ইয়োন ফসে-র লেখালিখির একটি বিশেষ চরিত্রলক্ষণ হল অতিদীর্ঘ বাক্যের প্রতি তাঁর গভীর পক্ষপাত। একদিক থেকে দেখলে, গোটা ‘সেপ্টোলজি’ উপন্যাসটাই লেখা হয়েছে একটিমাত্র বাক্যে, কোনও পূর্ণযতি ছাড়া। এবং সেই বাক্যের মধ্যে, গাণিতিক নকশার মতো, একই ঘটনা বারবার ঘুরে-ফিরে আসে, পুনরাবৃত্ত হয়। পুনরাবৃত্ত হয় বর্ণনা ও সংলাপ। এক আস্লে-র জবানি থেকে, অনায়াসে, অন্য আস্লে-র জবানিতে চলে যায় কাহিনি।
নরওয়ে-সহ সমস্ত স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশের ভূপ্রকৃতির মধ্যে এক ধরনের শীতল কঠোরতা রয়েছে, দিনের হ্রস্বতার কারণে যা প্রায়শ নিষ্প্রভ ও নিরালোক। হয়তো প্রকৃতির এই বিশিষ্ট চরিত্রর জন্যেই, স্ক্যান্ডিনেভীয় সাহিত্যের নান্দনিকতাও এক নিরাভরণ রিক্ততাকে স্পর্শ করে থাকে, যে-রিক্ততা শেষ অবধি আস্তিত্বিক শূন্যতার প্রতীকে পর্যবসিত হয়, এবং তার চরিত্রদের ক্রমাগত ঠেলে দিতে থাকে অন্তহীন নৈতিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের দিকে। ইবসেন, হামসুন থেকে শুরু করে, বর্তমানের ইয়োন ফসে, বা তাঁর একদা-ছাত্র কার্ল ওভে নাউসগার্ডের লেখালিখির মধ্যেও, এহেন একটি প্রবণতা আবিষ্কার করা হয়তো-বা অসম্ভব নয়।
২০২৩ সালে, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে, ইয়োন ফসের নাম বিশ্বের তামাম পাঠকের কাছে খুব একটা যে পরিচিত ছিল, এমন নয়। অথচ নিজের দেশে, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ও অনুবাদক-হিসেবে তাঁর প্রসিদ্ধি বহুকালের। নরওয়ের প্রায় সমস্ত প্রথম সারির সাহিত্য-পুরস্কারই ইতিমধ্যে তাঁর করায়ত্ত। এবং, ইবসেনের পরে, তাঁর নাটকই সে-দেশের রঙ্গমঞ্চে সর্বাধিকবার অভিনীত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখালিখি। তবু, ইংরেজি-ভাষাভাষী দুনিয়ায় তাঁকে নিয়ে মাতামাতির শুরু মাত্রই বছর কয়েক আগে। ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে লেখা ‘সেপ্টোলজি’ উপন্যাসটি যখন ড্যামিয়োন সার্লসের সুযোগ্য অনুবাদ-মারফত ইংরেজি-ভাষার পাঠক ও সমালোচকদের হাতে পৌঁছয়, তখনই তাঁরা ফসে-কে নতুন করে আবিষ্কার করেন, এবং উচ্ছ্বসিত হন। সাত-পর্বের এই সুবিশাল উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি আলাদা-আলাদা খণ্ডে— ‘দ্য আদার নেম’ (পর্ব ১-২), ‘আই ইজ অ্যানাদার’ (পর্ব ৩-৫), এবং ‘আ নিউ নেম’ (পর্ব ৬-৭)। তিনটি বইয়ের শিরোনাম-জুড়ে, আত্ম, অপর ও নামের পৌনঃপুনিক ব্যবহার, আসলে এই উপন্যাসের মূলসুরের ধরতাই।
কাহিনি এখানে যৎসামান্য। প্রৌঢ় চিত্রশিল্পী আস্লে-র বাড়ি নরওয়ের উত্তরে, সমুদ্র-তীরবর্তী এক ছোট শহরে। আস্লে বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান, সম্প্রতি ক্যাথলিক-ধর্মে দীক্ষিত। দিনের অনেকটা সময় সে কাটায় তার অসমাপ্ত ক্যানভাসের সামনে, যার সাদা জমির ওপর, বেগুনি ও খয়েরি রঙে আঁকা দু’টি আড়াআড়ি রেখা একটা ক্রসের আদল নিয়েছে। তার একমাত্র প্রতিবেশী আস্লেইক, পেশায় জেলে। মাঝেমধ্যে আস্লে গাড়ি চালিয়ে পাশের শহরে যায়, আরেক আস্লে-র সঙ্গে দেখা করতে। এই আস্লে নিরাময়হীন মদ্যপ, দু’বার বিবাহবিচ্ছিন্ন, এবং পোষা কুকুরটি ছাড়া আর কোনও সঙ্গী নেই তার জীবনে। এক অনপনেয় মৃত্যুচিন্তা, বলা ভালো মৃত্যুকামনা, দ্বিতীয় আস্লে-কে সারাক্ষণ ঘিরে থাকে। এই দু’টি চরিত্র যে, প্রকৃতপ্রস্তাবে, একই সত্তার দু’টি দিক, একে-অপরের আয়নায় বিম্বিত প্রতিচ্ছবিমাত্র, অথবা ইউরোপীয় সাহিত্যের পরিভাষায় ডপেলগ্যাঙ্গার, সে-কথা অনুমান করে নেওয়া দুঃসাধ্য নয়। এদের ঘটনাহীন জীবন, ধারাবাহিক চিন্তাস্রোত, আলগা কথোপকথন, এবং স্মৃতিরোমন্থনই এই উপন্যাসের একমাত্র কাহিনিগত অবলম্বন।
ইয়োন ফসে-র লেখালিখির একটি বিশেষ চরিত্রলক্ষণ হল অতিদীর্ঘ বাক্যের প্রতি তাঁর গভীর পক্ষপাত। একদিক থেকে দেখলে, গোটা ‘সেপ্টোলজি’ উপন্যাসটাই লেখা হয়েছে একটিমাত্র বাক্যে, কোনও পূর্ণযতি ছাড়া। এবং সেই বাক্যের মধ্যে, গাণিতিক নকশার মতো, একই ঘটনা বারবার ঘুরে-ফিরে আসে, পুনরাবৃত্ত হয়। পুনরাবৃত্ত হয় বর্ণনা ও সংলাপ। এক আস্লে-র জবানি থেকে, অনায়াসে, অন্য আস্লে-র জবানিতে চলে যায় কাহিনি। ‘আমি’ এবং ‘সে’ অনায়াসে একে অপরকে প্রতিস্থাপিত করে— অনবরত বদল হয় আত্ম এবং অপরের অবস্থান— যেন, মুখোমুখি রাখা দুটো আয়নায়, অন্তহীনভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে জীবন। প্রত্যেক পর্বের শুরুতে আমরা দেখি হুবহু একই বর্ণনা, মাত্র কয়েকটি শব্দের হেরফের-বাদে— “And I see myself standing and looking at the picture with the two lines that cross in the middle, one purple line, one brown line, it’s a painting wider than it is high and I see that I have painted the lines slowly, the paint is thick, two long wide lines, and they’ve dripped, where the brown line and purple line cross the colours blend beautifully and drip and I’m thinking this isn’t a picture…”
চেতনাস্রোতের এই ধারাবাহিক প্রবাহের মধ্যেই ঢুকে পড়ে ঘটনা ও সংলাপের টুকরো। ছেঁড়া-ছেঁড়া সংলাপ, যেন থেমে-থেমে, অনেক কষ্টে উগরে দেওয়া হচ্ছে কয়েকটি শব্দ। এবং এই ঘটনা ও সংলাপের কতটা বাহ্য বাস্তবতার বিবরণ, আর কতটা নিছক মনোগত, সে-কথাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল—
“That went well, I say
Yes, um, he says
And there is is silence
You’re not drinking any more? he says”
সংলাপের এই বিশেষ ধরন, আমাদের মনে পড়িয়ে দেবে স্যামুয়েল বেকেটের কথা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, স্যামুয়েল বেকেট যে তাঁর অন্যতম আদর্শ, সে-কথা ফসে নিজেই বহুবার স্বীকার করেছেন। তাঁর লেখার পুনরাবৃত্তিমূলক চলনও বেকেটের লেখার শৈলীকে মনে পড়ায়। বেকেটের বিখ্যাত ট্রিলজি-র (‘মোলয়’, ‘ম্যালোনি ডায়েজ’, ‘দ্য আননেমেবল’) অন্যতম আলম্বনবিভাব ছিল নশ্বরতা, ক্ষয় এবং মৃত্যুচেতনার আস্তিত্বিক অনুসন্ধান। সেই সন্ধান ফসে-র লেখাতেও জারি থাকে। ভাষাকে ব্যবহার করে, এবং ভাষার মধ্যে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে, তিনি আসলে ছুঁতে চান অস্তিত্বের ভাষাতীত রহস্য ও তার বিপন্নতাকে। ঠিক যেভাবে, অসমাপ্ত ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে, শিল্পের পূর্ণতার কাছে পৌঁছনোর আকুতি, শেষ অবধি আস্লে-র আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের প্রতীক হয়ে ওঠে— “It’s always, always the darkest part of the picture that shines the most, and I think that that might be because it’s in the hopelessness and despair, in the darkness, that God is closest to us, but how it happens, how the light I get clearly into the picture gets there, that I don’t know, and how it comes to be at all, that I don’t understand, but I do think that it’s nice to think that maybe it came about like this, that it came to be when an illegitimate child, as they put it, was born in a barn on a winter’s day, on Christmas in fact, and a star up above sent its strong clear light down to earth, a light from God, yes it’s a beautiful thought, I think, because the very word God says that God is real, I think, the mere fact that we have the word and idea God means that God is real, I think…” আমরা বুঝতে পারি, অস্তিত্বের শিকড়সন্ধানের এই অভিযাত্রায় ঈশ্বর একটি নাম, একটি চিহ্নক-মাত্র। এবং এভাবেই, আত্ম, অপর আর একটি নাম একসুতোয় জুড়ে গিয়ে একটি ত্রিভুজের নকশাকে ক্রমশ স্পষ্ট করে তুলতে থাকে।
ইউরোপীয় সাহিত্যে, শৈলীর বিচারে, ফসে যে কোনও নতুন বাঁকবদলের প্রবর্তনা করেছেন এমন নয়। স্যামুয়েল বেকেট থেকে টোমাস বার্নহার্ড অবধি অনেকের কথাই আমরা মনে করতে পারি, যাঁদের আঙ্গিকের সঙ্গে ফসে-র লেখালিখির আদল অনায়াসে মিলে যায়। যদিও মনে রাখা দরকার, সাহিত্য-বিচারের ক্ষেত্রে অভিনবত্ব একটি মাপকাঠি বটে, কিন্তু তা-ই একমাত্র মাপকাঠি নয়। টোমাস মানের লেখার শৈলী, আডালবের্ট স্টিফটার-সহ উনিশ শতকের জার্মান ঔপন্যাসিকদের প্রবর্তিত ধারাকেই অনুসরণ করেছে। এমনকী, বেকেটের লেখার সঙ্গেও হয়তো আরেক আইরিশ লেখক ফ্ল্যান ও’ব্রায়েনের লিখনভঙ্গিমার সাদৃশ্য আবিষ্কার করা যেতে পারে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, মান এবং বেকেট মহৎ লেখক, কেননা প্রচলিত আঙ্গিককে তাঁরা নতুনভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন, তাকে ঘষে-মেজে আরও নিখুঁত করে তুলেছেন, এবং সর্বোপরি, সেই আঙ্গিকের মাধ্যমে তাঁরা পাঠককে নতুনভাবে ভাবাতে সক্ষম হয়েছেন। ফসে-র কৃতিত্বও কতকটা সেই গোত্রের। ফলে, তাঁর নোবেলপ্রাপ্তি, ইউরোপীয় সাহিত্যের সিরিয়াস ও মননশীল ঘরানাটিকেই পুনরায় পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এল, এমন দাবি করা হয়তো খুব একটা অসংগত হবে না।
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব্যাখ্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।’