ভারত মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা দলিত রাষ্ট্রপতি পেয়েছে, কিন্তু অদূরভবিষ্যতে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল অ্যাটালের মতো সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠী থেকে এক রাষ্ট্রনায়ক এ-দেশ পাবে, এমন আশা করা এখনকার পরিস্থিতিতে চরম হাস্যকর।
ইউরোপ-আমেরিকা বলে নয়, ভারতেও রাজনীতির পরিসর প্রতিনিধিত্বমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ বহু বছর। কোনও দেশীয় রাজনীতিতে সেই সমাজের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি আছে কি না, সেটা তার গণতন্ত্রের পরিচায়ক। হতে পারে, তা কখনও কেবল ‘কথার কথা’ হয়ে রয়ে গিয়েছে, আবার কখনও প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি মূলধারার রাজনীতিতে এতই সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে, ক্ষমতার বুলি এতটাই মুখস্থ করে ফেলেছে যে, সে নিজের গোষ্ঠীর কথা ভুলে গেছে। তবু গণতন্ত্র যখন, সেখানে তখন অনেকগুলি ভিন্ন চেতনার স্বর অন্তত প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত আছে, এটা আদর্শবাদী রাজনীতির পক্ষে স্বস্তির। এ বছর, ৯ জানুয়ারি গ্যাব্রিয়েল অ্যাটাল, ফ্রান্সের (দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ) প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। খুশির খবর। মাত্র ১০ বছর আগে যিনি ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে ইনটার্নের কাজ করতেন, তিনিই সে-দেশে ক্ষমতা-অলিন্দের একদম দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেলেন; বিশেষজ্ঞদের মতে, তা রাজনৈতিক কেরিয়ারের দিক থেকে উল্কাগতিসম।
অ্যাটালের সাফল্য শুধু এখানেই থেমে নেই। আরেকটি ব্যাপারেও তিনি অগ্রগণ্য– তিনি ফ্রান্সের প্রথম ‘ওপেনলি গে’ প্রধানমন্ত্রী। এখানে এই ইংরেজি ‘ওপেনলি গে’ কথাটি প্রণিধানযোগ্য। সমকামিতা শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, ইউরোপ-আমেরিকাতে এখনও লজ্জাজনক যৌনতা ও যৌনপরিচয়! সমকাম-বিদ্বেষ বহু দেশে এখনও তীব্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিসমকামী-গোষ্ঠী অনেক সময়, সেখানে সংখ্যালঘু সমকামীর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। সামাজিক সমানাধিকার থেকে শুরু করে সমকামী-বিবাহ, সেখানকার বহু দেশে এখনও স্বীকৃত হলেও কুসুমাস্তীর্ণ পথে তা অর্জিত হয়নি মোটেই। অনেক রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাদের এইসব অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়েছে। তবু অনেক মানুষ সমকামী যৌনতার প্রশ্নে এখনও সেসব দেশে ‘ক্লোসেটেড’ (অন্তরালবর্তী)। তাঁদের মধ্যে গুটিকতক যাঁরা নিজেদের সমকামী যৌনপরিচয়ের কথা খোলাখুলি বলে দেন, যাঁরা ওই ‘ওপেনলি গে’, তাঁদের সাহসিকতা প্রশংসনীয়।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্ত হেনস্তা-হিংসার সম্ভাবনার চোখে চোখ রেখে তাঁরা নিজেদের যৌনপরিচয় ব্যক্ত করেন। অ্যাটাল যদিও যথেষ্ট উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে এবং ফ্রান্সের বিশিষ্ট স্কুল-কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁকেও এক সময় স্কুলে অন্যদের গুন্ডামির শিকার হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি জাতীয় শিক্ষামন্ত্রকে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন, এবং সরকারের মুখপাত্র ছিলেন করোনাকালে। সেই সময় যেভাবে তিনি আমজনতার সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ ধরে রেখেছিলেন, তাতে ফ্রান্সের ঘরে-ঘরে তাঁর নাম উচ্চারিত হত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রান্তিক যৌনতার মানুষ রাজনৈতিক পদে এসেছে মাত্র দু’টি বার– ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় বিধায়ক ছিলেন শবনম মৌসি আর ছত্তিশগড়ের রায়গড়ে মেয়র পদে আসীন মধু কিন্নর। দু’জনেই রূপান্তরকামী-নারী। অথচ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মহিলা-সংরক্ষণের কথা যখন ওঠে তখন রূপান্তরকামী-নারীদের কথা হয়ে পড়ে ব্রাত্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ইউরোপ-আমেরিকাতে খোলাখুলিভাবে যাঁরা সমকামী, যাঁরা প্রান্তিক যৌনগোষ্ঠীর মানুষ রাজনীতির উচ্চপদে তাঁরা খুব কম সংখ্যকই আসীন, তাও সেই সংখ্যা নগণ্য নয়। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস যদি দেখি, তবে হাতে-গোনা দু’জন ছাড়া কাউকেই রাজনৈতিক পদে স্বাধীনতার এই ৭৫ বছর পরেও কোনও দিন দেখা যায়নি। ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরকে যদি নির্লজ্জভাবে পুরুষের-হিন্দুর-উচ্চবিত্তের-উচ্চজাতির-শহরের বলে ধরি, তবে এর বিপরীতে আমরা সমানে-সমানে না হলেও নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী-দলিত ও তথাকথিত গরিবগুর্বোদের কিছু সংখ্যায় পেয়েছি। পাইনি কেবল, সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের। এর একটা কারণ, অবশ্যই ভারতের সমকাম-বিদ্বেষী সমাজ ও রাষ্ট্র।
সব পরিসরে মানুষের যৌনপরিচয় বড় হয়ে উঠবে না, এটা যেমন সত্য, তেমনই যৌনপরিচয়ের জন্যই সমাজে হেনস্তা-হিংসার শিকার হওয়া, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত হওয়া গোষ্ঠীর রাজনীতিতে প্রবলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়াও খুবই দরকার। যে ক্ষমতা মানুষকে প্রান্তিক করে রাখে, সেই ক্ষমতারই গর্ভগৃহে প্রবেশ করে, রাষ্ট্রের সামনাসামনি হওয়া ভারতীয় সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের আশু প্রয়োজন। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? হতে দিচ্ছে কে? ভারতের ইতিহাসে প্রান্তিক যৌনতার মানুষ রাজনৈতিক পদে এসেছে মাত্র দু’টি বার– ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় বিধায়ক ছিলেন শবনম মৌসি আর ছত্তিশগড়ের রায়গড়ে মেয়র পদে আসীন মধু কিন্নর। দু’জনেই রূপান্তরকামী-নারী। অথচ ভারতের রাজনীতিতে মহিলা-সংরক্ষণের কথা যখন ওঠে তখন রূপান্তরকামী-নারীদের কথা হয়ে পড়ে ব্রাত্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: এত বড় মাপের মানুষ হয়েও শিশুমনটা হারিয়ে ফেলেননি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের দলে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের দাঁড়ানোর কোনও জায়গা তৈরি করে না। ভারতীয় ভোটার সব ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠীকে ভোট দিতে প্রস্তুত, ভারতে অবিবাহিত মন্ত্রীরা আদর্শবাদী নেতার ভূমিকায় নির্দ্বিধায় উত্তীর্ণ অথচ সমকামী মানুষদের অন্তত খোলাখুলিভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে কোনও জায়গা নেই। ভারত মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা দলিত রাষ্ট্রপতি পেয়েছে, কিন্তু অদূরভবিষ্যতে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল অ্যাটালের মতো সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠী থেকে এক রাষ্ট্রনায়ক এ-দেশ পাবে, এমন আশা করা এখনকার পরিস্থিতিতে চরম হাস্যকর। কিন্তু সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষ জীবনের সমস্ত পথই ঐতিহাসিকভাবে লড়ে জিতেছেন, যখন ভারতে রাজনৈতিক পদও তাঁরা অচিরেই জিতে নেবেন এই স্বপ্ন হয়তো বৃথা যাবে না। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার অন্দরে প্রবেশের পর প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষরা যেন নিজেদের সংখ্যালঘুবোধ হারিয়ে না ফেলেন। তাহলে সংখ্যালঘুর সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি জয়ের কাহিনি, পুরোটাই এক অনাকাঙ্ক্ষিত হেরে যাওয়ায় পরিণত হয়। ভুলে গেলে চলবে না, গ্যাব্রিয়েল অ্যাটালই শিক্ষামন্ত্রকে থাকার সময়, স্কুলে-স্কুলে মেয়েদের ‘আবায়া’কে ধর্মীয়-পোশাকের তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, নারীস্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার তোয়াক্কা না করে।