Robbar

গেরুয়া লুঙ্গির কাছে গোহারান হেরেছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 10, 2023 9:23 pm
  • Updated:November 10, 2023 9:25 pm  

বুদ্ধিমান সাধুবাবা যখন বুঝে গেলেন তাঁর লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার– যাঁরা তাঁর কথা বিশ্বাস করেন, যাঁরা তাঁর দেখানো পথে হাঁটছেন, সেই এক বিরাট সংখ্যক কনজিউমার বা গ্রাহক তিনি পেয়ে গেলেন তখনই তিনি একটা কোম্পানি তৈরি করলেন। নাম দিলেন বিখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রজ্ঞ মুনিঋষি ‘পতঞ্জলি’র নামে। ‘পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ প্রোডাক্ট’। 

মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়

১২.

বড় বড় ব্র্যান্ডের কপালে ভাঁজ। কারণ, এক সাধুবাবা। বেশ কয়েক বছর আগে, হঠাৎই একদিন টেলিভিশনে সকালবেলার প্রোগ্রামে দেখলাম এক সাধুবাবা যোগাসন শেখাচ্ছেন। প্রাণায়াম, শরীরের নানা ব‌্যাপারস‌্যাপার ইত্যাদি বিবিধ বিষয় নিয়ে উনি আলোচনা করছেন। পরে বুঝতে পারলাম, দেশজুড়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বা তারও বেশি হবে এই প্রোগ্রামটা সকালবেলা দেখেন। যেহেতু আমি বিজ্ঞাপনের লোক, খবর নিতে শুরু করলাম যে, মানুষের ওপর এই অনুষ্ঠান কীরকম প্রভাব ফেলেছে।

জানতে পারলাম– সারা দেশ, বিশেষ করে উত্তর ভারত ভীষণভাবে এই প্রোগ্রামটার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। আস্তে আস্তে সেই চ্যানেলে নানারকম আয়ুর্বেদ ওষুধের কথা বা প্রাকৃতিক খাদ্যের কথা বলা শুরু হল। এখানে লক্ষ করার যে, কীভাবে ঘরোয়া, সাধারণ জীবনে সুস্থ থাকার একটা ‘কনসেপ্ট’ এই সাধুবাবা ধীরেসুস্থে মানুষের মাথায় ঢোকাতে শুরু করলেন।

আরও ব্র্যান্ড বাজাওধর্মতলার সেই ভিক্ষুক যে বিজ্ঞাপনের কড়া স্ট্রাটেজিস্ট

আমরা জানি যে, ভারতীয়দের মধ্যে যুগ যুগ ধরে এই ‘আসন’, ‘প্রাণায়াম’ এবং ‘আয়ুর্বেদ’ সম্পর্কে একটা উচ্চ ধারণা আছে। সেই ধারণাটা কিন্তু ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল। এই সাধুবাবা ভারতীয়দের মনে আয়ুর্বেদ এবং শরীর সুস্থ রাখার যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো, সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার একটা প্রচেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর চিন্তার মধ্যে হয়তো আয়ুর্বেদ প্রোডাক্টের একটা ব্র্যান্ড তৈরি করার ব্যবসায়িক চিন্তাও ছিল। তো, সেই সাধুবাবা ‘মার্কেটিং বিজ্ঞান’ সম্পর্কে অশিক্ষিত হয়েও সাধারণ বুদ্ধিপ্রয়োগ করে মানুষকে কাছে টেনে নিতে সক্ষম হলেন। মিডিয়া ব্যবহারের জ্ঞান ও সময় নির্বাচনের জ্ঞান এতই সুচিন্তিত ছিল যে, লক্ষ লক্ষ মানুষের নজর কাড়তে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে সময় লাগল না। আমরা যখন ‘ব্র্যান্ড’ বা ‘বিজ্ঞাপন’ নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, তখন প্রথম কাজই হয়, যে কোম্পানি প্রোডাক্ট তৈরি করছে ও বাজারে আনছে, সেই কোম্পানির ওপর আস্থা বা বিশ্বাসটা বাড়ানো। গ্রাহক যদি বিশ্বাস করে সেই কোম্পানিকে, তাহলে তার প্রোডাক্টগুলো কিনতেও দ্বিধা করবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, টাটা কোম্পানি। টাটা কোম্পানি যাই তৈরি করুন, মানুষ কিন্তু সেটা অবিলম্বে গ্রহণ করে।

এবার যা ভাবা, সেই কাজ। বুদ্ধিমান সাধুবাবা যখন বুঝে গেলেন তাঁর লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার– যাঁরা তাঁর কথা বিশ্বাস করেন, যাঁরা তাঁর দেখানো পথে হাঁটছেন, সেই এক বিরাট সংখ্যক কনজিউমার বা গ্রাহক তিনি পেয়ে গেলেন তখনই তিনি একটা কোম্পানি তৈরি করলেন। নাম দিলেন বিখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রজ্ঞ মুনিঋষি ‘পতঞ্জলি’র নামে। ‘পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ প্রোডাক্ট’। এই পতঞ্জলি ব্র্যান্ডের অনেক প্রোডাক্ট বাজারে আসতে শুরু করল। যেমন দাঁতের মাজন, মাথার তেল, মধু ইত্যাদি নানা ধরনের প্রোডাক্ট, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে তৈরি করে তিনি যখন বাজারে ছাড়লেন তখন তাঁর বিশাল ফলোয়াররা কিনতে শুরু করল। ‘পতঞ্জলির’ প্রোডাক্টের জনপ্রিয়তা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। যে সমস্ত নামী কোম্পানি এই ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহৃত প্রোডাক্ট বাজারে বিক্রি করতেন, তাঁদের বিক্রি কমতে শুরু করল।

আরও ব্র্যান্ড বাজাও: ‘টাটকা’ সবজি ‘জ্যান্ত’ বললে বিক্রি বাড়ে, এটাও বিজ্ঞাপন

আমাদের সাধুবাবা হয়ে গেলেন ‘ব্র্যান্ড গুরু’। বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি চিন্তিত হতে শুরু করল। কারণ তাদের তৈরি দাঁতের মাজন বা মাথার তেল ইত্যাদির বিক্রি কমে যাচ্ছে এবং এই পতঞ্জলি প্রোডাক্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা পারছে না। একবার ভেবে দেখুন। একজন সাধুবাবা তথাকথিত মার্কেটিং, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট জানা স্যুটেড-বুটেড বড় সাহেব না হয়েও শুধু আসন, আয়ুর্বেদ আর গেরুয়া লুঙ্গির জোরে এক বিশাল আয়ুর্বেদ প্রোডাক্টের দেশজোড়া বাজার তৈরি করলেন যাঁর বাৎসরিক টার্নওভার ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আজকের সময়ে এঁকে ‘ব্র্যান্ড গুরু’ বলবেন না তো কাকে বলবেন ? যারা এখন ভারতের সবথেকে বেশি বিজ্ঞাপিত, সবথেকে বেশি বিক্রিত দাঁতের মাজন তৈরি করে, তাদের মাথা ঘুরে গেছে এই নিরক্ষর সাধুবাবার কাণ্ডকারখানায়।