অমলদার প্রয়াণ– যুগান্ত। কার্টুন, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, রাজনৈতিক কার্টুন বহু দিন হল সংবাদপত্রের পাতা থেকে অন্তর্হিত– আহত ও অবসৃত। শিবরাত্রির সলতের মতো ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিল। কখনও প্রথম পাতায়, কখনও সম্পাদকীয় পাতায়– ‘অমল আলোয়’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে– কাগজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে। এবং অমল চক্রবর্তী ক্রমাগত এনকাউন্টার শানিয়ে গিয়েছেন রাজনীতির পাঁক, পেশিশক্তির আগ্রাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক জলুমের বিরুদ্ধে। অমলান্তে, অগত্যা, সেই সফরে পূর্ণচ্ছেদ বসল।
অভ্যাস বড় বিশ্বাসঘাতক! বাস্তব ভুলিয়ে দিতে চায় একঘেয়েমির অধিকারে। জোয়ার চলে যাওয়ার পরে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে দেখেছি– সিঁড়িতে সিঁড়িতে কাদামাটির পিছল হাতছানি। তখন ভ্রম হয়, এ-ই বুঝি বাস্তব। আসলে তো নয়। টাল সামলাতে না পারলে পঞ্চভূতের প্রবঞ্চনায় পা পিছলে পপাত চ হতে কতক্ষণ!
অফিসে ঢুকতে গিয়ে আজ, বুধবার, ১৮ অক্টোবর, চতুর্থীর রোদ-খসা দুপুরে, তেমনই একটি প্রকাণ্ড আছাড় খেলাম যেন।
একতলা থেকে দোতলায় পৌঁছে তিনতলার সিঁড়ি-রুট ধরার মুখে একফালি বসার জায়গা আছে। বিভিন্ন সময়ে বহু ভিজিটরকে সেখানে বসে থাকতে দেখেছি। অবরসবরে সহকর্মীরাও আড্ডা মারে সেখানে বসে। অন্যদিন অত খেয়ালটেয়াল থাকে না। আজ, স্মৃতির অরণ্য ফুঁড়ে, প্রাগৈতিহাসিক কোনও জন্তু আর্তনাদ করে উঠল। আরে, এখানে বসেই তো অমলদা, ওয়ান অ্যান্ড ওনলি অমল চক্রবর্তী, জিরিয়ে নিতেন মাঝে মাঝে! এবং ওঠা-নামার পথে যার সঙ্গেই দেখা হত, অকৃপণ হাসিতে কুশল বিনিময় করতেন। ‘আপনি এখানে, কেন?’ কেউ একরাশ বিড়ম্বনা নিয়ে জানতে চাইলে সস্নেহে বলতেন– ‘এখন আর একটানা উঠতে পারি না সিঁড়ি ধরে। তাই বসতে হয়। কিন্তু বসে থাকতে ভালোই লাগে। কতজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সিটে গিয়ে একবারটি বসলে তো সে-ই আবার বদ্ধ প্রাণী হয়ে যাব!’
জীবনের সিঁড়ি-ভাঙার অঙ্কে এই হল অদ্বিতীয় অমল-দর্শন। বদ্ধ হতে না চাওয়া। থমকে যেতে না চাওয়া। গতিচক্রের ঘূর্ণন থেকে ছিটকে যেতে না চাওয়া। চলমানের স্রোতে বেণি ভিজিয়ে নেওয়ার তীব্র আকুতি জিইয়ে রাখা।
শিল্পী-পরিচয়ে তিনি কার্টুনিস্ট। কড়াপাকের সংবাদের ফুটন্ত আঁচের সঙ্গে কোলাকুলি সাঙ্গ করতে না পারলে শিল্পের রসদ পাবেন না। তাঁর কাজের প্রকৃতিকে সে-অর্থে ‘অফ দ্য পিপ্ল, বাই দ্য পিপ্ল, ফর দ্য পিপ্ল’ বললে অতিরঞ্জন হয় না। কিন্তু প্রাত্যহিকের দাবি মেটাতে গিয়ে অনেক সময়ই যেটা ঘটে– এই ধরনের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের বিরস ও তিক্ত ঔদাসীন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। যা কখনও কখনও অতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠে শিল্পীকে বাস্তব-বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
অমলদা আদ্যন্ত ব্যতিক্রমী এবং সার্থকনামা– খবরের আগ্নেয়-লাভা রোজ চেখেছেন– অথচ হাসতে ভোলেননি। অন্যদের নির্মল আনন্দে পরিতৃপ্ত রাখার আত্ম-প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হননি। মধুর রস আর কটু রসের গঙ্গা-যমুনাকে কখনও পরস্পরে মিশে যেতে দেননি, আলাদা খাতে ও কিংখাপে বরাবর মুড়ে রেখেছেন। কার্টুন শিল্পগতভাবে তির্যকতার প্রত্যাশী। বিলক্ষণ জানতেন। তাঁর ‘পকেট কার্টুন’ সিরিজ এর সাক্ষ্য দেবে। কিন্তু শিল্পের সেই বক্রোক্তিকে জীবনে কখনও আসন পেতে বরণ করেননি। শিল্প তির্যক হোক, শিল্পী যেন তির্যক-সর্বস্ব না হয়ে ওঠে, এই ছিল তাঁর জীবন-বিশ্বাস। আর, এই কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনপ্রিয়, সর্বজনশ্রদ্ধেয়– ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Peer Respect’– তাঁর সেই ভাঁড়ার কখনও বাড়ন্ত হয়নি।
