বাঙালির দেশভাগের মনোবৈজ্ঞানিক আলোচনা যে পথে গিয়েছে, তাতে শিশু মনস্তত্ত্বের জায়গা খুব বেশি নেই। শঙ্খ ঘোষের ‘সুপুরিবনের সারি’-তে স্টিমারের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়ানো ছোট্ট নীলুকে দিয়ে আখ্যানের সূচনা। শেষও নীলুকে দিয়েই। কবির কলমে লেখা আখ্যানে বাঁধুনিগত আঁটোভাব এখানে নেই। লিখছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়।
শঙ্খ ঘোষ জানতেন, স্মৃতি বস্তুত ‘দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল’। পুনর্বাসন তো একটা পোশাকি কথা, কিন্তু নাছোড় স্মৃতির বেমক্কা টানে টলমল করে ওঠে আমাদের অস্তিত্ব। নইলে গদ্যলেখায় ভয়ানক অনীহা যাঁর, হয়তো খানিকটা মজা করেই যিনি বলেছিলেন ‘নিঃশব্দের তর্জনী’র মতো স্বল্পায়তন প্রবন্ধ বা জার্নালধর্মী কিছু লেখা ছাড়া আর কোনও গদ্যই না কি তিনি ‘স্বেচ্ছায় বা সানন্দে’ লেখেননি কখনও, তিনি এক এক করে তিনখানি ছোটদের উপন্যাস লিখে ফেললেন কীভাবে? ১৯৭২ সালে ছোট্ট নীলুর কথা প্রথম বই হয়ে প্রকাশিত হওয়ার ১৮ বছর পর তিনি আবার ফিরলেন নীলুর অন্তর্জগতে, ‘সকালবেলার আলো’ ছড়িয়ে পড়ল ‘সুপুরিবনের সারি’-তে, তারও বছর কুড়ি পরে সেই ছেলেটিকে পাচ্ছি ‘শহরপথের ধুলো’য়।
দস্তুরমতো আত্মজীবনী লেখার কথা তিনি সম্ভবত ভাবতেন না। কিন্তু ছোট্ট নীলু তাঁর মনের ভেতরে ক্রমশই বড় হয়ে উঠেছে। একথা বহুবার বলা হয়েছে, যে কোনও লেখাই কমবেশি আত্মজৈবনিক। এ নিয়ে তকরার বাড়ালে কথার পাহাড় হবে। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে ‘আর এক আরম্ভের জন্য’-র মতো অতুলনীয় গদ্য যিনি লেখেন, তিনি নিছক শৈশবস্মৃতি রোমন্থন করতে দীর্ঘ সময়ের বিরতি নিয়ে তিনবার নীলুর জগতে ফিরেছেন বলে মনে হয় না। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আবহে আবারও কি জাগ্রত হল ফেলে আসা বিচ্ছেদের যন্ত্রণা? না কি একে তাঁর স্বেচ্ছাবৃত দায়বদ্ধতা হিসেবেও দেখতে পারি আমরা। রথে চড়ে আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির কিছু মাতব্বর ততদিনে দেশ ঢুঁড়ে ফেলে সাম্প্রদায়িকতার বিষে ফের নীল করে দিতে চাইছিল আমাদের চেতনা। ভুলিয়ে দিতে চাইছিল সভ্যতার মূল কথা সহিষ্ণুতা, আর সামগ্রিকতার বোধ না থাকলে সেই দৃষ্টিকে ‘মায়োপিক’ বলা যায় অনায়াসে। ১৯৯০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বামফ্রন্ট আয়োজিত বুদ্ধিজীবী-সমাবেশে পড়া ‘প্রতাপ-অন্ধতা’ শীর্ষক ছোট লেখাটার কথাই বা ভুলি কেমন করে আমরা।
ক্রিস. কে. মানজাপ্রা-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে তিনটি জায়গার উল্লেখ করেছিলেন– ঢাকা জেলার চাঁদপুর, পাবনার পাকশি আর বরিশালের বাণারিপাড়া। তবে নিজেকে বরিশালের ছেলে বলেই চিনতে চেয়েছেন চিরকাল। যদিও সেখানে খুব বেশি যে থেকেছেন, এমনটা নয়। কিন্তু প্রতি বছর দুর্গাপুজোর মাসটা কাটত বাণারিপাড়ায়। পরিবারের সব ভাইবোন মিলে সে এক তুমুল হইহল্লা! কিন্তু ‘সুপুরিবনের সারি’-তে শুরু থেকেই দেশভাগ আর কুৎসিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষণ্ণ সুরে বেহালার ছড় টেনেছেন তিনি।
‘সুপুরিবনের সারি’ যে সময়ের কথা বলে– ‘স্বাধীনতা এসেছে সবে, আর দু-টুকরো হয়ে গেছে দেশ’, তখনকার কথা বলতে গিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেদের গ্রামে ছোটোবেলায় স্থায়ীভাবে থাকিনি কখনো, শুধু প্রতি বছর পুজোর সময় সেখানে একমাস টানা থাকতাম।… আশেপাশে দু-চারটে গ্রাম থেকে বিভিন্ন বাড়ির পূজামণ্ডপে দর্শনার্থী যারা আসতেন, তাঁদের কারও কারও পোশাকে-আশাকে কিছু ভিন্নতা দেখা ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্যের অনুভব হয়নি তখন।’ এই অংশটা পড়ে চকিতে মনে পড়ে যায় দক্ষিণারঞ্জন বসুর ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ বইটিতে বাঙালির গ্রেট এক্সোডাসের যে মনস্তাত্ত্বিক দলিল সংকলিত হয়েছিল, সেখানে বরিশালের বাণারিপাড়া নিয়ে লেখাটির সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের স্মৃতির কী আশ্চর্য মিল।
