১৯৪৯ সাল নাগাদ ভূপেন হাজারিকা কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বৃত্তি পেয়ে মার্কিন মুলুকে গিয়েছিলেন পড়াশুনো করতে। সেখানে শিল্পী এবং অ্যাকটিভিস্ট পল রবসনের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। এই ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ গানটির অনুসরণেই গানটির ভাবানুবাদ করেন অহমিয়া শিল্পী ভূপেন হাজারিকা– ‘বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও’। সেখানে মিসিসিপি নদীর বদলে বড়ুলাই বা ব্রহ্মপুত্র জায়গা নেয় সে গানে। তারপর তৈরি হয় এর একটি অসামান্য বাংলা ভার্সন, যেখানে বিষয় হয়ে ওঠে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী কৌম বাংলার ভূমিপুত্রদের জীবন যন্ত্রণা আর নিরন্তর লড়াইয়ের গল্প।
পৃথিবীর সমস্ত দেশের লোকায়ত গানের সঙ্গে মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, কারণ গানগুলোর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে কাটাছেঁড়া করলে দেখা যাবে, এগুলো উঠে এসেছে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবন, জীবনের নানা রীতি কিংবা দুঃখ-বেদনার গল্প থেকে। খেয়াল করে দেখা যাবে, মার্গ সংগীত– সে যে মহাদেশ বা যে ভূখণ্ডেরই হোক না কেন, তার আবেদন কিন্তু দেশ-কালের সীমা পেরলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে না। মার্গ সংগীত বা ক্লাসিকাল মিউজিকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার নিরিখে একটা সীমাবদ্ধতা আছে, তার কারণ এখানে জীবনের টাটকা গল্প মিশে নেই, তাই লোকায়ত গান, যাকে পশ্চিমের ভাষায় বলা হয় ‘কান্ট্রি মিউজিক’, তা এক দেশে জন্ম নিয়ে অন্যান্য দেশেও বিপুল জনপ্রিয় হয়, কখনও মুখে মুখে ফেরে। এভাবেই সারা পৃথিবীর দূর-দূরান্তের শিল্পীরা ‘আমাদের শিল্পী’ হয়ে ওঠেন।
প্রায় একশো বছর আগে, ১৯২৭ সাল নাগাদ ‘Show Boat’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। যার বিষয় ছিল মিসিসিপি নদীর বুকে নৌকোতে কালো মানুষদের জীবনযুদ্ধ। এই মিউজিক্যাল নাটকের গান হল ‘ওল্ড ম্যান রিভার’, অস্কার হাম্মেরস্টাইনের লেখা আর সুর জেরম কাৰ্ন। আর প্রায় বছর দশেক পর ১৯৩৬ সালে যখন পল রবসন এই গানটি রেকর্ড করলেন সিনেমার জন্য, তখন গানটি তোলপাড় করা জনপ্রিয়তা পেল আমেরিকায়। কালো মানুষদের নৌকো টানা জীবনের গল্প সুরের মোড়কে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এই গান একসময় দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এই উপমহাদেশে এসে আছড়ে পড়ল নদীর ঢেউয়ের মতোই। ১৯৪৯ সাল নাগাদ ভূপেন হাজারিকা কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বৃত্তি পেয়ে মার্কিন মুলুকে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। সেখানে শিল্পী এবং অ্যাকটিভিস্ট পল রবসনের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। এই ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ গানটির অনুসরণেই গানটির ভাবানুবাদ করেন অহমিয়া শিল্পী ভূপেন হাজারিকা– ‘‘বিস্তীর্ণ দু’পারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও।’’ সেখানে মিসিসিপি নদীর বদলে বড়ুলাই বা ব্রহ্মপুত্র জায়গা নেয় সে গানে। তারপর তৈরি হয় এর একটি অসামান্য বাংলা ভার্সন, যেখানে বিষয় হয়ে ওঠে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী কৌম বাংলার ভূমিপুত্রদের জীবন যন্ত্রণা, আর নিরন্তর লড়াইয়ের গল্প আর গঙ্গার নিরন্তর বহমানতা, যা এপার বাংলা ওপর বাংলার মানুষকে কার্যত দুলিয়ে দেয়। আর এখানেই পল রবসন কী করে যেন আমাদেরও শিল্পী হয়ে ওঠেন। সকল মানুষের হাহাকার এক সুরে আর্তনাদ হয়ে ওঠে। সেখানে আর দেশ-কালের সীমানা থাকে না। তাই ভাই পল রবসন-কে নিয়েই এ দেশের মানুষ গেয়ে ওঠে– ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রো ভাই আমার পল রবসন’। বাংলার ঘর খোয়ানো মানুষের দল হিম্মত দেখায় একথা জানাতে যে, পল রবসন তাদেরই ভাই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: এই একটা লোকের মূর্তি আর কদ্দিন ধরে ভাঙবে ওরা?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘বিস্তীর্ণ দুপারে’ গানটির সুর শুনলে তো বোঝাই যায় না, তা পশ্চিম থেকে আমদানি হয়েছে। মনে হয় এ তো যেন আমাদেরই সুর, আমাদের মাটির সুর। লোকায়ত সুর এমনই ম্যাজিক তৈরি করতে পারে। প্রসঙ্গত আরেকটা ছোট্ট কথা শেষে বলি, তা হল পৃথিবীর সমস্ত মার্গ সংগীতের উৎসও কিন্তু লোকায়ত সুর, তবে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের নানা পর্যায়ে ও স্তর আছে, যা বহু শতাব্দীর ইতিহাস।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved