দৃশ্য ১: ২০১০
একটি বাচ্চা ছেলে, ক্লাস ফোর, রোল নম্বর দশ, নিজেকে রোল নম্বরের জন্য মেসি আর শচীনের সমগোত্রীয় ভাবে। তার বাড়িতে আজ বিকেলে দোল পূর্ণিমার পুজো। বাড়ির বড়রা পুজোর ঘরে কাজকর্ম করছে। একতলার ঘরটা এখন প্রায় ফাঁকা, ছেলেটির পিসতুতো দিদি কারওর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে আর অন্যমনস্কভাবে একটা পাতলা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। ছেলেটি লাফিয়ে খাটে উঠতেই তার দিদি অন্যদিকে ঘুরে যায় নোকিয়ার ফোনটা নিয়ে। ম্যাগাজিনটা একা পড়ে থাকে বিকেলের একচিলতে রক্তশূন্য রোদে। লাল আর কালো দিয়ে মলাট আঁকা, কোনও অবয়ব নেই, কেবল রং। তার ওপর শাদা দিয়ে ডানদিকে লম্বালম্বী লেখা ‘রোববার’, আর নীচে বাঁদিকে লেখা ‘রংবাজি’। ছেলেটি পাতা ওল্টায়। পড়ার বইয়ের মত এখানেও সূচিপত্র আছে, তবে একটা নামও ছেলেটার পরিচিত নয়। না, একটা নাম সে জানে, ঋতুপর্ণ ঘোষ। টিভিতে একটা অনুষ্ঠানে মিরাক্কেলের মীরের সঙ্গে এই লোকটার খুব ঝামেলা হয়েছিল, তখন থেকে ছেলেটা এই নামটা জানে। তাছাড়া রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, জয় গোস্বামী, সমরেশ মজুমদার, বাণী বসু, শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, একটা নামও সে জানত না। এখন জেনে গেল। এই সেই ছেলেটির সঙ্গে রোববার-এর প্রথম পরিচয়। সেদিন সেই ছেলেটি আদৌ কোনও লেখা পড়েছিলে কি না জানা নেই, পড়লেও কিছুই বোঝেনি, এটুকু হলফ করে বলা যায়। শুধু ওর মাথায় গেঁথে গিয়েছিল চন্দ্রিলের লেখার সঙ্গে দেওয়া ছবিটি। মাংসের দোকানে ঝুলতে থাকা তিনটি গোলাপি নধর মূল্যহীন পাঁঠা। মাইরি, রঙের উৎসবের এরকম উদযাপন রোববার বলেই হয়তো সম্ভব।
দৃশ্য ২: ২০১৪
ছেলেটি এখন ক্লাস এইট। অঙ্কে x আর y ঢুকে এখন তার রেজাল্টের (আপনারা যেটা ভাবছেন সেটাই) মেরে দিয়েছে। A সেকশনে আর ঠাঁই হয় না, হয় B সেকশনে। আবার শীতকাল, আবার একটা রবিবার, আবার মন খারাপ, আবার বুঝতে না পারা শরীর-মনের ঘেঁটে যাওয়া বদল। এইরকম সময় আবারও একটা বোমা হাতে এসে পড়ল ছেলে। বোমাটার নাম ‘খিস্তিমাত’। ব্যাগে করে লুকিয়ে স্কুলে নিয়ে গিয়ে, তিনতলার বাঁদিকের ঘরে বেঞ্চের কোনায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে একটা লাইন পড়েছিল সে, ‘খিস্তির সঙ্গে কোথাও একটা ভায়াগ্রার যোগ আছে, মানে ‘উত্তেজনা কোশেন্ট’ এর ব্যাপারটা মাথায় রাখলে (লেখক: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়)। খিস্তি যে শুধুই খিস্তি নয়, খিস্তি কতটা মিষ্টি, এই সংখ্যাটা ছেলেটিকে বুঝিয়েছিল। ফ্যাতাড়ু, চুতিয়া পৃথিবী, খচ্চর ও অসহায় বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা…
দৃশ্য ৩: ২০১৭
ছেলেটি এখন থিয়েটার করে, মাধ্যমিক দিয়ে আর টুকটাক প্রেম করে পেকে একদম ঝুনো নারকোল হয়ে গেছে সে এখন। আজ ছেলেটির যাদবপুর নিরঞ্জন সদনে শো, আগামিকাল ক্লাস ইলেভেনের মিড টার্ম পরীক্ষা। আর্টস নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে L২৩৮ এর স্পিডে ছুটছে, পড়ালেখার সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ নেই। শো করে এসে রাত্রিবেলা যখন পড়তে বসেছে, তখন পড়ার বইয়ের পাশে ছেলেটির চোখ পড়ল সাদা মলাটের ওপর নীল এবং কালোতে আঁকা একটি প্রচ্ছদ। রোববার, পৌষপাব্বন সংখ্যা। যথারীতি শেষ পাতা থেকে পাতা ওল্টানো শুরু করল ছেলেটি। শেষপাতায় সোনাগাছি নিয়ে একটি লেখা পেয়ে খুব বেশি এক্সপেকটেশন নিয়ে পড়তে গেলেও ইতিহাস ছাড়া খুব একটা বেশি কিছু পেল না, পাতা ওল্টাতে থাকলো ভিতরের দিকে। চোখ আটকাল ‘মোম’ নামের একটা কবিতায়–
‘মোম নিভে গেলে তুমি আজও যে পাখির ডাক শোনো,
স্মৃতি তো আসলে শীত। আসে, কিন্তু থাকে না কখনও…’
আবারও, আবারও সেই না বোঝার একটা সময়, কিন্তু অবাক কাণ্ড, এবারে এই লাইনগুলো ছেলেটির মাথায় বোঝার আগে বাজল। বোঝার আগে বাজা… ছেলেটি কবির নাম দেখল, শ্রীজাত। এই কি তার নতুন প্রেম? তখন ছেলেটি বোঝেনি, এখন বোঝে। ছেলেটি এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। যে বন্ধু তাকে হাত ধরে বড়ো করেছে, সাবালক করেছে, ‘‘দু’-এক পলক বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা’’কে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, সেই বন্ধুর এবার সাবালক হওয়ার পালা।
ভালো থেকো ‘রোববার’, আগামী শুভ হোক।