ভোররাতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। এমন সময় ঘুমটা ভাঙল কেন? কে জানে, হয়তো আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় হয়তো আমায় জাগিয়ে তুলেছিল। ঘুম ভেঙে চোখ চলে গেল রান্নাঘরের জানলার দিকে। আর মুহূর্তের মধ্যে ঘুমের রেশ আর রইল না। বড় বড় চোখ মেলে দেখলাম যে, রান্নাঘরের জানলার গ্রিল বাইরে থেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা অবয়ব। লিখছেন বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
আমি কর্মসূত্রে বেশ কয়েক বছর বেঙ্গালুরুতে ছিলাম। জে পি নগরের এক ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতাম। বিল্ডিংয়ের লাগোয়া রাস্তার পাশেই একটা বড় পাঁচিল। পাঁচিলের অন্যপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা সুদৃশ্য চার্চ। চার্চের দিকটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলে কী হবে, বাড়ির পিছন দিকটায় নোংরা আগাছার জঙ্গল। চার্চের জমি ও ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা বলে ফ্ল্যাট বাড়িটায় বেশ একটা অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করত।
সত্যি কথা বলতে কী, বেশি শব্দ আমি একদম পছন্দ করি না; কিন্তু এমন অতিরিক্ত চুপচাপ পরিবেশও আমার অসহ্য লাগে। বিশেষ করে আমি যেহেতু তিনতলায় একা ভাড়া থাকতাম, তাই সন্ধে হয়ে গেলেই আমার বেশ ভয়-ভয় করত। একটু মানুষের কথাবার্তা, সামান্য কোলাহল শোনার জন্য মনটা আনচান করত। যাই হোক, কী আর করা যাবে। ব্যাচেলর জীবন যখন, তখন এমনি করেই একা থাকার অভ্যেস করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। সুতরাং এই নিরিবিলি পরিবেশেই মানিয়ে নিয়েছিলাম। দিনগুলো এক এক করে বেশ কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে ঘটে গেল কিছু অন্যরকম ঘটনা।
পড়ুন আরও ১৪ ভূতের গপ্প: আমার ঘরের সেই হঠাৎ অতিথি
ফ্ল্যাট-বাড়ির পেছন দিকে যে আগাছার জঙ্গল ছিল, আমার রান্নাঘরের জানলা থেকে সেই জঙ্গলের অনেকটাই দেখা যেত। আমার ঘরে আলো-বাতাসের সমস্যা থাকায় রান্নাঘরের জানলাটা খোলাই থাকত। কেবল ঝড়-বৃষ্টি হলে বন্ধ করতাম। একদিন দুপুরে রান্না করতে করতে হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সবুজ আগাছার দিকে তাকিয়ে থাকতে চোখের বেশ আরাম হচ্ছিল। হঠাৎ চোখটা আটকে গেল এক জায়গায়। সবুজ ঝোপের মাঝে ওটা কে? ভালোভাবে লক্ষ করে দেখলাম যে, একটা লোক আমার জানলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। লোকটার মুখে কাঁচাপাকা চুল, গাল ভর্তি দাড়ি। গায়ের ছেঁড়া জামায় দারিদ্রের মানচিত্র ফুটে উঠেছে। আমিও লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে লোকটা কেমনভাবে যেন হাসল। বড়ই অদ্ভুত সেই হাসি। মনের গভীর পর্যন্ত যেন অসাড় হয়ে যায় কাউকে এমন হাসি হাসতে দেখলে। আমি কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি জানলার সামনে থেকে একটু আড়ালে দাঁড়ালাম। নিজেকে অভয় দিতে বলে উঠলাম, ‘যত্তসব পাগল!’
পড়ুন আরও ১৪ ভূতের গপ্প: মৃতদেহটা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি
হ্যাঁ, পাগল ভেবেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম লোকটার কথা। এরপর রান্নাবান্নার দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনলাম। একটু বাদে গরম খিচুড়ি খেতে খেতে জানলা দিয়ে লোকটাকে দেখার ঘটনা প্রায় ভুলেই গেলাম।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। আগাছার জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা বড় পাঁচিল ছিল। পাঁচিলের ওপাশে একটা ইশকুলের মাঠ। প্রতি রবিবার বিকেলে সেখানে ক্রিকেট খেলা হত। এক রবিবার আমি ছাদে গেছি। ছাদ থেকে বিকেলের বয়ে আসা বাতাস উপভোগ করছি আর দূরের ক্রিকেট খেলা দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল বাড়ির নীচের আগাছার জঙ্গলের দিকে। দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত পাগলটা! তার দু’-চোখের দৃষ্টি অন্য কোথাও আবদ্ধ নেই। সে চেয়ে আছে আমারই দিকে! আর তার মুখে সেই ভয়ানক হাসি। আমার বুকে যেন তীর এসে বিঁধল। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে আমি একরকম ছিটকে সরে এলাম ছাদের ধার থেকে।
পড়ুন আরও ১৪ ভূতের গপ্প: আঁধার রাতের অচেনা সঙ্গী
সেদিন রাতের বেলায় রান্না করতে করতেও আর জানলার ধারে যেতে ইচ্ছে করল না। একটা অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল। এবার মূল ভয়ের ঘটনাটায় আসি। আরও কয়েকদিন পরে সেটা ঘটল। ব্যাঙ্গালুরুতে তখন ভালোই গরম পড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। একদিন রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পরেই কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকারে আর কতক্ষণ বসে থাকব। গায়ে-মাথায় জলের ছিটে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাইরের হাওয়া যাতে ভালোভাবে ঘরে আসে, তাই রান্নাঘরের জানলাটাও হাট করে খুলে দিলাম। আমি বিছানার যেখানে মাথা করে শুয়েছিলাম, সেখান থেকে রান্নাঘরের জানলাটা ভালোই দেখা যাচ্ছিল। গরম লাগা সত্ত্বেও মৃদু হাওয়ার ছোঁয়ায় ঘুম এসে গেল। বেশ ঘুমোচ্ছিলাম। কিন্তু ভোররাতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। এমন সময় ঘুমটা ভাঙল কেন? কে জানে, হয়তো আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় হয়তো আমায় জাগিয়ে তুলেছিল। ঘুম ভেঙে চোখ চলে গেল রান্নাঘরের জানলার দিকে। আর মুহূর্তের মধ্যে ঘুমের রেশ আর রইল না। বড় বড় চোখ মেলে দেখলাম যে, রান্নাঘরের জানলার গ্রিল বাইরে থেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা অবয়ব। তার জ্বলন্ত চোখ আর খোলা মুখ থেকে কেমন যেন লাল আলো নির্গত হচ্ছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল দৃশ্যটা। চিৎকার করে উঠলাম। এবং সেই অবয়বটা হঠাৎ করে মিলিয়ে গেল। আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম এবং এক ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করলাম। আমি থরথর করে কাঁপছিলাম।
বাকি রাতটুকু বিছানায় বসে কাটিয়ে দিলাম। সকাল হতেই আমি সাহস করে জানলা খুলে চারদিক দেখলাম। ঘনসন্নিবিষ্ট আগাছার ভেতর আমার চোখ খুঁজছিল সেই ভয়ংকর পাগলের অবয়ব। না, সে কোথাও নেই।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী