ট্রেড ইউনিয়নের কাজ কি কেবল মিটিং-মিছিল করা, নাকি সদস্যদের শ্রম আইন সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা, তাদের অধিকারগুলি সম্পর্কে সচেতন করা, সংগঠনের ভিতরে লিঙ্গ সমতার বোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করা? আমাদের পাড়ায় বা অফিসে যে ট্রেড ইউনিয়ন দেখি, তার সঙ্গে কি কোনও অদৃশ্য সুতোয় জোড়া আছে ব্রাসেল্স বা লন্ডন বা গুয়াতেমালার কোনও শ্রমিক সংগঠন? হ্যাঁ, আছে। সেই অদৃশ্য সুতোর একটি নাম ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন’। আজ সেই সুতোটির জন্মদিন।
আমরা যারা বাংলাবাজারে মাছভাত খেয়ে, মোড়ে মোড়ে পার্টি অফিস দেখে বড় হয়েছি, তাদের কাছে ট্রেড ইউনিয়ন তো রোজ সকালের খবরকাগজ, কচুরি বা ভাঁড়ভর্তি দুধ-চায়ের মতোই চেনা মক্কেল। ট্রেড ইউনিয়ন কী? ওই তো, অফিসে, কারখানায় যাদের ঝান্ডা, রিকশা স্ট্যান্ডে যাদের সাইনবোর্ড, মাঝেমধ্যে রাস্তায় নেমে ‘জিন্দাবাদ’ আর ‘চলবে না’ যারা বলে। যারা বলে ‘কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, মানছি না মানব না’, তারাই তো ট্রেড ইউনিয়ন। এ আর নতুন কী! সেই কোন ছোট্টবেলা থেকেই তো দেওয়ালে, পোস্টারে পড়ে আসছি, ‘কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের ডাকে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক্কেবারে ঠিক কথা! কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন মানে কি শুধু এইটুকুই? সরকারি কর্মচারী, আশাকর্মী, রিকশাচালক বা কারখানার শ্রমিকদের যেমন ইউনিয়ন থাকে, ঠিক তেমনই যারা ফুটবল খেলে পেটের ভাত জোগাড় করে, তাদের ইউনিয়ন হয়? ট্রেড ইউনিয়নের কাজ কি কেবল মিটিং-মিছিল করা, না কি সদস্যদের শ্রম আইন সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা, তাদের অধিকারগুলি সম্পর্কে সচেতন করা, সংগঠনের ভিতরে লিঙ্গ সমতার বোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করা? আমাদের পাড়ায় বা অফিসে যে ট্রেড ইউনিয়ন দেখি, তার সঙ্গে কি কোনও অদৃশ্য সুতোয় জোড়া আছে ব্রাসেল্স বা লন্ডন বা গুয়াতেমালার কোনও শ্রমিক সংগঠন?
হ্যাঁ, আছে। সেই অদৃশ্য সুতোর একটি নাম ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ১৯৪৫ সালের ৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুনিয়ার সব শ্রমিক সংগঠনকে একসুতোয় গাঁথার এই আধার– ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন’। সংক্ষেপে ‘ডবলিউ এফ টি ইউ’। ৭৮ বছর পরেও এখনও পৃথিবী জুড়ে সক্রিয় এই সংগঠন। ১০৫ মিলিয়ন সদস্যের খুঁটিনাটি দেখতে সদা-সক্রিয়। আথেন্সের সদর দপ্তরে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মহাদেশের প্রতিনিধিরা যোগাযোগ করেন শ্রমিকের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে বিশ্বের সব শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন হয়ে ওঠার যে প্রত্যয় এই সংগঠন ঘোষণা করেছিল, তার প্রতিষ্ঠালগ্নে, তা কি ধরে রাখা গিয়েছে? স্পষ্ট উত্তর, না। আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আন্দোলন অন্তত দু’টি বড় আধারে বিভক্ত। ‘ডবলিউ এফ টি ইউ’ তার একটি।
১৯৪৫ সালে পথচলা শুরু করার বছর চারেকের মধ্যেই প্রথম বিভাজনের শিকার হয় ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন’। ততদিনে গোটা দুনিয়া জুড়ে বাজতে শুরু করেছে ঠান্ডা যুদ্ধের দামামা। আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে বিশ্ব। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন প্রথম বিশ্ব। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিশ্ব। ভারত-সহ বেশ কিছু দেশ জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে। ডবলিউ এফ টি ইউ-এর মধ্যে থাকা প্রথম বিশ্বের অনেকগুলি ট্রেড ইউনিয়ন অভিযোগ করল, সংগঠনে কায়েম হয়েছে সোভিয়েত আধিপত্য। কমিউনিস্টদের মতই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাকিদের ওপরে। ১৯৪৯ সালে একঝাঁক ইউনিয়ন বেরিয়ে এসে তৈরি হল শ্রমিক সংগঠনগুলির আরেকটি আর্ন্তজাতিক আধার– ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অফ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন’। অনেক বছর পর ২০০৬ সালে এই সংগঠনের সঙ্গে মিশে যাবে ‘ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন অফ লেবার’। তৈরি হবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন’। আপাতত এটিই সবচেয়ে বড় আর্ন্তজাতিক শ্রমিক সংগঠন। সদস্য সংখ্যা ২০৭ মিলিয়ন।
