Robbar

সাতের দশকের কলকাতার ‘মিশ্র’ দৃশ্য অনুভূতি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 11, 2025 9:06 pm
  • Updated:September 11, 2025 9:06 pm  

সুবিমল মিশ্র (১৯৪৩-২০২৩) লেখা শুরু করেন ছয়ের দশকের শেষের দিকে। তিনি বিখ্যাত হতে চাননি। অন্যরকম হতে চেয়েছিলেন। সেই দশকের হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলনের প্রভাব তাঁর লেখায় পড়েছিল। নকশালরা যেমন যা কিছু ‘পবিত্র’, স্থাণু, প্রথাগত, তাকেই ভেঙে ফেলতে শুরু করেন, সুবিমলের লেখায় ধামাধরা সবকিছু নস্যাৎ করার সেই প্রবণতা চূড়ান্ত। অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট এই লেখকের অন্যতম দিক তাঁর অ্যান্টি-স্টোরি। তাছাড়া গোদার, আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।

ঐন্দ্রিলা মাইতি সুরাই

হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ল দৈত্যাকার এক বুট-পরা পা। পিঁপড়ের চোখ দিয়ে দেখা। হাতের মুঠোয় শক্তিশালী লাঠি। পায়ের নীচে বুভুক্ষু একদল পোশাকআশাকহীন দরিদ্র মানুষ; ভয়ে প্রাণ হাতে করে পালাতে চাইছে। পাতার ওপরের অংশে, গাছের নীচে, আশ্চর্য নির্লিপ্তির সঙ্গে বাছুরকে দুধ খাইয়ে চলেছে মা-গরু। বুটের ছবির পাশে বিবরণ– ‘এখন ৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল’। নীচে, ‘বিধাননগরের কংগ্রেস অধিবেশনে গরিবি হটানোর প্রোগ্রাম আশপাশ থেকে ফুটিয়ে দেওয়া হয়েছে বেওয়ারিশ উদ্বাস্তু বাসিন্দাদের’।

পরের পাতাতে জাম্প কাট। পাখির চোখ দিয়ে দেখা। ধর্মতলা অঞ্চলে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে একদল পুলিশ বাঁশপেটা করে সরানোর চেষ্টা করছে কালাপাহাড়ের মতো দুই ষাঁড়কে (যাদের লড়াই একবেলার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা ভণ্ডুল করে দিয়েছে)। এই ঘটনার আগে এবং পরে সাতের দশকের ধর্মতলা অঞ্চলের সংস্কৃতির নানা ছবি– মেট্রো সিনেমার সামনে টিকিটের ভিড়; জাদুঘরের সামনে বেশ্যাপাড়ার দালাল খদ্দের ধরতে ব্যস্ত; দুই ষাঁড়ের লড়াই দেখার জন্য জমায়েতের সুযোগ নিয়ে মহিলাকে যৌন হেনস্তা; তার মধ্যেই আকস্মিক ডায়রি এন্ট্রির মতো ভেসে ওঠে কাহিনিকারের স্বগতোক্তি: ‘সফলতা এলে আমি ভয় পাই, কারণ নতুন কিছু করলে সফলতা সঙ্গে সঙ্গে আসে না’। বা, ‘ঠিক কী ধরনের বিপন্নতা থেকে তৈরি হয় একজন লেখক’– যেন স্ট্রিম অফ কনশাসনেস ভেঙে দেওয়া ধারাবাহিকতা-আকস্মিকতার এক অভূতপূর্ব সমন্বয়। গণপরিসর, ব্যক্তিগত পরিসর মিলেমিশে একাকার হয়।

May be an illustration of text that says '愛ん猪 e 新麻 সুবিমল মিশ্র কোনও কারনেই অধ-মনস্ক মানসিকতা প্রারথী নয়'

যে যুগে বাংলা ভাষা নিজেকে প্রকাশ করতে ভয় পায়নি, এ বই সে যুগের। যে যুগে রীতির বিপরীতে বাংলা সাহিত্য দুর্দান্ত স্পর্ধায় নিজেকে কেটেছে-ছিড়েছে, শার্টের বোতাম খুলে উন্মুক্ত বুকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মাঝরাতে টহল দিয়েছে রাস্তায়, বিনা তোয়াক্কায়, এ বই সে যুগের। একখণ্ড ভূগোলের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক ফালিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ‘সুবিমল মিশ্রর ৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল’: গরিবি হঠাও-ভিয়েতনামের যুদ্ধ-কলকাতা ’৭১-ভারত রক্ষা আইন-অশ্রাব্য গালিগালাজের এক জীবন্ত কোলাজ। গ্রাফিক নভেলটির যৌথ প্রকাশক বৈভাষিক এবং দ্রঃ বিদ্রঃ। মূল কাহিনি সুবিমল মিশ্র। কমিক রূপান্তর করেছেন লেখক ভি. রামাস্বামী এবং সম্বরণ দাস (প্রচ্ছদও তাঁরই করা)। সুবিমলের স্কেচ, হিরণ মিত্রর।

সুবিমল মিশ্র (১৯৪৩-২০২৩) লেখা শুরু করেন ছয়ের দশকের শেষের দিকে। তিনি বিখ্যাত হতে চাননি। অন্যরকম হতে চেয়েছিলেন। সেই দশকের হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলনের প্রভাব তাঁর লেখায় পড়েছিল। নকশালরা যেমন যা কিছু ‘পবিত্র’, স্থাণু, প্রথাগত, তাকেই ভেঙে ফেলতে শুরু করেন, সুবিমলের লেখায় ধামাধরা সবকিছু নস্যাৎ করার সেই প্রবণতা চূড়ান্ত। অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট এই লেখকের অন্যতম দিক তাঁর অ্যান্টি-স্টোরি। তাছাড়া গোদার, আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্ররা যখন বাঙালি পাঠকের মননে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন, বিস্ফোরক-এক্সপেরিমেন্টাল-তীব্র উচ্চারণে, নতুন শব্দের ব্যবহারে হাংরিয়ালিস্টরা যখন এই একঘেয়ে ধারা থেকে বেরতে চাইছেন, এমন প্রেক্ষাপটে প্রবেশ সুবিমল মিশ্রর।

অতীতের পুনঃপাঠ যে কোনও আত্মবিস্মৃত জাতির আত্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণ করে। আজ বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্র যত সংকুচিত আর হতশ্রী হয়ে পড়েছে, তার নিরিখে এমন এক প্রয়াস সাধুবাদের যোগ্য, নিঃসন্দেহে।

উনিশ শতকের পটচিত্র থেকে শুরু করে উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের হাত ধরে বাংলা ছবি-কাহিনির নিজেকে জানান দেওয়ার উদাহরণ ময়ূখ চৌধুরীর ‘মায়াবী’ কমিকস, ওরিজিত সেনের ‘দ্য রিভার অফ স্টোরিজ’, সায়ন্তন ঘোষের ‘লুব্ধক’, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ও শঙ্খ ব্যানার্জির ‘ব্যাস: দ্য বিগিনিং’ এবং ‘পাঞ্চালী: দ্য গেম অফ ডাইস’ বা হর্ষ মোহন চট্টরাজ, সুমিত সুরাই এবং চার্বাক দীপ্ত ও সৌরভ দত্তর সাম্প্রতিক ‘Comকথা’  ও ‘ফেসেস অব ডিফিয়ান্স’-এর মতো কাজের কথা ধরলেও বাংলায় গ্রাফিক নভেলের ইতিহাস সুদীর্ঘ, তবু সংখ্যার নিরিখে বিস্তৃত নয়। বিস্তৃত নয় বাঙালি পাঠকের গ্রাফিক নভেল হাতের মুঠোয় পাওয়ার ক্ষেত্রটিও। সেই কারণেই সুবিমল মিশ্রর লেখা মূল কাহিনিটি গ্রাফিক নভেলের আঙ্গিকে ভাবার নেপথ্যে যে মানুষটি, সেই ভি. রামাস্বামীর লেখা ভূমিকা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নথির কাজ করে।

