমাগারে নিয়ে গেলেন। আমি একটি বিড়ি ধরাই, ওঁকেও একটা দিই। উনি একটা টান দিয়ে বললেন– ‘ও! হোয়াট অ্যামেজিং। ইটস্ ওয়ান্ডারফুল। হোয়াট ইট ইজ কল্ড ম্যান?’ আমি বলি, ‘বিড়ি।’
সেই কৃষ্ণাঙ্গ অভিভূত। কৃষ্ণের মোহন হাসিতে ভরে গেল ওর মুখ। বলে উঠলেন– ‘লং লিভ ইন্ডিয়া। আই নেভার টেস্টেড সাচ হেভেন লি স্মোক।’ এমন কৃতজ্ঞ মুখের হাসি আমি আজও মনে রেখেছি। উনি বলেছিলেন, উনি নাইজেরিয়ার মানুষ। এমন স্বর্গীয় ধোঁয়াকাঠি জীবনে দেখেননি। প্রতিদানে কী দেবেন আমাকে, ভেবে উঠতে পারছিলেন না। শেষ অবধি আমাকে ২৫০ গ্রাম পেস্তার প্যাকেট উপহার দিলেন, একটি বিড়ির বিনিময়ে ২৫০ গ্রাম পেস্তা! ভাবা যায়?
আকাশবাণীর একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। ঋত্বিক ঘটক এসেছেন। ওঁর ‘জ্বালা’ নাটকটির রেকর্ডিং হচ্ছে। উনি স্টুডিওতে বিড়ি ধরিয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের অধীনেই স্টুডিওগুলি থাকে। ওঁরা ছুটে এলেন। বললেন, ‘এখানে ধূমপান নিষেধ। বাইরে গিয়ে এসব করুন।’ ঋত্বিক ঘটক বিড়িতে টান দিয়ে ওঁদের বলেছিলেন, ‘আপনাদের মাথার ওপরে যিনি আছেন তাঁকে গিয়ে বলুন, ঋত্বিক ঘটক বিড়ি ধরিয়েছেন। উনি এটা শেষ করবেন।’ তারপর শেষ সুখটান দিয়ে বললেন, ‘এবার কোথায় ফেলবেন দেখুন।’ পরে স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন, ‘আমি স্বদেশি লোক। সিগারেট নয়, বিড়ি খাই। আপনারা আপনাদের নিয়ম পাল্টান। আর্টিস্টরা বিড়ি খাবে না– এটা হতে পারে না।’
কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং-মিছিলে দেখেছি, কেউ সিগারেট ধরালে তাকে ‘বুর্জোয়া’ বলে হ্যাটা করা হত। কোনও কমরেডের বিচ্যুতির কথা বলতে গিয়ে বলা হত– ‘অমুকের তো বারোটা বেজে গেছে। আজকাল দেখি সিগারেট ফুঁকছে!’
মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটার কথা মনে পড়ে। ‘প্রমা’ পত্রিকার সম্পাদক সুরজিৎ ঘোষ আমাকে মহাশ্বেতা দেবীর বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে নিয়ে যান। ওঁর ঠোঁটের ফাঁকে তখন একটা বিড়ি জ্বলছিল। উনি জিহ্বার অদ্ভুত কায়দায় বিড়িটাকে ঠোঁটের ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নিয়ে বললেন, ‘তোমার পর পর কয়েকটা ভালো গল্প পড়লাম, খুব খুশি হয়েছি। নাও বিড়ি খাও একটা।’ কী ধর্মসংকটে পড়লাম! গুরুজনের সামনে বিড়ি খাব? যদি বলি খাই না দিদি, উনি ভাববেন– বিড়ি খায় না? সিগারেট খায়? অথচ গরিব মানুষের কথা লেখে? যদি বলি বিড়ি-সিগারেট কিছুই খাই না, তবে তো আরও খারাপ হবে। উনি ভাববেন, লুতুপুতু ছেলে! শেষে বিড়িই ধরালাম।
আবারও বিধিবদ্ধ সতর্কতাটা আওড়াই– ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে অতীব ক্ষতিকর।’
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী