স্টিয়ারিং হাতে মহিলা দেখলে বাঁকা হাসি ছুড়ে-দেওয়া, মহিলা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করা, দজ্জাল বউকে খোরাক বানিয়ে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে নিয়মিত জোক শেয়ার করা পুরুষের হুইসলধ্বনিতে কি ‘অ্যানিম্যাল’-এর স্ক্রিনিংহল মুহুর্মুহু মুখরিত হয়ে ওঠেনি? আন্ডারওয়্যার কীভাবে কাচা উচিত, সেই ‘অহো কী সাহসী’ আলোচনার সময় হাসিতে ফেটে পড়ছিল না আপনার পাশের সুশীল ভদ্রলোক?
‘আলফা মেল’। ‘অ্যানিম্যাল’-এর দৌলতে শব্দবন্ধটা পাক খাচ্ছে চারপাশে। পুরুষতান্ত্রিক চাবুকের প্রতিটি কাঁটাকে আতশ কাচের নীচে বড় করে দেখে ফেলার অস্বস্তি হজম করতে না পারার যাবতীয় প্রতিক্রিয়া উঠে আসছে সমাজমাধ্যমের কোনাখামচি ধরে একটু টান মারলেই। এই প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা যা-ই হোক না কেন, তার রেশ ‘ফাস্ট কনটেন্ট’-এর দুনিয়ায় বেশিদিন যে দাঁড়িয়ে থাকে না, তার প্রমাণ ‘অর্জুন রেড্ডি’ আর তার বলিউডি মুখ ‘কবীর সিং’। নইলে পুরুষতান্ত্রিকতা প্রোমোট করার অভিযোগে ভরপুর গাল খাওয়ার পরও এই ফিডব্যাকসর্বস্ব মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির যুগে সন্দীপ রেড্ডি বাঙ্গা-র মতো পরিচালক ‘অ্যানিম্যাল’-এর প্রোমোশন পর্বে বেশ গলাবাজি করে জানান দিতেন না, আসতে চলেছে আরও সাংঘাতিক ভয়ংকর ‘ভায়োলেন্স’-এর গল্প।
মজাটা আসলে এইখানেই, দর্শকের এই সম্মিলিত আর্তনাদ, হিংসা আর পেষণের উত্তুঙ্গ অভিব্যক্তি সহ্য করতে না পেরে উগরে দেওয়া রাগ– নির্মাতাদলের বিপণন কৌশলের পিরামিডটি আদতে দাঁড়িয়ে আছে এই থানইটটির ওপরেই। ‘কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি’ যে কীভাবে কৃত্রিম মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা তৈরি করে পণ্যকে ঘিরে, থিওডোর অ্যাডর্নো উৎপাদনের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা সেই আপাত সামাজিক স্থিতাবস্থার কথা বলে গেছেন ঢের আগে। বস্তুত, এই সামাজিক ‘গ্রাউন্ড স্টেট’ দশা টিকিয়ে রাখতে না পারলে ক্রেতা-ভোক্তা-উৎপাদক সর্বস্তরেরই সমূহ সর্বনাশ। চাহিদা বুঝে পণ্য আর পণ্য দিয়ে চাহিদা তৈরির উভমুখী বিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহূর্তে কনজিউমারের ইগো মাসাজ করতে করতে কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি নিপুণ কৌশলে এই ‘গ্রাউন্ড স্টেট’কে পুষ্টি জুগিয়ে যায়। ঠিক সেই মাইক্রোপলিটিক্সকেই একেবারে দিনের আলোয় এনে ফেলেছে ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো সিনেমা, মানুষের ভেতরের এই জান্তব প্রবৃত্তিকে কনটেন্ট গিলিয়ে বৃহত্তর ভালুকনাচের বীভৎস মজা চাখতে চাখতে।
যে দর্শক রণবিজয় চরিত্রটা ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’-র পারদে কতদূর চড়ল, তার নিক্তিমাপ পরখ করে ফেলছেন স্ক্রিনে ছবি দেখতে দেখতে– বন্দুক নিয়ে দিদির মসিহা সেজে ছুটে আসা রণবিজয়, ‘ড্যাডি ইস্যু’তে পাগল হয়ে বউয়ের গলা টিপে ধরা রণবিজয়, নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে প্রেম না করলে বোনকে সপাট মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া রণবিজয়, শত্রুর আসন্নপ্রসবা স্ত্রীর যৌনাঙ্গের দু’ইঞ্চি নীচ দিয়ে গুলি চালিয়ে দেওয়া রণবিজয়– হিংস্র পাশবিকতায় কে কার চেয়ে কতদূর দড় সে মাপের ইঞ্চিতক পর্যন্ত দেখে যে দর্শক অপরিসীম এমপ্যাথিতে আকাশবাতাস বিদীর্ণ করে ফেলছেন, তাঁরাই কিন্তু এতদিন ‘পাঁচ’, ‘রামন রাঘব’, ‘জিন্দা’, ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ কিংবা ‘মির্জাপুর’ দেখে হাততালি বাজিয়ে গেছেন এবং যাবেনও। মূল তফাতটা শুধু ভ্যালিডেশনের। হিংসা এবং আক্রমণের রণরক্ত সফলতার নেপথ্যে যে হিরোসুলভ ডুয়িং এবং সাফারিং-এর কাহিনি গুঁজে দেওয়া হয়, সেই গল্প সামাজিক ন্যায়বিধানের জন্য আদৌ কতটা কার্যকর– শুধু এই প্রশ্নটাকে ঘিরেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে দর্শকের প্রতিক্রিয়া। এই তথাকথিত ‘ন্যায়বিধান’-এর প্রশ্নেই ‘জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে’ বলে যে সহানুভূতির আঠালো ঘনিষ্ঠতা ঘিরে ধরবে ‘জওয়ান’-এর শাহরুখকে, ‘অ্যানিম্যাল’-এর রণবীর-এর জন্য থাকবে তার ঠিক উলটো ঘৃণা, বিবমিষা, কিন্তু অপার মুগ্ধতাও কি নয়? ‘আলফা মেল’ চরিত্রকেই কি এতদিনের বলিউড, দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রি, বন্ডশোভিত হলিউড মাথায় করে রাখেনি?
