ধ্রুপদ’ ছিল আমাদের ক্ল্যাসিক্যাল কণ্ঠসংগীতের আঙ্গিক, ‘খেয়াল’ ছিল না তখনও। ধ্রুপদ তখনও খুব নিয়মে বাধা। কণ্ঠের কালোয়াতি-সর্বস্ব। এবং সচরাচর ভক্তিরসের– অন্তত কথার দিক দিয়ে। গানের কথার দিক দিয়ে তা ম্লান। এবং তার মধ্যে যথেষ্ট তাল ঠোকাঠুকির ব্যাপার ছিল, যা সম্ভবত সেই সময় মোঘল সম্রাটের দরবারে আর বিশেষ সমাদর পাচ্ছিল না। সম্রাট সম্ভবত চাইছিলেন, আরেকটু হালকা রসের কিছু হোক।
১.
‘খেয়াল’ আঙ্গিকটি আমরা জানতে পারি লিখিত ইতিহাস থেকে। খেয়ালের সৃষ্টি হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ্বে, মোঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গীলার দরবারে। ‘ধ্রুপদ’ ছিল আমাদের ক্ল্যাসিক্যাল কণ্ঠসংগীতের আঙ্গিক, ‘খেয়াল’ ছিল না তখনও। ধ্রুপদ তখনও খুব নিয়মে বাধা। কণ্ঠের কালোয়াতি-সর্বস্ব। এবং সচরাচর ভক্তিরসের– অন্তত কথার দিক দিয়ে। গানের কথার দিক দিয়ে তা ম্লান। এবং তার মধ্যে যথেষ্ট তাল ঠোকাঠুকির ব্যাপার ছিল, যা সম্ভবত সেই সময় মোঘল সম্রাটের দরবারে আর বিশেষ সমাদর পাচ্ছিল না। সম্রাট সম্ভবত চাইছিলেন, আরেকটু হালকা রসের কিছু হোক। অত ‘মাথাধরা ব্যাপার’ আর ভালো লাগে না। আরবি, ফারসিতে ‘খেয়াল’ কথাটার মানে হল খেয়াল, স্বাধীনতা, কল্পনা। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘সংগীতকল্পতরু’ গ্রন্থে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, আমার সেটা খুবই পছন্দের। বিবেকানন্দ বলছেন, খেয়াল হল ‘ইচ্ছে’ এবং ‘স্বাধীনতা’।
এই ‘খেয়াল’ আঙ্গিকটি তৈরি করার জন্য; হয়তো তখনই ‘খেয়াল’ নাম ছিল না, কিন্তু মোঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গীলা তাঁর রাজসভার দুই সংগীত শিল্পীকে দায়িত্ব দেন। কথাগুলো কীভাবে লেখা হবে সে নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাগ তো রয়েছে, এবার তৈরি হবে আঙ্গিক। কথাগুলোর জন্য সেই সংগীত শিল্পীরা ব্যবহার করলেন আওয়াধি ভাষা– যা একটি হিন্দুস্থানি ভাষা। এই আওয়াধি ভাষায় লেখা ‘পদ্মাবৎ’ থেকে তাঁরা লাইন ধার করে নেন। ‘পদ্মাবৎ’ মহাকাব্য থেকেই কিন্তু আমাদের বাংলার কবি সৈয়দ আলাউল তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যটি লিখেছিলেন।
এখন মহম্মদ শাহ রঙ্গীলার দরবারের দুই শিল্পী– তাঁরা এই আওয়াধি ভাষার পদ্মাবৎ কাব্য থেকেই তো লাইন ধার করলেন। স্বামী বিবেকানন্দ, আবার তাঁর দ্বারস্থ হচ্ছি, কারণ তিনি সবচেয়ে সংক্ষেপে খুবই সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে, এমন কিছু সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, দুই লাইনের স্থায়ী, দুই লাইনের অন্তরা– এটা বাংলায় হবে না কেন? সেই তখন থেকেই স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু বাংলায় খেয়ালের পক্ষে ছিলেন। আশ্চর্য, আমরা স্বামী বিবেকানন্দর নাম মাঝে মাঝেই নিই, নানা অনুষঙ্গে, কিন্তু বাংলা ভাষায় খেয়ালের ব্যাপারে তাঁর যে বক্তব্য– সেটাকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিই না। যেটা দেওয়া দরকার। ইচ্ছে এবং স্বাধীনতা। ইচ্ছে-স্বাধীনতা। দুই লাইনের স্থায়ী, দুই লাইনের অন্তরা। বাংলায় খেয়াল হইবে না কেন?
