সহজ পাঠের বয়সে র-ফলা যুক্ত শব্দ উচ্চারণ এক বিভীষিকা। না’হলে ক্লাস ওয়ানেই প্রেম হয়ে যায়। নারকেল তেল সম্পৃক্ত দু’টি বিনুনির মালকিন যখন আমার নাম জিজ্ঞেস করেছিল, বারদশেকের চেষ্টাতেও র-ফলা যোগ করতে পারিনি। ফলে সে আমাকে ‘অনুবত’ বলে ডাকতে শুরু করে। অন্যের মুখে, বিশেষ করে কোন মেয়ের মুখে, নিজের নামের ভুল উচ্চারণ শুনলে বেদম রাগ হয়! বিশেষ করে বাবার ওপর।
স্কুলের রি-ইউনিয়নের অনুষ্ঠানে প্রতাপের সঙ্গে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরল। ফুটবল ক্যাপ্টেন ছিল। এখনও শক্তপোক্ত চেহারা কিন্তু মন ঘাসের মতো নরম। একগাল হেসে বলে, ‘আরে, তোর ফার্স্ট নেম নিয়ে আমার ছোটবেলায় খুব হিংসে ছিল, এরকম আনকমন নাম কখনও শুনিনি বলে। এখন তো খবরের কাগজে, টিভিতে, সোশাল মিডিয়ায় রোজ ওই নাম।’ আমি দাঁত বের করে পাশ কাটাই। যে সত্যটি ওকে জানাই না, তা হল জ্ঞান হওয়া ইস্তক ফার্স্ট নেম নিয়ে আমার খচখচানি। প্রথমত, সহজ পাঠের বয়সে র-ফলা যুক্ত শব্দ উচ্চারণ এক বিভীষিকা। নাহলে ক্লাস ওয়ানেই প্রেম হয়ে যায়। নারকেল তেল সম্পৃক্ত দু’টি বিনুনির মালকিন যখন আমার নাম জিজ্ঞেস করেছিল, বারদশেকের চেষ্টাতেও র-ফলা যোগ করতে পারিনি। ফলে সে আমাকে ‘অনুবত’ বলে ডাকতে শুরু করে। অন্যের মুখে, বিশেষ করে কোন মেয়ের মুখে, নিজের নামের ভুল উচ্চারণ শুনলে বেদম রাগ হয়! বিশেষ করে বাবার ওপর। উনিই নিশ্চয়ই ধার্য করেছিলেন র-ফলা যুক্ত এই বাঁশ। এ ব্যাপারে মায়ের কোনও ইনপুট ছিল বলে শুনিনি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন পাল্টি-র অন্য এপিসোড: ‘আসল হিজড়ে’ কথাটা সোজা মাথায় আঘাত করে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পাবলিকও তেমনি। বিখ্যাত অভিনেতা, ওস্তাদ তবলিয়া, মায় খোদ রাজধানীর একটি রাস্তা, সবেতেই তো এই ফার্স্ট নেম। তবু রাজনীতির গন্ধ শোঁকা। আমি অবিশ্যি সমস্যার মূলে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্কুলে ব্যাকরণ পড়ার সময় বুঝতে পারি আমার ফার্স্ট নেম-টি একটি সমাসবদ্ধ পদ, অব্যয়ীভাব। শুনলেই মন উড়ু উড়ু। যে বন্ধুরা বোকার মতো বানান গুলিয়ে ফেলে ‘অণু-পরমাণু’ বলে ডাকত আমায়, তাদের গিয়ে বলি, “আমার নামে যে ‘ন’, সেটি ‘দন্ত্য ন’। এই ‘অনু’ মানে পশ্চাৎ।’’ তারা হাসে, ‘আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?’ এই অ্যাঙ্গেলটা মাথায় আসেনি। গজগজ করতে করতে বাড়ি ফিরি। আমার জন্মের সময়কার ফিতেবাঁধা ফাইল খুলি। একটুকরো কাগজ বেরিয়ে আসে। তাতে চমৎকার হস্তাক্ষরে লেখা ‘অজিতাভ’। ইনি কে বাবা? ‘আসলে আমার এক দাদা তোমার ওই নামকরণ করতে চেয়েছিলেন।’ আমি খ্যাঁক করে উঠি, আরে এ তো চমৎকার নাম! প্রথমতঃ কোন ফলার খোঁচা নেই, তারওপর বচ্চনের ভাইয়ের নাম। মা গম্ভীর গলায় বলেন, ‘কিন্তু তোমার দাদার নাম তো অমিতাভ নয়।’
