বাবার সম্পত্তি ভাগ করার সময় লিট্টি বিহার নিয়েছে আর বাটি নিয়েছে রাজস্থান, তাই লিট্টিকে সঙ্গত দেয় চোখা আর বাটিকে দেয় ডাল। এ যেন ইউরোপীয় ফুটবলে গুলিত-বাস্তেন-রাইকার্ড জুটি– এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। সময়ের সঙ্গে জানতে পারলাম এই দুই খাবারের এত মিল হওয়ার মূল কারণ দুটোই মেহনতি মানুষের খাবার। চাষ করে বা যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরে ক্ষুণ্ণিবৃত্তির খাবার এগুলো।
১৮.
ডাল-বাটি-র সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ রাজস্থানের জয়সমন্দ লেকের পাশে খানিকটা নিরুপায় হয়ে। বাসওয়ারাতে সকাল এগারোটাতে একটা মিটিং ছিল বলে উদয়পুর থেকে সাতসকালেই রওনা দিয়েছিলাম। গিন্নি টিফিন করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি উদার হয়ে বারণ করলাম, ‘না না থাক, তোমাকে সাতসকালে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না– আমি রাস্তায় কিছু পেয়ে যাব।’ এই ঔদার্যের কারণ আগেরবার বাসওয়ারা যাতায়াতের পথে জয়সমন্দে একটা বেশ বড় খাবারের দোকান, আর সেখানে আলু পরোটা, পিঁয়াজ কচৌরি, মাওয়া কচৌরির মতো হরেক দেবভোগ্য খাবারের ছবি আঁকা। গাড়ি থামিয়ে সেই দোকানে খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। ছবির খাবারগুলো নাকি শুধু টুরিস্ট সিজনে পাওয়া যায়, মানে নবরাত্রি থেকে দিওয়ালি, আর বছরের শেষ সপ্তাহ। বাকি সময়ে ডাল-বাটি-চুরমা। আগে কোনও দিন খাইনি, ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে কি না জানি না, এদিকে খিদে পেয়েছে। ঈশ্বরকে স্মরণ করে অর্ডার দিলাম, আর খানিক বাদে দেখি আমাদের ছোটবেলার রবার ডিউজ বলের সাইজের কিছু একটা আমার সামনে হাজির। বসে যখন ভাবছি খাব না বোলিং করব– দোকানের মালিক এসে আমার সামনে বসলেন আর কীভাবে খেতে হয় বুঝিয়ে দিলেন। মুখে দিয়ে আবেগে চোখে প্রায় জল এসে গেল– আরে, এ তো আমার ভীষণ প্রিয় লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই! রাজস্থানে অনেক খুঁজেও লিট্টি পাইনি, সেদিন বুঝলাম বাবার সম্পত্তি ভাগ করার সময় লিট্টি বিহার নিয়েছে আর বাটি নিয়েছে রাজস্থান, তাই লিট্টিকে সঙ্গত দেয় চোখা আর বাটিকে দেয় ডাল।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ভাজারদুয়ারি। পর্ব ১৭ : ল্যাদের সঙ্গে খিচুড়ির অবৈধ সম্পর্ক
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এরপর থেকে হামলে পড়ে ডাল-বাটি-চুরমা খাওয়া শুরু হল। এ যেন ইউরোপীয় ফুটবলে গুলিত-বাস্তেন-রাইকার্ড জুটি– এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। আর তিনজনের সামনে সব মহীরুহ কাত! সময়ের সঙ্গে জানতে পারলাম এই দুই খাবারের এত মিল হওয়ার মূল কারণ দুটোই মেহনতি মানুষের খাবার। চাষ করে বা যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরে ক্ষুণ্ণিবৃত্তির খাবার এগুলো। বাটির ইতিহাস বেশ টগবগে। এর সঙ্গে রাজস্থানের কিংবদন্তি যোদ্ধা বাপ্পা রাওয়াল বা অবন ঠাকুরের কাছে শোনা বাপ্পাদিত্য জড়িত। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মেওয়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বাপ্পা রাওয়াল মোরি বংশের মান রাজার কাছে যৌতুক হিসেবে চিতোর পাওয়ার আগে তাঁর যাযাবর যোদ্ধা বাহিনী নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর যোদ্ধারা আটাতে উটের দুধ আর ঘি দিয়ে এক মণ্ড বানিয়ে, সেটা থেকে লেচি করে বালির পাতলা আস্তরণের তলায় রাখত রোদ পাওয়ার জন্য। সারাদিন বাদে যুদ্ধ করে তারা ফিরে দেখত সেই ছোট মণ্ডগুলো সূর্যের তাপে সেঁকা হয়ে গিয়েছে। ঘি, ঘোল বা দইতে ডুবিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে বাপ্পা রাওয়াল আর তার বাহিনী পরের দিনের প্রস্তুতি নিত। সেদিনের সেই লেচি বা মণ্ডটা হল আজকের বাটি। বাপ্পা রাজা হওয়ার পরে বাটিকে পরিত্যাগ করেননি, বরং তাঁর সংগ্রামের দিনের খাবারকে রাজপ্রাসাদের পাকশালায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে আর বালির তলায় রেখে সেঁকতে হত না, বাটির জন্য বিশেষ উনুন তৈরি করা হয়েছিল। আর সময়ের সঙ্গে বাটি তার মেঠো স্বাদ নিয়ে রাজপুত স্বাভিমানের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ভাজারদুয়ারি। পর্ব ১৬: আগুন যখন পবিত্র, ঝলসানো মাংসই সুপারহিট
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাজস্থানে ডালের নেশা ধরিয়ে দেয় গুপ্ত সাম্রাজ্য, তাদের হাত ধরেই ডালের প্রবেশ রাজস্থানে। ছোলা, অড়হর, বিউলি, মুগ আর মসুর– এই পাঁচ রকমের ডাল মিশিয়ে করা ডাল পঞ্চ্মেল সময়ের সঙ্গে বাটির সঙ্গে টিম বানিয়ে রাজপুত রান্নাঘরে এমন ভেলকি দেখাতে শুরু করল যে, শুধু রাজস্থানে নয়, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল ডাল-বাটির সুখ্যাতি। চুরমা এদের দলে এসেছে আরও পরে। লোককথা বলে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সন্ত্রস্ত এক রাঁধুনি অন্যমনস্ক হয়ে বাটির ওপর চিনির রস ঢেলে দেয় আর সেখান থেকেই চুরমার জন্ম। আর এক মত হচ্ছে, রাজপুত গিন্নিরা বাটি বানিয়ে তা চিনির বা গুড়ের জলে ডুবিয়ে রাখতেন বাটি টাটকা রাখার জন্যে আর সুস্বাদু করার জন্য– সেইখান থেকেই জন্ম আজকের চুরমার।
কিন্তু ঘি-তে ডুবিয়ে তবেই ডালের সঙ্গে বাটি মেশাতে হবে, আর মাঝে মাঝে ঘোলে চুমুক দিতে হবে আজকেও রাজপুতদের, কারণ সেখানে তাদের গৌরব-গাথার গল্পগুলো লুকিয়ে আছে যে!