‘…১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি…’ তাঁর হাতে প্রথম আসে আর্ট স্পিগেলম্যান-এর ‘মাউস’ গ্রাফিক নভেলটি। অচিরেই বাঙালি পাঠকের গ্রাফিক নভেল পাঠের ইতিহাসের ধারা অনুমেয় হয়। সম্ভবত ইন্টারনেট এবং অনলাইন শপিংয়ের দৌলতেই তাঁর হাতে একে একে আসতে থাকে ওসামু তেজুকা, উইল আইসনার, জো সাক্কো, মারজান সাত্রাপি, প্রমুখ। গ্রাফিক নভেলের সংগ্রহের পদ্ধতি এবং তালিকাও একটি নির্দিষ্ট ধারার পাঠকের মনস্তত্ত্ব বুঝতে সাহায্য করে। রামাস্বামী সুবিমলের রচনায় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন চাক্ষিক উপাদান। যা থেকে তাঁর গ্রাফিক নভেলের সিদ্ধান্ত । রামাস্বামী যে কেবল বইটির ভাবনার নেপথ্যে থেকেছেন তা-ই নয়, কমিকসের টেক্সট লেখার কাজটিও সম্পন্ন করেছেন। এই গ্রাফিক নভেলের মূল অলংকরণ শিল্পী, সম্বরণ দাস। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭– দীর্ঘ আট বছর অপেক্ষার পরও যোগ্য শিল্পীর অভাবে হতাশ রামাস্বামী অবশেষে দেখা পেলেন সম্বরণের। ঈশ্বর প্রেরিত। যথার্থ।

সম্বরণ দাস বড় হয়েছেন কলকাতার তালতলায়। সুতরাং, সংলগ্ন ধর্মতলা অঞ্চলের শ্বাস-প্রশ্বাস, গলিঘুঁজি, চায়ের ঠেক, শুঁড়িখানা, রেস্তোরাঁ, নৈশজীবন, রাজনীতি– তাঁর মজ্জাগত; তাঁর শিল্পচর্চায় বারবার রেখাপাত করে বিদ্রুপাত্মক তীর্যকতায়। অন্যদিকে, সাতের দশক ওঁকে তীব্রভাবে টেনেছে বরাবর; যা নিয়ে ওঁর শৈল্পিক পরীক্ষানিরীক্ষা অকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে সাড়া জাগিয়েছিল এই শতাব্দীর প্রথম দশকেই। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার আগে পারফর্ম্যান্সের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঁর প্রতিবাদ, এখনও মনে আছে সহপাঠীদের। এহেন সম্বরণ তালতলা-ধর্মতলা অঞ্চলকে সুবিমলের দেখা কোণ-তল-বাঁক থেকেই দেখেছেন। অলংকরণে সুবিমলের সার্থক চাক্ষিক, বুদ্ধিদীপ্ত অনুবাদ। বইয়ের শেষে ওঁর রচনাটি বিশেষভাবে উল্লেখনীয়– “ ’৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল’ পড়ার পর নিজেরই কোনও অতীত স্মৃতি মনে হয়”, সম্বরণের। আর মনে হয়, “…আদিম পবিত্র সত্যের বিস্ফোরণ যা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান মেনে চলে না, যা প্রাচীন এবং আসুরিক…” সুবিমল ‘সেই শক্তিকেই এই কাহিনিতে হাজির করেছেন।’

এই বই একা সুবিমলকে চেনানোর নয়। পাঠক এখানে আবিষ্কার করে একাধিক লেখক-শিল্পী-প্রকাশক এবং শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের এক সম্মিলিত সাহসী প্রয়াসকে। এক আশ্চর্য সংকটের মুহূর্তে: বাংলা ভাষাকে যখন ভাবা হচ্ছে ‘বাংলাদেশী ভাষা’। দেশের নানা প্রান্তে যখন বিদ্বেষের শিকার বাঙালি।

…………………………

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

…………………………