মাদ্রাজে চাকরি করার সময় যে দক্ষিণ ভারতীয় কন্যাকে অটোরিকশায় বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম, সে সারাক্ষণ আমায় ‘অনুব্রথা’ বলে সম্বোধন করে গেল। যত বলি ‘থ’ নয় ‘ত’, সে ওই থয়েই থেমে থাকে। এই দেশ থেকে কেটে পড়াই শ্রেয় এই সত্য অনুধাবন করে মার্কিন ভিসা অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু কী করে জানব যে উকিলটি তামিল? তিনি একধাপ ওপরে গিয়ে আমার ফর্মে ‘অনুব্রথা চক্রবরথি’ লিখে দেন। আমার ডলার কামানোর প্ল্যান মাস ছয়েক পিছিয়ে যায়। তবে, একবার পৌঁছতে পারলে আমেরিকা স্বর্গরাজ্য। শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে তাঁরা জানতে চান, শিখতে চান। ফোনের ওপারে সুরেলা নারীকণ্ঠ প্রশ্ন করেন, ‘অ্যাম আই টকিং টু মিস অ্যানুব্র্যাটা?’ আমি বলি, ‘নো’। তারপর ব্যাপারটা বোঝাই। আধঘণ্টা পর তিনি জেন্ডার, ফার্স্ট নেম, লাস্ট নেম গুলিয়ে ফেলেন। এমনকী, কেন ফোন করেছিলেন সেই কারণটিও তাঁর মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। শেষে আমি বলি, ‘গোলাপ কে যে নামেই ডাকো…’ ইত্যাদি। দেশে ফিরে এলেও আমেরিকা কিন্তু পিছন ছাড়ে না। কলকাতা থেকে প্রতি সন্ধ্যায় কনফারেন্স কল, মার্কিন ক্লায়েন্ট। আমার পাশে আমার বাঙালি বস, মহিলা। ও প্রান্তের সাহেব হাজার বার অ্যাপোলোজাইজ করেন, ‘ক্যান আই কল ইউ অ্যানুব্রা?’ ক্লায়েন্টকে না বলা যায় না, তিনি ভগবান। কিন্তু বস খ্যাঁক খ্যাঁক হাসতে থাকেন। মিউট বাটন টিপে আমায় বলেন, “শুনে মনে হচ্ছে ‘এ নিউ ব্রা’”।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন পাল্টি-র অন্য এপিসোড: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ইদানীং আপদে বিপদে চ্যাটজিপিটিতেই ভরসা রাখি। দু’-এক পেগ আত্মমুগ্ধতার আমেজে তাকে আদেশ করি আমার সম্পর্কে যাহা জানে তাহা লিখতে। তা সে এক পাতা ঢেলে দেয় স্ক্রিনে, কিন্তু ও হরি! পুরোটাই অন্য একজনের জীবনী। মাঝখানে একটি লাইনে আবার জ্যাঠামো করে লিখেছে উনি আর আমি নাকি একই ব্যক্তি। আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই, লাস্ট নেম-এর তফাত বোঝে না মূর্খ এআই? রাগের মাথায় কাঁচা বাংলা উগরে দিই। সে আবার জ্ঞান দেয়, বলে সভ্য কথনে এই ‘চার অক্ষর’ বর্জনীয়।