পুরুষ-শাসিত সমাজে একটি শিশু জন্মলগ্ন থেকেই শিকার হয় লিঙ্গবৈষম্যের। জন্ম থেকেই লিঙ্গভেদে শিশুর বেড়ে ওঠার প্রতি পদক্ষেপে চাপিয়ে দেওয়া হয় সামাজিক শৃঙ্খলার বেড়ি। আসলে মেয়েরা পুরুষদের সমকক্ষ নন– এই ভ্রান্তধারণাকে প্রতিষ্ঠাদানের প্রয়াস যুগ-যুগ ধরেই চলছে। মেয়েরা সেই বাধাবিপত্তি জয় করেই, স্বতন্ত্র ও সাফল্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। লেখক সৌরাংশু-র ‘আনইভেন বার, ময়দানি স্ক্র্যাপবুক ৩’ সেই দুঃসাহসিকতার গল্প বলে।
‘আনইভেন বার’। গুগল সার্চ বারে যার অর্থ বলতে দাঁড়ায়, ‘অ্যান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস অ্যাপারেটাস’। কিন্তু ‘আনইভেন বার’ মানে শুধুই কি তাই? নাকি তাকে ছাপিয়ে অব্যক্ত আরও বেশি কিছু? আসলে ‘আনইভেন বার’, এক নিয়ত অসমঞ্জস্যতার কথা বলে। ‘আনইভেন বার’ অসমতার এক বাস্তব দলিল, যার মূর্ত বিগ্রহ আর কেউ নয়, নারী। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে, তাদের বেঁধে দেওয়া মাপকাঠির দুনিয়ায় মেয়েদের অবস্থান ঠিক কোন জায়গায়? আদৌ কি নারীদের প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তিতে সমান মঞ্চ দেওয়া হয়, যা তাদের জন্মগত অধিকার? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথাই বলে।
পুরুষ-শাসিত সমাজে একটি শিশু জন্মলগ্ন থেকেই শিকার হয় লিঙ্গবৈষম্যের। জন্ম থেকেই লিঙ্গভেদে শিশুর বেড়ে ওঠার প্রতি পদক্ষেপে চাপিয়ে দেওয়া হয় সামাজিক শৃঙ্খলার বেড়ি। আসলে মেয়েরা পুরুষদের সমকক্ষ নন– এই ভ্রান্তধারণাকে প্রতিষ্ঠাদানের প্রয়াস যুগ-যুগ ধরেই চলছে। মেয়েরা সেই বাধাবিপত্তি জয় করেই, স্বতন্ত্র ও সাফল্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। লেখক সৌরাংশু-র ‘আনইভেন বার, ময়দানি স্ক্র্যাপবুক ৩’ সেই দুঃসাহসিকতার গল্প বলে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘জিন্দেগি না মিলেগি দুবারা’-তে লেখকের কলমে ভাস্বর হয়ে উঠছে, ‘কিছু কিছু পথ সাধারণের অতিক্রম্য হয় না। কিন্তু এই সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই কিছু কিছু এমন মানুষ উঠে আসেন যাঁরা সমগ্র মানব সমাজের সামনে এক উদাহরণ হয়ে দাঁড়ান। গড়পড়তা জিন্দেগিতে পাহাড়প্রমাণ বিশ্বাসের প্রতীক। অরুণিমা সিনহা শুধু নিজের জন্যই তাঁর লক্ষ্যে সফল হননি। সঙ্গে দুনিয়ার আপামর জনতাকে এই বিশ্বাস জুগিয়েছেন যে সংকল্প এবং অধ্যবসায় দিয়ে অসাধ্যকে হাতের মুঠোয় করা যায়, ফাঁক দিয়ে তার বালি গলে না।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সিমোন দে বভয়র-সহ ১৩ জন বীরাঙ্গনাকে উৎসর্গ করে এই গ্রন্থনির্মাণ করেছেন লেখক। সেই সিমোন দে বভয়র তাঁর লেখা ‘লা দ্যাজিয়েম সেক্স’ (দ্য সেকেন্ড সেক্স) গ্রন্থে নারীবাদী চেতনার এক বিশিষ্ট দিক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। গ্রন্থটি লেখা হয়েছিল ১৯৪৯-এ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেভাবে নারীকে জড়বৎ এবং স্বপ্নহীন ও দুর্বল সামাজিক জীব হিসেবে পরিগণিত করে, তার মনস্তাত্ত্বিক ও ইতিহাসগত ব্যাখ্যা দেওয়ার জোরালো চেষ্টা সিমোন দে বভেয়র করেছেন তাঁর ‘লা দ্যাজিয়েম সেক্স’-গ্রন্থে। সময়ের চাকা ঘুরলেও সেই দৃষ্টিভঙ্গিগত বিভেদ, মেয়েদের প্রতি উপেক্ষা, লাঞ্ছনা ও অবহেলার চেনা পৃথিবীটা যে বিশেষ বদলায়নি, তার সাক্ষ্যবহন করে ‘আনইভেন বার, ময়দানি স্ক্র্যাপবুক ৩’। তবে এই ময়দানি স্ক্র্যাপবুক মেয়েদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে জায়গার করুণ বিয়োগান্তক কাহিনিতে ভরপুর নয়, বরং তা হার না মনোভাবে সম্পৃক্ত জিতে যাওয়ার গল্পকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা দিয়েছে প্রতিক্ষেত্রে। মোট ৩০টি অনুচ্ছেদে শুধু ব্যক্তিবিশেষকে প্রাধান্য না দিয়ে, সামগ্রিকভাবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সম্মান জানানো হয়েছে মহিলা খেলোয়াড়দের অদম্য জেদ ও লড়াইকে। উঠে এসেছে মানসিক স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। প্রাধান্য পেয়েছে অলিম্পিকের প্রাক্ পর্বে মহিলা অ্যাথলিটদের বঞ্চনার কাহিনি। জিনঘটিত তারতম্য নিয়ে অ্যাথলিটদের সংগ্রাম। আর সেই কাহিনির বীরাঙ্গনা কারা? শান্তা রঙ্গস্বামী থেকে শাইজা-শরমিন, দীপা মালিক থেকে অবনী লেখারা, মেরি কম থেকে রানি রামপল। দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে সেই বৃত্তে জায়গা করে নেন নাওমি ওসাকা, স্টেফি গ্রাফ, শাকেরি রিচার্ডসন থেকে ব্রাজিলের মার্থা, মার্কিনি মেগান রাপিনোরা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পাতাবাহার: সিদ্দালিঙ্গাইয়া মুখে কালি মেখেছিলেন যাতে তাঁকে কেউ চিনতে না পারে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আসলে সাফল্যের তো কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, যেমন নেই তার নির্দিষ্ট কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা। নির্বিশেষ থেকে বিশেষ হয়ে ওঠার এই যে জয়যাত্রা তা প্রাঞ্জল হয়েছে লেখক সৌরাংশু-র কলমের সজীবতায়। ‘জিন্দেগি না মিলেগি দুবারা’-তে লেখকের কলমে ভাস্বর হয়ে উঠছে, ‘কিছু কিছু পথ সাধারণের অতিক্রম্য হয় না। কিন্তু এই সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই কিছু কিছু এমন মানুষ উঠে আসেন যাঁরা সমগ্র মানব সমাজের সামনে এক উদাহরণ হয়ে দাঁড়ান। গড়পড়তা জিন্দেগিতে পাহাড়প্রমাণ বিশ্বাসের প্রতীক। অরুণিমা সিনহা শুধু নিজের জন্যই তাঁর লক্ষ্যে সফল হননি। সঙ্গে দুনিয়ার আপামর জনতাকে এই বিশ্বাস জুগিয়েছেন যে সংকল্প এবং অধ্যবসায় দিয়ে অসাধ্যকে হাতের মুঠোয় করা যায়, ফাঁক দিয়ে তার বালি গলে না।’ কে এই অরুণিমা সিনহা? অরুণিমা সিনহার জন্ম এক মধ্যবিত্ত সামরিক পরিবারে। জাতীয় স্তরে খেলেছেন ভলিবল। ২০১১-র ১২ এপ্রিল। দুষ্কৃতীরা তাঁকে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় সংজ্ঞাহারানো অরুণিমার বাঁ-পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় বিপরীত লাইন থেকে ছুটে আসা ট্রেন। হাসপাতালে চরম অব্যবস্থার মধ্যে জীবন সংশয়ে থাকা অরুণিমার বাঁ-পা চিরতরে বাদ পড়ে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পাতাবাহার: যে আলেখ্য বঙ্গ-রাজনীতির আধুনিক ইতিহাস রচনায় রসদ জোগাবে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কাহিনি এখানে শেষ নয়, শুরু। ২১ মে, ২০১৩। কৃত্রিম পা, আর রড বসানো অন্য পায়ে অনন্ত প্রতিকূলতাকে মহাশূন্যে ছুড়ে দুর্লঙ্ঘ্য এভারেস্ট জয় করেন অরুণিমা। তারপর একে একে বিশ্বের সমস্ত মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গজয়। অরুণিমার এই বিজয়গাথা, এই ‘আনইভেন বার’-এর একমাত্র আধার নয়, অংশবিশেষ। অরুণিমাদের পাশে দীপ্তশিখার মতোই উজ্জ্বল হয়ে হয়েছেন সুজান র্যাকের মতো ক্রীড়াসাংবাদিক, তালিবানি নাগপাশ ভেদ করে আফগানিস্তানের একঝাঁক মেয়েদের নিয়ে তাঁর স্বপ্নের উড়ানকে জড়িয়ে। রয়েছেন আরও অনেকে। প্রকৃতই, সৃষ্টিসুখ-এর অনবদ্য পরিবেশনায় ক্রীড়াক্ষেত্রের একঝাঁক বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বিনি সুতোয় মালা গেঁথেছেন লেখক সৌরাংশু। যে মালা দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে মেয়েদের সাফল্যের সৌরভে সুরভিত।
আনইভেন বার ময়দানি স্ক্র্যাপবুক ৩
সৃষ্টিসুখ
সৌরাংশু
২৯৯