কিন্তু বায়োগ্রাফিক্যাল ক্রিটিসিজম অনেক সময়ই বেজায় পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হয়। ‘সুপুরিবনের সারি’-কে আমরা একটি সচেতন আখ্যানপ্রয়াস হিসেবেই দেখতে চাই। বাঙালির দেশভাগের মনোবৈজ্ঞানিক আলোচনা যে পথে গিয়েছে, তাতে শিশু মনস্তত্ত্বের জায়গা খুব বেশি নেই। অথচ স্টিমারের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়ানো ছোট্ট নীলুকে দিয়ে আখ্যানের সূচনা। শেষও নীলুকে দিয়েই। কবির কলমে লেখা আখ্যানে বাঁধুনিগত আঁটোভাব এখানে নেই। আছে ছড়ানো পালকের মতো কিছু দৃশ্যের উন্মোচন, নীলুর চোখ দিয়েই। এই নীলু বিভূতিভূষণের অপুও নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জীয়ন্ত’র পাকা-ও নয়। তার মুখে দেশভাগের জটিলতা সরাসরি শুনি না, কিন্তু সে যে বুঝতে পারছে তলায় তলায় একটা বড় বদল ঘটে গিয়েছে, সেটা স্পষ্ট। বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার শরিক হয়েছে সে স্কুলবেলাতেই। মাস্টারমশাই ক্লাসে শরৎচন্দ্র পড়াতে গিয়ে আপত্তি তুলেছেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ’ কথাটায়। তাই মেজমামিমা যখন পুজোমণ্ডপে হারুনকে দেখে তীব্র ভর্ৎসনা করে, তখন সেদিনের খেলাটাই মাটি হয়ে যায়। কিংবা মহাষ্টমীতে দিদিমা ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে যখন হারুনের মা সম্পর্কে বলে, ‘মাথা উঁচু করে একেবারে চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলে এখন, এখন কি আর ওদের সেইদিন আছে? এখন তো ওরাই সব’, অন্যরা কিছু না বললেও নীলুর মনটা অনেকক্ষণ ভাবনায় দোলে। আবার হারুন যখন বলে, ‘কায়েদে আজম কইছে’, দেশের সব সম্পত্তি মুসলমানেরা পাবে, তখনও তার বুকটা ধক করে ওঠে। সে যে রেজাউল করীমের ‘তুর্কী বীর কামাল পাশা’ পড়া ছেলে, স্কুল লাইব্রেরি থেকে নিয়ে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ পড়েছে। কিন্তু মুশকিল হল তার প্রিয় বন্ধু হারুন কারবালার কাহিনি শুনে বলে ওঠে, ‘আম্মা আমাগো কথা কী সুন্দর কইতে পারে নীলাই। মহরমের গল্প।’ বস্তুত ততদিনে বিষ চাড়িয়ে গিয়েছে শিকড় পর্যন্ত।
‘সুপুরিবনের সারি’-তে প্রান্তবাসী চরিত্র ফুলমামি। সে খানিক রহস্যে ঘেরা, তাই হয়তো কিশোর নীলু বারবার যায় তার কাছে। তার সঙ্গে কবিতা নিয়ে কথা বলে। ফুলমামির ছিল কবিতা লেখার খাতা, আর সংসারে মানিয়ে নিতে না-পারার অসুখ! পরিণতিতে একদিন সব বাঁধন ছাড়িয়ে সে উধাও হয়ে যায়।
যে শিশু মনস্তত্ত্বের কথা খানিক আগে উঠেছিল, তার একটা অসামান্য ছবি আছে, যে-সন্ধেয় ভিটে ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার জন্য সবাই দরবার করছিল দাদুর কাছে তার বর্ণনায়। নীলু মেঝেয় শুয়ে গালে হাত দিয়ে সব শুনছিল, খেলছিল লণ্ঠনের সলতেটা বাড়িয়ে-কমিয়ে। দাদু রাজি হয়নি। মানতে চায়নি দেশভাগের বাস্তবতা। কিন্তু ছোট্ট নীলু দ্বাদশীর দিন ফেরার সময় জেনে গিয়েছিল এই শেষ। আর আসা বোধহয় হবে না। যদিও একটা চমক তখনও বাকি ছিল, কেননা হঠাৎ হাটখোলার কোণ থেকে রুমাল নাড়িয়ে তাকে বিদায় জানাতে হাজির হয় হারুন। যে-বন্ধুত্বের শেষটা অনুমান করে ফেলেছে নীলু ততদিনে। এরপর বাকি থাকে দেশের মাটির কাছে আন্তরিক বিদায় চাওয়া, ততক্ষণে তার ‘দোলে স্মৃতি দোলে দেশ দোলে ধুনুচির অন্ধকার’।