মাঝে মাঝে মনে হয়– অমলদার স্বভাবে বিপরীতমুখী প্রবণতার মেলবন্ধন ঘটেছিল। কাজ, কাজ, কাজ। শ্মশানের চুল্লি যে গোগ্রাস খিদে নিয়ে অহোরাত্র জ্বলে, তেমনধারার ক্ষুৎকাতরতা ছিল যেন। শরীর-যন্ত্র ঘন ঘন বিগড়েছে, বারবার সান্নিধ্য ছেড়ে দেওয়ার অলিখিত হুমকি দিয়েছে, কিন্তু দুর্গ ভাঙতে পারেনি– অকুতোভয় অমলদা অবিশ্বাস্য মনোবলে কার্টুন করে গিয়েছেন নিরন্তর। আবার, নাগাড়ে এত কাজের শ্রান্তি তাঁকে কখনও পৃথিবী-বিমুখ করেনি। তাই কি বাঙালি পাঠকসমাজ হাতের রেখার মতো করে তাঁকে চিনে নিতে দেরি করে ফেলল?
নিষ্কর, নিরাকার, নিরুপদ্রব জীবনের প্রতি আসক্ত ছিলেন না। চাইলে– দেবাশীষ দেবের মতো অনুজ প্রজন্মের কার্টুন-শিল্পী যেমনটি বলেছেন– ব্যাঙ্কের চাকরির সুস্থিতি ছেড়ে ‘কার্টুনিস্ট’ হিসেবে কেরিয়ার তৈরি করতে পা বাড়াতেন না। আবার হলেন তো হলেন, মন-প্রাণ সঁপে দিলেন ঘনঘোর রাজনৈতিক কার্টুনের আবর্তে। স্বীকার করতে এখন লোভ হচ্ছে– ২০১০ সালের ১১ জুলাই ‘রোববার’ পত্রিকায় ‘ডোডো কিংবা ফিনিক্স’ নামে অমলদার যে-লেখাটি ছাপা হয়েছিল, কথা বলে সেটির অনুলিখন করেছিলাম আমি। মনে পড়ে, পৌনঃপুনিক ব্যগ্রতায় বলেছিলেন এই কথাটি যে, প্রচুর পড়তে হবে। একজন কার্টুনিস্ট যদি রোজ নানা ভাষার ৪-৫টি কাগজ না পড়েন, চক্ষুলাভ হবে না। পড়াশোনার প্রতি এই নিখাদ টান, জগৎ সম্বন্ধে অনর্গল কৌতূহল ও সতেজ কৌতুক তাঁকে ঘষে-মেজে শার্প করেছিল। দেশে-বিদেশে রাজনীতির বৃত্তটি গত কয়েক দশকে যতই পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাক না কেন, অমলদা অনায়াসে তাকে বাগে এনেছেন। ভয়, সংকোচ, পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক কার্টুন এঁকেছেন। আক্ষেপ করেছেন, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়েছে বলে। আরও পড়তে পারলে, শরীরের ব্যামো উপেক্ষা করে রাস্তাঘাটে আরও ঘুরতে পারলে, এর চেয়েও জবরদস্ত পাঞ্চ যে রাজনীতির চোয়ালে ঝাড়তে পারতেন, সে-বিষয়ে তাঁকে প্রবল আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে আমার চিরকাল।
অমলদার প্রয়াণ– যুগান্ত। কার্টুন, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, রাজনৈতিক কার্টুন বহু দিন হল সংবাদপত্রের পাতা থেকে অন্তর্হিত– আহত ও অবসৃত। শিবরাত্রির সলতের মতো ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিল। কখনও প্রথম পাতায়, কখনও সম্পাদকীয় পাতায়– ‘অমল আলোয়’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে– কাগজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে। এবং অমল চক্রবর্তী ক্রমাগত এনকাউন্টার শানিয়ে গিয়েছেন রাজনীতির পাঁক, পেশিশক্তির আগ্রাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক জলুমের বিরুদ্ধে। অমলান্তে, অগত্যা, সেই সফরে পূর্ণচ্ছেদ বসল।
সপ্তসিন্ধুর ওপার থেকে রাজনৈতিক কার্টুনের গোঁয়ার ঢেউ ছুটে এসে লম্ফঝম্ফ করে সংবাদপত্রের অভ্যাসপীড়িত সংসারকে আবার বানভাসি করুক– অমলদা ভারি চাইতেন। অনাগত সেই ভবিষ্যতের দিকে আপাতত আকুল নয়নে তাকিয়ে থাকা। আবার কবে লাগবে– অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া!