জ্যোতি বসু বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তা একবাক্যে স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায়ের পাশাপাশি রামকৃষ্ণ, অনুকুল ইত্যাদি বালক এবং সাবালক বাবাজিদের অবাধ প্রবেশ ঘটেছিল মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। আটের দশকে ‘সন্তোষী মাতা’ নামক একটি অবাঙালি ‘দেওতা’ও আটপৌরে ঠাকুরঘরে চিলতেখানেক ঠাঁই পায়। ক্যালেন্ডারে দাগ মেরে হপ্তায় নিরামিষ ভক্ষণ এবং তজ্জনিত অপুষ্টির কারণে কোটি কোটি বাঙালির বেরিবেরি, ফাইলেরিয়া, হুপিংকাফ ইত্যাদি ভয়ানক রোগে ভূপতিত হয়ে মৃত্যুবরণের সেই দিনগুলিতেই গরুকে ছোলা খাওয়ানোর অশুভ সুচনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
১৪.
আমার গোটা শৈশব-কৈশোর কেটেছে অবাঙালিদের মধ্যে, পরে কর্মক্ষেত্রেও তাদের পেয়েছি প্রচুর। ছোটবেলায় বাড়িতে ডাল, ভাত, মাছ, চচ্চড়ি, ইডলি, দোসার পাশাপাশি গুরুং বস্তিতে শুয়োর খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে ফিরলে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে মনে পরে না। তারপর কখন গোয়ান অ্যালবার্টের মাধ্যমে মার্জিপানের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, বা চালের রুটি দিয়ে গরুর ভিন্ডালু এবং সোরপোতেল খেয়ে ওফালসের প্রেমে পড়েছি হেড ওভার হিলস– সে আর মনে নেই। বাড়িতে হিন্দি সংস্কৃতি নিয়ে যে ভ্রুকুঞ্চন, তার অনেকটাই দেশভাগ এবং নেহরু-বিদ্বেষের কারণে, এবং পরবর্তী কালে ইন্দিরার এমার্জেন্সি দ্বারা পরিপুষ্ট। বাঙালির জীবনে, বিশেষ করে উদ্বাস্তু পরিবারে বড় হয়ে ওঠার কালে উপরোক্ত ক্যাটালিস্ট দিয়ে গোটা পৃথিবীর বিশ্লেষণ শুধুমাত্র কর্তব্য ছিল তাই নয়, প্রতি পদক্ষেপে ‘এক চড় মাইরা দাঁত ফালাইয়া দিমু’ বলাটাও ছিল সমান জরুরি।
তুলনায় কেরালিয়ানরা স্মিত হেসে পাশ কাটানো টাইপ– তবে সেটা ‘ইয়েস’ এবং ‘নো’ ছাড়া শব্দভাণ্ডারে অন্যান্য বিবিধ রতনের আশ্চর্যজনক অনুপস্থিতির জন্যই কি না, বলতে পারব না। তবে নিজেদের মধ্যে বেশ কথা বলত অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘাড় নেড়ে, সেটা খেয়াল করেছি। বিহার-উত্তরপ্রদেশের কাকিমারা শুধু লাউ দিয়ে কীভাবে যে অমন অমৃত রাঁধতেন এবং পাঞ্জাবিদের ঘরে ঢুকলেই, তা সে দিল্লিই হোক বা কোয়েম্বাটোর কেন, সেই একই বেনি পাকাইয়া শিরে মশলায় সম্বার দেওয়ার গন্ধ গত ৩০০ বছর যাবৎ পাওয়া যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমি একেবারেই অবগত নই। তবে সকলের ঠাকুমা-দিদিমারাই রোদে পিঠ দিয়ে গোটা দুপুর উল বুনে আড্ডা মারতেন। তাঁদের কলহাস্যে আমাদের জনপদটি মুখরিত হয়ে থাকলেও, এঁদের কেউই যে অন্য কারও ভাষার একটি শব্দও কখনও ওই জমায়েতে শামিল হওয়ার আগে এমনকী শোনেনওনি, সে নিয়ে হাসিঠাট্টা প্রচলিত ছিল। তবে কাউকে সেভাবে বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখিনি– সেটাও কম আশ্চর্যজনক নয়।
