সকলেই সকলকে আড়চোখে দেখে। হ্যাঁ, একথা জীবনানন্দই লিখেছিলেন। কিন্তু স্রেফ যে দেখে, তা নয়, ডাহা নকলও করে। সেই বাঁদর আর টুপিঅলার গল্পখানা মনে করুন। বাঁদরে নকল করেছিল বলেই তো টুপিঅলা ফেরত পেয়েছিল তার হকের টুপিগুলো? মানুষও তেড়ে পশুপাখিদের নকল করেছে। যে কোনও ছানাপোনার সামনে তার আত্মীয়স্বজনই হরবোলা। স্বয়ং অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পোয়েটিকস’-এ বলছেন, ‘অন্য পশুর থেকে মানুষের সুবিধা হল এই যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনুকরণকারী জীব, অনুকরণের মধ্যেই তার শিক্ষার শুরু। (অনুবাদ: শিশিরকুমার দাশ)’ কিন্তু তাই বলে, নকলনবিশিতে অন্য প্রাণীরা ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকবে, আর মানুষ তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে– এ কেমন করে হয়!
পাঁচিলে কাদের বসে থাকতে দেখা যায়? বখাটে ছেলেছোকরা, মন্দগতির শামুক, সাদা-কালো-সোনালি বিড়াল, চোরছ্যাঁচড়ের জন্য ধারালো কাচ, উলটানো পেরেক, ভুলোমনের ছাতা, দেওয়াল লিখিয়ের রঙের কৌটো, সবুজ-রঙা শ্যাওলা, সেন্টার শক চিবনো শুঁয়োপোকা, ট্রেনের মতো কেন্নো, দু’-চারটে পাখি-টাখি ও উহাদের মলচিহ্ন? কিন্তু যদি বাঘের মাসির বদলে হাজির হয় বাঘ? আস্ত ডোরাকাটা দক্ষিণরায় বাহাদুর? আপনারই মহল্লায়? আজ্ঞে, উপেন্দ্রকিশোর পড়া বাঙালি মনও এমন চিন্তা করতে খানিক ঢোক গিলবে। সে কী করেই বা জানবে কালে কালে এমন দিন আসবে যে, বাঘবাবাজি পাঁচিলে বসে ন্যাজ দোলাবেন এই মনুষ্যপ্রাণ সংরক্ষণ এলাকায়? কিন্তু উত্তরপ্রদেশের এক গ্রামে এমনটা সত্যি সত্যিই ঘটেছে বইকি! লোকালয়ের এক পাঁচিলে তিনি এসে এই খেজুরগুড়ের শীতে রোদ পোহাচ্ছিলেন। বিরক্ত-টিরক্ত অবশ্য কাউকেই করেননি, অন্তর্মুখী গোছের। যদিও লোকজনের ক্যাঁচরম্যাচরে বনদফতর এসে, জাল বিছিয়ে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে তাকে বনপথে ফেরত নিয়ে যায়। এই হল মোদ্দা ডোরাকাটা ঘটনা!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: আবছায়া রহস্যময় প্রীতিসম্পন্ন যে গঞ্জের রং আর গন্ধ পুষে রাখি, তার কৃতিত্ব শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরই
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সকলেই সকলকে আড়চোখে দেখে। হ্যাঁ, একথা জীবনানন্দই লিখেছিলেন। কিন্তু স্রেফ যে দেখে, তা নয়, ডাহা নকলও করে। সেই বাঁদর আর টুপিঅলার গল্পখানা মনে করুন। বাঁদরে নকল করেছিল বলেই তো টুপিঅলা ফেরত পেয়েছিল তার হকের টুপিগুলো? মানুষও তেড়ে পশুপাখিদের নকল করেছে। যে কোনও ছানাপোনার সামনে তার আত্মীয়স্বজনই হরবোলা। স্বয়ং অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পোয়েটিকস’-এ বলছেন, ‘অন্য পশুর থেকে মানুষের সুবিধা হল এই যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনুকরণকারী জীব, অনুকরণের মধ্যেই তার শিক্ষার শুরু। (অনুবাদ: শিশিরকুমার দাশ)’ কিন্তু তাই বলে, নকলনবিশিতে অন্য প্রাণীরা ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকবে, আর মানুষ তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে– এ কেমন করে হয়! মনে করুন, ফোটোগ্রাফার ডেভিড স্লটারের কথা। ইন্দোনেশিয়ায় বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলতে গিয়েছিলেন তিনি। একটু বেখেয়াল হয়েছেন, আর এক ম্যাকাক বাঁদর তাঁর ক্যামেরা নিয়ে খেলতে শুরু করে। একগাদা ছবিও তুলে ফেলে! এক্কেবারে সেলফি! সেই বাঁদরখানা অনেকটাই টেক-স্যাভি, কিন্তু এই বাঘ তো একেবারে নয়ের দশকের খট্বারূঢ় টাইপ– বেজায় আলসে। এ জীবন হুবহু ‘লাইফ অফ পাই’ তো হতে পারে না, ওসব আদপে ইমেজারি-টিমেজারি। বাড়ির আশপাশের পাঁচিলে এরকম আস্ত বাঘ দেখলে জীবনটাই তো নিরুদ্দেশে যাবে!