স্টিয়ারিং হাতে মহিলা দেখলে বাঁকা হাসি ছুড়ে-দেওয়া, মহিলা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করা, দজ্জাল বউকে খোরাক বানিয়ে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে নিয়মিত জোক শেয়ার করা পুরুষের হুইসলধ্বনিতে কি ‘অ্যানিম্যাল’-এর স্ক্রিনিংহল মুহুর্মুহু মুখরিত হয়ে ওঠেনি? আন্ডারওয়্যার কীভাবে কাচা উচিত, সেই ‘অহো কী সাহসী’ আলোচনার সময় হাসিতে ফেটে পড়ছিল না আপনার পাশের সুশীল ভদ্রলোক? অন্তর্বাসের স্ট্র্যাপ টেনে বউয়ের পিঠ যতই লাল হয়ে যাক, পালটা চড় রণবিজয়ের গালে পড়ার পর তো শ্মশানের স্তব্ধতা! পরের দৃশ্যে পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়ার বীভৎস আদরের মধ্যে যেই দাম্পত্য মানভঞ্জনের চেনা সমাধানের ছক খুঁজে খাপে খাপ মিলিয়ে দেওয়া গেল, সম্মিলিত উল্লাসধ্বনিই বলে দিল, ‘ঝি জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে’। এই ভেতরে চেপে-রাখা উন্মাদ ধর্ষকাম আর ‘অ্যানিম্যাল’ দেখে বেরিয়ে তাক-থেকে-নামিয়ে-আনা মোড়কে-সাজানো অ্যান্টি-অপ্রেশন বুলির বাঁধা ভূমিকায় অভিনয় করার মধ্যে যে বৈপরীত্যের আপাত অবস্থান, সেই স্ববিরোধ আছে বলেই কিন্তু ‘গ্রাউন্ড স্টেট’-এর স্থিতাবস্থা রয়ে যায়। ভেতরের ‘অ্যানিম্যাল’-এর এই চেনা অভিব্যক্তিগুলোই একের পর এক অনুষঙ্গে সাজিয়ে দেওয়া ছাড়া এ সিনেমা আর নতুন কিচ্ছুটি করেনি।
এই সিনেমা আসলে প্রদর্শনের আস্ফালনে বিশ্বাসী। তাই আগ্নেয়াস্ত্র হোক বা পুরুষাঙ্গ, তার বিকট দাপট চলতে থাকে পর্দাজুড়ে। স্টেরয়েডপীড়িত নায়কের স্ফীতোদরের দিকে ক্যামেরা তাক করার মুহূর্তে নায়িকার গর্ভাবস্থার বর্ণনা সংলাপে ঢুকিয়ে ফেলা হয় যৌন মেটাফরের আদলে। ছবির নায়ক হোক বা প্রতিনায়ক, এক্সপ্রেশনের অতিরেক তাদের অঙ্গভূষণমাত্র, সেই বাড়াবাড়ির জাস্টিফিকেশনেরই আর-এক নাম সাইকোপ্যাথি। যে মানসিক বৈকল্যের পালে ভর করে যাবতীয় অনিয়ন্ত্রণের ভরাডুবিকে বাঁচিয়ে দেওয়া যায়, সিনেমা হয় সুপারহিট, আর হাতে কাঁচকলা নিয়ে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’-কে কতটা গাল দেওয়া গেল, সেই প্রগতিশীলতার ঢেকুর তুলে পরিতৃপ্ত খসড়া লিখে চলি আমরা।