আমাদের বাপ-মায়েরা কম্প্রোমাইজড হিন্দু—ক্ষত্রিয় ছিল অনেকেই, ‘খতরে মেঁ’ মনে হয়নি কাউকেই– বা কারও চাইতে এক ছ’টাকও কম বাঙালি ছিল না। জ্যোতি বসু বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তা একবাক্যে স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায়ের পাশাপাশি রামকৃষ্ণ, অনুকূল ইত্যাদি বালক এবং সাবালক বাবাজিদের অবাধ প্রবেশ ঘটেছিল মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। আটের দশকে ‘সন্তোষী মাতা’ নামক একটি অবাঙালি ‘দেওতা’ও আটপৌরে ঠাকুরঘরে চিলতেখানেক ঠাঁই পায়। ক্যালেন্ডারে দাগ মেরে হপ্তায় একরোজ নিরামিষ ভক্ষণ এবং তজ্জনিত অপুষ্টির কারণে কোটি কোটি বাঙালির বেরিবেরি, ফাইলেরিয়া, হুপিংকাফ ইত্যাদি ভয়ানক রোগে ভূপতিত হয়ে মৃত্যুবরণের সেই দিনগুলিতেই গরুকে ছোলা খাওয়ানোর অশুভ সূচনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, এবং সেটিই ডিভাইনের নামে বোভাইন সংস্কৃতির– হোলি গাউ– গুঁতিয়ে অনুপ্রবেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপও হয়তো।
পড়ুন ভয়বাংলা-র আগের পর্ব: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
এই ন্যাজে মোচড় অবাঙালিদের কাজ নয়। অন্তত, চারপাশে যাদের মধ্যে সর্বক্ষণ ওঠাবসা, তারা কেউ বাঙালিদের মতো নর্থ ইন্ডিয়ার সমস্ত বিজাতীয় ঠাকুর-দেওতা নিয়ে একযোগে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেনি কদাপি। বাঙালিরা পুজো সেরেই ক্ষান্ত দেবে, তা নয়, এয়াঁরা যে একেবারে সুজ্জোলাং সাফোলাং নিজ্জোলাং– সেইটে সকলকে না জানানো অবধি সে কী ছটফটানি, এমনকী, পেটেন্ট নেওয়া চোঁয়া ঢেকুরও উঠতে চায় না! ফলে দুর্গা এবং কালীর পর সরস্বতীও রাস্তায় জিলেলে মাইফেলে সহাঁশসো উপস্থিত– সঙ্গে শনি, সন্তোষী, জগদ্ধাত্রী, বৈষ্ণোদেবী, হনুমান, রাম, গণেশ, কার্তিক, লোকনাথ, সচিন, সৌরভ ইত্যাদি, প্রভৃতি, হারহাভাতি। শুধু দ্রোপদী টাইপের মহিলাদের কাপড় খোলাটা মোবাইল ফোনে আটকে রাখা গেছে– আপাতত। বাকিরা করবা চৌথ। চালুনিস্কোপ ফিট করে চাঁদের অন্ধকার পশ্চাদ্দেশ দেখছে। অতএব নতুন গয়না, শাড়ি, মোবাইল, ল্যাপটপ, কিচেন ক্যাবিনেট, ওয়াটার পিউরিফায়ার। এর কোনও একটা না কিনলে যথেষ্ট সাকসেসফুল স্বামী অথবা স্ত্রী নন। আগে-পরে ধনতেরাস। গয়নার বিজ্ঞাপন জানায় কীভাবে জাস্ট কয়েকটা গয়না কিনতে পারলে নেইবার মহিলার চাইতেও অনেক বেশি সতী সাধ্বী সেক্সি আপনি… ভবিষ্যতে আরও বড়লোক হওয়ার বাসনায় আবার নতুন জুয়েলারি… সব ডটাররাই গাইছে ‘আই অ্যাম এ গ্রোয়িং ম্যামারি, ইয়ে, মানে, যে দেয় আমি তারই।’
