জীবন এমনই আশ্চর্য চিত্রপট। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সকল কামনা-বাসনা দিয়ে নানা ছবি এঁকে চলেছি। যেখানে আমাদের সাধ আর আহ্লাদ ভাঁড়ারে বিন্দুমাত্র টান পড়ে না। তবু সাধ আর সাধ্যের টানাপোড়েন চলেছে নিরন্তর। কিন্তু এত সবের মধ্যেই কোন দিন যে আমাদের মনে বৈরাগ্যভাব জেগে উঠবে, তা আমরা কেউ জানি না।
অনেক দিন আগের কথা। তখনকার কলকাতায় লালাবাবু আর শেঠজি নামে দুই জমিদার বংশসূত্রে প্রবল সম্পত্তি লাভ করে জমিদারি চালাচ্ছেন। তখন তাঁদের যৌবনকাল। লালাবাবু আর শেঠজি পরস্পর বাল্যবন্ধু। তা সত্ত্বেও জমিদারি পেয়ে দু’জন হয়ে উঠলেন পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। অল্পসময়ের মধ্যেই যা রেষারেষিতে পর্যবসিত হয়।
কিন্তু একজন যদি কোনও ভালো কাজ করতেন তখন আরেকজন তাকে টেক্কা দিতে আরও ভালো কাজ করতেন। এভাবেই নানা কাজে তাঁরা জীবনের বহু বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান, যশ— এসবের পাশাপাশি পরস্পরের প্রতি রোষ-বিদ্বেষ নিয়েই তাঁদের দীর্ঘ সময় বয়েছিল।
কিন্তু ৬০ বছর পার করে একদিন এমন এক মুহূর্ত এল যে, লালাবাবুর জীবনের সমস্ত হিসেব গেল পাল্টে! একটি ক্ষণের একটি চিন্তায় তাঁর জীবনবোধ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে চলতে শুরু করেছিল।
কীসের প্রেরণায় এই নতুন জীবনবোধ?
উত্তর হল– বৈরাগ্য।
একদিন বৃদ্ধ লালাবাবু পালকি চড়ে গঙ্গাতীরে বেড়াতে গিয়ে শুনতে পান, একটি ধোপার মেয়ে তার বাবাকে ডেকে বলছে, ‘বেলা যে যায়, বাসনায় আগুন দিবি না?’ ‘বাসনা’ মানে শুকনো তারাগাছ, যাতে আগুন দিলে তা পুড়ে ছাই হত। সেই ছাই দিয়ে ধোপারা কাপড় পরিষ্কার করত।
কিন্তু বৃদ্ধ লালাবাবু ধোপার মেয়ের ডাকে ‘বেলা যায় যে’ শুনে এক মুহূর্তে স্তব্ধ হলেন। তার বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হতে লাগল, সত্যিই তো তাঁর জীবন দীপ নিভে যেতে বসেছে, এখনো তো তার কামনা-বাসনার তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়নি, কীভাবে তাহলে জীবনতরী পার হবেন তিনি, এদিকে যে বেলা যায় যায়!
সেসময় পালকি বাহকরা তাদের বাবুটিকে খুব দ্রুত তালে নদীপারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
লালাবাবু পালকিতে বসে শেষ খেয়ার মাঝির ডাকও স্পষ্ট শুনতে পেলেন, ‘কে যাবে ওপারে, চলে এসো, এটাই শেষ খেয়া’। লালাবাবু বুঝতে পারলেন, এই ডাক শুধু নদীর মাঝির নয়, এই জীবনের ওপারের মাঝিও যেন একইভাবে ডেকে চলেছে।
কী ভেবে লালাবাবু পালকি বাহকদের থামতে বললেন? পালকি থেকে নেমে, সমস্ত জমিদারি প্রচ্ছদ ফেলে এক কাপড়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশে রওনা হলেন। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে একদিন আশ্রয় পেয়েছিলেন বৃন্দাবনধামে। সেখানে নিজের উপার্জনে নির্মাণ করেছিলেন একটি মন্দির। সাধনভজন করে ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করতে থাকেন তিনি।
ইতিমধ্যে তাঁর দেওয়ান এসে অনুরোধ করলেন অর্থ গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণসেবক হয়ে বৃন্দাবনে তাঁর সেবাতেই ব্যয় করতে। আপত্তি করতে পারেননি লালাবাবু। কৃষ্ণসেবার পাশাপাশি শুরু হল আরেক বৃহৎ সেবাযজ্ঞ। মন্দির সংস্কার, ঘাট বাঁধাই, বৃন্দাবনের বহুবিধ সংস্কার কাজ। নিজে মাধুকরী করে অন্ন সংস্থান করতেন। আর মন্দিরে সেবাপূজার সঙ্গে প্রতিদিন সাধু মহাত্মা ও দরিদ্রদের প্রসাদ পাওয়ার ব্যবস্থা হল।
জীবন এমনই আশ্চর্য চিত্রপট। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সকল কামনা-বাসনা দিয়ে নানা ছবি এঁকে চলেছি। যেখানে আমাদের সাধ আর আহ্লাদ ভাঁড়ারে বিন্দুমাত্র টান পড়ে না। তবু সাধ আর সাধ্যের টানাপোড়েন চলেছে নিরন্তর। কিন্তু এত সবের মধ্যেই কোন দিন যে আমাদের মনে বৈরাগ্যভাব জেগে উঠবে, তা আমরা কেউ জানি না। শুধু জানি, যেদিন জেগে উঠবে সেদিন এইসব চিত্রপট ফেলে এক লহমায় আমরা বেরিয়ে পড়ব আসল রূপের সন্ধানে। নিজ ঐশ্বর্যের প্রতি লালাবাবুর বিরাগ তৈরি হলেও, তা তাঁকে জগতের প্রতি বিমুখ করেনি। তিনি আরও বেশি করে জগৎকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কৃষ্ণসেবা ও মানবসেবা– দুই-ই তাঁর জীবনে সমানতালে চলেছে। বৈরাগ্য তাঁকে গৃহত্যাগী করেছে, বিবেক তাঁকে নিঃস্বার্থ করে মানবসেবায় গৃহমুখী করেছে। এমন জীবনের অনুধ্যান আমাদের প্রেরণা জোগায়।
বাংলা ভাষা সেই পাঁচের দশকে যদি বারীন ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’-এর (যেহেতু ‘নাগরিক’-এর মুক্তি পরে) জন্ম দিয়ে থাকে, তাহলে ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় নববসন্তের অস্তিত্ব জানান দিল।