কিন্তু যদি ইমেজারিই জারি করি! কে ওই বাঘ? ধরে নেওয়া যাক, আমাদের ভয়ের যোগফল। সে ঘাপটি মেরে, দূরদূরান্তের বনে ছিল, এখন শীতের রোদ পোহাতে চলে এসেছে আমাদের পাড়ায়। এই যে ’২৪ আসছে, নতুন বছর, ভোট– কতকগুলো রাজনৈতিক হিংসার প্রদর্শনী, পাড়ায় পাড়ায় রক্তছাপ– এগুলোই তো আসল ভয়েরই চিহ্ন। এই গণতান্ত্রিক দেশে সে চিহ্নই সবার আগে ভোটে জিতে বসে আছে। ট্রেনে চারজন অফিসযাত্রী যখন একযোগে বলে যাচ্ছে, এ দেশ ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হয়ে যাক, আপনি চুপ করে শুধু ভয় পাচ্ছেন, কোনও কথাই মুখে আসছে না আপনার। ব্যাঙ্কে অনেক দিনের না-পাওয়া টাকা যখন মিলব-মিলব করছে, দেখছেন, ম্যানেজার একবিন্দু বাংলা জানে না– আপনি বলতেও পারছেন না, ‘বাংলায় বসে খাচ্ছেন-দাচ্ছেন আর বাংলাটা জানার চেষ্টা করছেন না কেন বলুন তো?’ আপনি বলতে পারছেন না, ‘দাদা লাইনের সামনে ঢুকে পড়লেন যে’, কারণ লোকটি হোমড়াচোমড়া। আপনি বলতে পারছেন না, ‘স্যর, এই বাজারে এই পয়সায় চলছে না, মাইনেটা একটু বাড়ান।’ সিনেমাহলে জাতীয় সংগীত বাজানো আপনার একেবারেই অনর্থক লাগে, কিন্তু যদি না-দাঁড়ান, এই দেশ আপনাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেবে, অথচ ইশকুলবেলায় রোদের মধ্যে স্কুলের সক্কলে মিলে যখন জাতীয় সংগীত গাওয়া হত– আপনার চোখ ছলছল করত কোনও অজানা কারণে। ভয় করে যখন ট্রেন থেকে নেমে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আপনি হেঁটে যান, পিছনের পকেটে একহাত দিয়ে। ভয় করে সেই মেয়েটিরও, যে সামনের দিকে করে নেয় তার ব্যাগ, ফাইল। তার একান্ত ছবিগুলি, তার গত-প্রেমিক যে কোনও দিন ইন্টারনেটে ছেড়ে দিতে পারে– এই ভয়ও সে পায়। সে ভয় পায় এক দূরসম্পর্কের মামাকে, ছোটবেলার এক ঘিনঘিনে স্মৃতির জন্য। ভয় পায় সেই ছেলেটিও, যে তেমন পুরুষালি নয়। যার হাতে শিরা নেই, যে কোমলতা নির্ভর। টিউশন স্যর তাকে প্রতিদিন থেকে যেতে বলে, সবাই চলে যাওয়ার পর আরও আধঘণ্টা। শীতকাল আর হার্ট অ্যাটাকের তুমুল বন্ধুত্বে ভয় পেয়ে গিয়েছেন বয়স ৬৪ ও ৭২। কলকাতা ঘুরে ঘুরে যে ছেলেটি বা মেয়েটি হিন্দু নয় বলে ভাড়া পাচ্ছে না কোথাও, সে ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে, কলকাতা সম্পর্কে লোকজন ভুল ভাবে, ভুল জানে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: লোকটা হেসেছিল বলে আত্মহত্যা স্থগিত সেইদিন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ তালিকা দীর্ঘ, দীর্ঘতর হয় রোজ। হতেই থাকে। ব্যক্তিগত ও যৌথ ভয়ের এই ধারাবিবরণীতে নিশ্চয়ই আপনারও কোনও অবদান থাকবে। এই সমস্ত ভয়কেই আমরা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। সেই ভয় এক-একদিন পাড়ার পাঁচিলে এসে জুটবে না, এ তো হয় না। সে শীতের রোদ কেড়ে নেবে। আমাদের হয়ে আরামের আড়মোড়া ভাঙবে সে-ই। আর, আমরা তটস্থ হয়ে থাকব। হাতে তুলে নেব ঘুমপাড়ানি গুলি।
অথচ, আমাদের কাছে ছিল ভালোবাসার বাঘ, লিখেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়– যে দুপুরবেলায়, বনে, বেরিয়ে পড়েছিল। সেই ভালোবাসার বাঘটিকে আমরা হারালাম কোথায়?
প্রচ্ছদ চিত্র: অর্ঘ্য চৌধুরী