পবিত্রতার বাতিক যাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাঁর এমন দূরবস্থা কেন? কারণ তিনি জীবনযাত্রা বা ধর্মচর্চায় পবিত্রতা রক্ষার বদলে এক অদ্ভুত বিষয়ের পবিত্রতা নিয়ে সদাচিন্তিত। তিনি ‘সুসানসুদ্ধিক’ (শ্মশানশুদ্ধিক)— কোন শ্মশান কতটা পবিত্র, তা-ই নিয়ে তাঁর ঘোর মাথাব্যথা। অনুক্ষণের এই চিন্তা তাঁর মনকে এমন আচ্ছন্ন করল যে, তিনি পরিণত বয়সে এসে ভাবতে শুরু করলেন নিজের শ্মশানের কথা।
বৌদ্ধধর্ম জন্মান্তর মানে। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে বহু জন্মের সুকৃতি সঞ্চয় করে করে বুদ্ধদেব প্রজ্ঞার এমন অত্যূচ্চ উচ্চতা অর্জন করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু কত জন্ম? অধ্যাপক ফৌসবল সম্পাদিত পালি ভাষার ‘জাতকাত্থ বণ্ণনা’ (জাতকার্থবর্ণনা)-য় আছে ৫৪৭টি জাতক-কাহিনি। আর্যশূর খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে সংস্কৃত ভাষায় ‘জাতকমালা’ রচনা করেন। তাতে ৩৪টি গল্প। এছাড়া কিছু প্রাচীন বৌদ্ধশাস্ত্রে আরও কয়েকটি জাতকের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। একই গল্প সামান্য অদল-বদল করে পুনরুক্ত, এমন কিছু নিদর্শন আছে ঠিকই, কিন্তু তবুও বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গৌতম বুদ্ধকে তাহলে মানুষ, অন্য প্রাণী, গাছ ইত্যাদি জীবকুলের নানা প্রজাতিতে অন্তত শ’ পাঁচেক বার জন্মাতে হয়েছে। গড় আয়ু কম করে ধরলেও, তার জন্য পৃথিবীর কোন ঊষাকাল থেকে তবে তাঁর জাতক জীবন শুরু হয়েছে?
থাক এসব কূট প্রশ্ন। বরং প্রবেশ করি রাজগৃহ নগরের পবিত্রতা-বায়ুগ্রস্ত এক ব্রাহ্মণের কাহিনিতে, যিনি শুধু বারবার জন্মগ্রহণই করছেন না, তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও সুকৃতি তাঁর খাতায় জমা না হওয়ায় প্রতিবার ‘টায়ে টুয়ে পাশ করা’ পর্যায়েই রয়ে যাচ্ছেন।
পবিত্রতার বাতিক যাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাঁর এমন দূরবস্থা কেন? কারণ তিনি জীবনযাত্রা বা ধর্মচর্চায় পবিত্রতা রক্ষার বদলে এক অদ্ভুত বিষয়ের পবিত্রতা নিয়ে সদাচিন্তিত। তিনি ‘সুসানসুদ্ধিক’ (শ্মশানশুদ্ধিক)— কোন শ্মশান কতটা পবিত্র, তা-ই নিয়ে তাঁর ঘোর মাথাব্যথা। অনুক্ষণের এই চিন্তা তাঁর মনকে এমন আচ্ছন্ন করল যে, তিনি পরিণত বয়সে এসে ভাবতে শুরু করলেন নিজের শ্মশানের কথা।
নির্দেশ দিলেন, আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন পবিত্রতম শ্মশানে দাহ করা হয়।
তাঁর পুত্র বেদ-এ সুপণ্ডিত। কিন্তু সে-ও এমন কথা কখনও শোনেনি। তাকে ব্রাহ্মণ বুঝিয়ে দেন, যেখানে আগে কোনও শবদাহ হয়নি, সেই ‘অনুচ্ছিষ্ট’ ভূমিই শ্মশান হিসেবে পবিত্রতম।
পুত্র বাবার সঙ্গে তর্কে যেতে চায় না। বলে, তাহলে আমাকে জায়গাটি চিনিয়ে রাখুন।
ব্রাহ্মণ ছেলেকে নিয়ে এলেন গৃধ্নকূট পর্বতে। মগধ থেকে প্রব্রজ্যায় বেরিয়ে বোধিসত্ত্বও তখন সেখানে তপস্যারত। পাতার ছাউনি থেকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ঠাকুর, কোথায় চললেন?
ব্রাহ্মণ সোৎসাহে বললেন, শবদাহে উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়নি এমন এক পবিত্র ভূমি ছেলেকে চিনিয়ে দিতে যাচ্ছি। ও সেখানে আমার অন্ত্যেষ্টি করবে।
চলুন, আমিও তবে চিনে রাখি, কৌতূকের বশে বোধিসত্ত্ব পিতা-পুত্রের সঙ্গী হলেন।
গৃধ্নকূটের চূড়ায় উঠে তিন পাহাড়ের মাঝে এক সমতল জমি দেখিয়ে ব্রাহ্মণ বললেন, ওই সে ভূমি। জায়গাটি চিনে রাখতে ব্রাহ্মণ-পুত্র মনে মনে তাদের যাত্রাপথের রোমন্থন করতে লাগল।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে বোধিসত্ত্ব হেসে উঠলেন। ব্রাহ্মণের চোখে চোখ রেখে বললেন, ওখানে যে কত শব দাহ হয়েছ, তার কোনও হিসেব নেই। আমি নখদর্পণে দেখতে পাচ্ছি, এমনকী, আপনাকেও একবার দাহ করা হয়েছিল এই সমতলে।
আমাকে!
হ্যাঁ আপনাকে। সেই জন্মে আপনার নাম ছিল উপসাঢ়ক। সেবারও রাজগৃহ নগরের এক ব্রাহ্মণকুলেই আপনার জন্ম হয়।
বোধিসত্ত্বর প্রত্যয়ী চোখের দিকে তাকিয়ে ব্রাহ্মণ অপ্রতিভ হয়ে পড়েন।
বোধিসত্ত্ব নরম গলায় বলেন, কেন এমন নিরর্থক বিচারে সময়ের অপচয় করছেন? এই শ্যামল জমির কথা ছেড়ে দিন, পৃথিবীতে এমন কোনও ভূখণ্ড নেই যেখানে মৃত্যুর স্পর্শ ঘটেনি। তারপর একটু চুপ করে থেকে বোধিসত্ত্ব প্রশ্ন করলেন, কোথায় মরণ প্রবেশ করতে পারে না, জানেন?
পিতা-পুত্র জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো তরুণ তপস্বীর দিকে।
যেখানে জন্ম-জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর আনুষঙ্গিক দুঃখ সম্পর্কে সকলে সচেতন, প্রত্যেকে ধর্মের পথে একনিষ্ঠ, আর সংযমে স্থির, কেউ হিংসার বশবর্তী নয়– সেখানে, একমাত্র সেখানেই নিত্য জীবনের জয়গান। সেই জমি কি খুঁজে পাবেন ঠাকুর?
পিতা-পুত্র বোধিসত্ত্ব নমস্কার করে ফেরার পথ ধরলেন। যথার্থ জীবনের সন্ধানে।