কালক্রমে তো শুধু সেই আওয়াধি ভাষার মহাকাব্য থেকে ধার করে নেওয়া দু’লাইন-দু’লাইনে খেয়াল আটকে থাকল না। নানা ভাষায় খেয়াল রচনা হতে থাকল। কারণ এই আঙ্গিকটি লোকের ভালো লেগে গেল। অনেকেই বলে থাকেন, পণ্ডিতরাও, যে, হজরত আমির খসরু যিনি কাওয়ালির উদ্গাতা, তাঁরও অবদান ছিল খেয়ালে। সত্যিই খেয়ালে তাঁরও যথেষ্ট অবদান ছিল। কাওয়ালি এবং খেয়াল– দুটোরই কিন্তু একটা মুক্ত জায়গা রয়েছে। ছন্দপ্রধান এবং কি কাওয়ালি, কি খেয়াল– একভাবে চলে না। একটা বিশেষ তালে, একটা বিশেষ ছন্দে চলতে চলতে যাঁরা গাইছেন, তাঁরা তাঁদের নানা অবদান রাখতে থাকেন। তাঁরা এটা জুড়ে দেন, সেটা জুড়ে দেন, ভারি চমৎকার লাগে শুনতে! এক থাকে না– বৈচিত্রপূর্ণ। সারাক্ষণ নানা রং, ক্ল্যালাইডোস্কোপের মতো নানা রঙের খেলা হতে থাকে।
যে ভাষাগুলিতে খেয়াল বন্দিশ বা খেয়াল গান রচনা হতে থাকে, সেগুলি প্রথমত ব্রজবুলি। অর্থাৎ, রাধা-কৃষ্ণ যে-ভাষায় কথা বলতেন। ব্রজবুলি, ব্রজোবুলি বা কেউ কেউ বলেন ব্রেজ। ব্রজবুলি, মৈথিলি, ঠিট– এই তিনটি ভাষা বা ডায়ালেক্ট বলতে পারেন। এই যে ব্রজবুলি হলে মেরো, তেরো– এইসব কথা দিয়ে যে গান। এছাড়াও পাঞ্জাবের পাঞ্জাবি এবং মুলতানি। অন্যদিকে মারাঠি। হিন্দুস্থানি রাগসংগীতের খেয়াল আঙ্গিকের যিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর– সেই পণ্ডিত ভাতখণ্ডে, তিনি মারাঠি ভাষায় লিখেছিলেন খেয়াল। তারপর সেগুলি হিন্দিতে বা হিন্দির কোনও একটা ফর্মে– বলা টলে, অনুবাদ করা হয়। উল্লেখ করা দরকার যে, পণ্ডিত ভাতখণ্ডে বাংলার শ্রী কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় ‘গীতসূত্রসার’ বইটি পড়ার জন্য, পড়তে পারার জন্য বাংলা ভাষাটি শিখেছিলেন।
তাহলে পাঞ্জাবি, মুলতানি, ব্রজবুলি, ঠিট, মৈথিলি এছাড়াও হিন্দুস্থানি ভায়ার তাহলে রচিত হয়ে চলল খেয়াল। আমরা ভারতে যেটাকে হিন্দুস্তানি বলি, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে এটাকে ‘উর্দু’ বলা হয়। ভারতেও কেউ কেউ উর্দু বলেন, কিন্তু হিন্দুস্তানিই বলা হয় বেশি। সেই হিন্দুস্থানি ভাষায় বা উর্দু ভাষায় অন্যদিকে পস্তু, দরি। অন্যদিকে সিন্ধি। দিকপাল এক ওস্তাদ উমিদ আলি খান সাহেবের খেয়াল গান যদি ইন্টারনেটে খুঁজে নেন, দেখবেন, সেখানে শ্রোতারা কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, তিনি তাঁর নিজের ভাষা সিন্ধিতে খেয়াল গেয়েছেন– লেখা আছে। যেমন ধরুন, বড়ে গুলাম আলি খান সাহেবের যে খেয়াল আছে, খেয়ালের রেকর্ডিং ইন্টারনেটে আছে– সেখানে দেখবেন একাধিক জায়গায় লেখা রয়েছে যে, বড়ে গুলাম আলি খান সাহেব পাঞ্জাবি ভাষায় বন্দিশ গাইছেন।