আসলে অনৈক্য আর বিভাজনের পাপ এক আদিম অভিশাপ আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আন্দোলনে। বারবার মতাদর্শগত কারণে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে শ্রমজীবী মানুষকে এক সুতোয় গাঁথার আর্ন্তজাতিক প্রকল্প। শুরুটা হয়েছিল দেড়শো বছরেরও বেশি আগে। ১৮৪৮ সাল। গোটা ইউরোপ বিপ্লবের জোয়ারে উত্তাল! প্রুশিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, হাঙ্গেরি, সুইডেন, রোমানিয়া, বেলজিয়াম– দেশে দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ। হাজারে হাজারে পথে নামছে শ্রমিক। পুরনো পৃথিবীটার শিকড় ধরে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে সময়। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধের সামনে দেশে দেশে পিছু হটল গণবিক্ষোভের ঢেউ। এরপর বেশ কয়েক বছরের বিরতি। দেড় দশক পর আবার দুলে উঠল পোল্যান্ড। ১৮৬৩ সাল। পোল্যান্ডে ফেটে পড়ল জানুয়ারি অভ্যুত্থান। পোল্যান্ডের এই গণআন্দোলনের পর ফরাসি এবং ব্রিটিশ শ্রমিকদের অগ্রণী অংশ সিদ্ধান্ত নিলে, এইবার শ্রমিকদের একটা আর্ন্তজাতিক সংগঠন না বানালেই নয়। যুক্তিটা সহজ। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাথায় যারা বসে রয়েছে, তারা তো একজোট। তাহলে সমাজের শোষিত, নিপীড়িত মানুষ কেন সীমান্তের বেড়াজাল টপকে একে অন্যের হাত ধরবে না? পরের বছর, ১৮৬৪ সালে তৈরি হল ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’। যাকে কিছুদিন পরে গোটা দুনিয়া চিনবে ‘প্রথম আর্ন্তজাতিক’ বলে। তাকে কেন্দ্র করে রথী-মহারথীদের মিলনমেলা! কে নেই তাঁদের মধ্যে! বাকুনিন, প্রুঁধো, ব্ল্যাঙ্কির মতো স্বনামধন্য সংগঠক, দার্শনিক এবং চিন্তকরা জড়ো হলেন। এলেন দুর্দান্ত বিপ্লবী গ্যারিবল্ডি, যিনি অনেক পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া বহু বাঙালি বিপ্লবীকে প্রেরণা জোগাবেন। এলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস।
ঝড় তুলে দিল ‘ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল’। দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ। সদস্য সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলল ৮ মিলিয়নের গণ্ডি। পুরনো দুনিয়াটা যেন এবার সত্যিই নড়ে উঠছে! এতদিনে যেন সভ্যতার স্রষ্টার দল হাতে হাত রেখেছে একে অন্যের! সভ্যতার পিলসুজরা, যারা দাঁড়িয়ে থাকে মাথায় প্রদীপ নিয়ে, গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে যাদের, তারা হয়তো এতদিনে নিজেদের সোচ্চার উপস্থিতি জানান দেবে বিশ্বের দরবারে! কিন্তু হল আর কই! প্যারি কমিউনের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পরের বছর, ১৮৭২ সালে, প্রতিষ্ঠার মাত্র ৮ বছরের মধ্যেই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল স্বপ্নের ‘আর্ন্তজাতিক’। একদিকে মার্কসের অনুগামীরা। অন্যদিকে বাকুনিনের। এক ‘আর্ন্তজাতিক’ ভেঙে দুই টুকরো হল। একটির নাম ‘রেড ইন্টারন্যাশনাল’, অন্যটি ‘ব্ল্যাক ইন্টারন্যাশনাল’। মুচকি হেসে বিসমার্ক বলেছিলেন, লাল এবং কালো যদি এক হত, ইউরোপের রাজারাজড়া আর বড়লোকদের পৃথিবীটা থরথর করে কেঁপে উঠত।
হয়তো উঠত। কিন্তু ওঠেনি। এরপর ‘দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিক’। ১৯৮৯ থেকে ১৯১৬। সেখান থেকে টুকরো টুকরো বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংগঠন– ‘লেবার অ্যান্ড সোশালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ (১৯২৩-১৯৪০), ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং ইউনিয়ন অফ সোশালিস্ট পার্টিস’ (১৯২১-২৩), ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল– কমিনফর্ম-কমিন্টার্ন’। একটু একটু করে হারিয়ে গেল গোটা দুনিয়ার শ্রমিকদের এক মঞ্চে হাতে হাত ধরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। ছেঁড়া ঘুড়ির মতো লাট খেতে লাগল আকাশময়।
চেষ্টা হয়েছিল আরও একবার। ১৯৪৫ সালে। শিল্পী-স্রষ্টা-বিশ্বকর্মাদের একটি মালায় গাঁথার চেষ্টা। সেই মালাটির নামই ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন’। আজ সেই আপাত ব্যর্থ মালাটির জন্মদিন।
যদি দাগই মুছে ফেলো, স্মৃতিও মুছে ফেলা দস্তুর। পারবে পুরাতন প্রেম ছাড়া বেঁচে থাকতে? পারবে সেই আদিম ডাককে অস্বীকার করতে? বারবার জিতে যাওয়াগুলো ভুলে যেতে? সেইসব অপ্রেমের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওই আনন্দ ভুলে যেতে? কাটাগাছে হাত কেটে রক্তাক্ত, তবুও রাতের শেষে সেদিন বাঁকা চাঁদ উঠলে তুমিই তো আলোয় ভরে উঠেছিলে, আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলে। ফেরার রাস্তা ভুলতে চেয়েছিলে। আধেক আলো আর গোটা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিল সকাল হতে।