এর কোনওটার সঙ্গেই আমার আজন্ম পরিচিত, আদরে-আহ্লাদে আগলে রাখা অবাঙালিদের কোনও সম্পর্ক নেই। ছেলেবেলায় যে রেল কলোনির মাঠে খেলতে যেতাম, তার গায়ে বিহারি বস্তির বাসিন্দারা সন্তোষী মাতা বা করবা চৌথ সম্বন্ধে এখনও হয়তো কিছুই জানে না– অন্তত মেট্রো সিটির মধ্যবিত্ত হিন্দু উন্নতিশীল বাঙালি মহিলাদের থেকে যে কম জানে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সাধ্যমতো একটু কলা, চাল, সিঁদুর নিয়ে এয়ারপোর্ট মোড়ের পিছনে নদীর পারে ছট পুজোর সামান্য আয়োজন ছিল তাদের। ডেকে ঠেকুয়াও দিতেন, আবার বাঙালিদের মতো নারকেলের নাড়ু। আপনাদের কি কখনও মনে হয়েছে হাওড়া-শেয়ালদা স্টেশনের কুলিরা, অথবা গঙ্গা-তীরবর্তী চটকলের পশ্চিমা শ্রমিকরা, বা এই কলকাতার রাস্তায় টানা রিকশা, ঠেলা, ভ্যানচালক অবাঙালি মজুরের দল রাম মন্দির বা ‘হিন্দুরা বিপন্ন’ জাতীয় ক্রাইসিসে দীর্ণ? আপনাদের কি এরকমটাও কখনও মনে হয়েছে যে কোভিড-কালে দক্ষিণ ভারত থেকে পায়ে হেঁটে যে পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র বা গুজরাতে ফিরছিল গোটা সংসার বয়ে, পুলিশের মার খেয়ে, না খেয়ে, তারা আসলে ‘সনাতন’ ধর্মের গোপন– মানে এমআই সিক্সের মতো— এজেন্ট? কহ হে দেবী অমৃতভাষিণী..
গত সংখ্যায় যে ‘অবাঙালিদের’ গালাগাল করেছি, বিলবোর্ড ছাড়া তাদের কোনও দেশ নেই। তারা কখনও বিহারিদের নামে দলিতের মৃতদেহ আর বিয়ের লেহঙ্গা শেরওয়ানি বেচে, আবার কখনও গুজরাতিদের নামে গোধরা এবং হিরের নেকলেস পরে ঘুরে বেড়ানোর ইতালিয়ান মার্বেলে মোড়া ডুপ্লে। বুলডোজার ধামসানো ঝুপড়ির পাশে গাছ থেকে ঝুলন্ত দলিত মেয়ের ধর্ষিত মৃতদেহ না দেখালে ইউপিবাসীদের রাম মন্দির চত্বরে নাচতে যাওয়ার স্বর্ণালংকার বিক্রি করা যায়? আমরাই ক্রেতা– ক্রেতাদাস। পাশাপাশি বিহারিদের গায়ে ‘ছাতুখোর বস্তিবাসী’, মারোয়াড়িদের ‘মোটকা মুনাফাখোর’, দক্ষিণ ভারতীয়দের ‘অর্থডক্স ইমলিখোর’ ছাপ মেরে ‘মচ্ছিখোর’ বাঙালিদের উসকাও। সবাইকেই সবার বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানোর জন্য প্রস্তুত করো। প্রত্যেকেই আস্ত মশাল। সবার ঘরেই কেরোসিনের টিন। এরা দিল্লি, বোম্বাই, কলকাতা, পাঠানকোট, লোহোর, করাচি সর্বত্র নতুন ধর্মের সংস্কৃতি এবং সেটাকে বয়ে নিয়ে চলা নির্মলা অর্থনীতির ভারবাহী গাধা। বাঙালি ভয় পাবে কি না, ভেবে দেখুক।