তাহলে দেখতে পাচ্ছি, একেবারে খোদ আমাদের নাগালের মধ্যেই একদিকে ওস্তাদ উমিদ আলি খান সাহেব পাকিস্তানের গায়ক, অন্যদিকে বড়ে গুলাম আলি খান সাহেব– একজন সিন্ধি আর একজন পাঞ্জাবিতে খেয়াল গাইছেন। এছাড়াও রাজস্থানি ভাষায় খেয়াল লেখা হয়েছে, গাওয়া হয়। কন্নড় ভাষায় হয়, হয়েছে। তবে এতগুলো ভাষায় খেয়াল রচনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এর বাইরে হিন্দি– যেটাকে আমরা বলি, হিন্দিতে খেয়াল। খোদ হিন্দিতে কিন্তু সনাতনভাবে দেখতে গেলে, আমাদের ইতিহাসের দিক দিয়ে দেখতে গেলে খোদ হিন্দি খড়িবুলিতে কিন্তু খেয়াল গাওয়া হয়নি ততটা। কোনও না কোনও আশ্রিত ভাষায় বা ডায়ালেক্টে গাওয়া হয়েছে। এতগুলি ভাষায় হতে পারে, বাংলায় হতে পারে না! নিশ্চয়ই হতে পারে। বিষ্ণুপুর ঘরানার দিকপাল শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি বাংলায় খেয়াল গেয়েছেন। অন্যদিকে আর এক দিকপাল শিল্পী, কণ্ঠশিল্পী– জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী তিনিও বাংলায় গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ একাধিক গান লিখেছেন খেয়াল আঙ্গিকে। ‘মোরে বারে বারে ফেরালে’, ‘এ মহা আবরণ’। ‘এ মহা আবরণ’ গানটি আমি নিজেই বিলম্বিত একতালে বা ঢিমে একতালে পরিবেশন করে থাকি। বিলম্বিত একতালের ইমন রাগের একটি বন্দিশ হিসাবে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে থাকি। সেটা সম্ভব। তেমনই কাজী নজরুল ইসলাম খেয়াল আঙ্গিকের গান লিখেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তো বটেই, তাঁর ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে’– খেয়াল আঙ্গিকে লেখা, সুরকরা গান।
আরও কেউ কেউ, যেমন বিশেষ করে বলতে হবে সংগীতাচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তিনি বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী। আকাশবাণী কলকাতার ধামার, ধ্রুপদ এবং খেয়ালের শিল্পী। তিনি বাংলা খেয়াল রচনা করে গেছেন বিলম্বিত এবং দ্রুত লয়ে। দুর্গা রাগে তাঁর একটি খেয়াল গান বা বন্দিশ আছে তিনতাল মধ্যগতিতে। ‘নাচে সখীদল কুঞ্জে, ফুলদল ভাবে কলি’– কথাগুলি খুবই সাবেকি। রবীন্দ্রনাথ একটি কথা বলে গেছেন বা একাধিক কথা দিয়ে গেছেন আমাদের, তার মধ্যে একটি কথা হল: ‘সাবেকিয়ানার মোহ’, আর ‘ক্লাসিয়ানার মোহ’। যা লক্ষ্যণীয়। এবং আমার মতে, পরিতাপের বিষয় যে, খেয়াল-ঠুংরি গাইতে গেলেই আমরা আধুনিক বাংলা ভাষা থেকে সরে গিয়ে একটা আরোপিত ক্লাসিক্যাল বাংলা ভাষায়, একটি কৃত্রিম বাংলা ভাষায় গান রচনা করি, বা গাই।
(চলবে)
কবীর সুমনের প্রতিকৃতি: অর্ঘ্য চৌধুরী