সম্ভবত ১৯৮৫-’৮৬ সালে,তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, একবার পটলডাঙায় অজিতকাকুর বাড়িতে গিয়েছি, কথায় কথায় প্রশ্ন করে বসলাম– ‘টেনিদার বাড়ি কোথায়?’ আমি তখন জানি যে, টেনিদা বলে সত্যিই একজন ব্যক্তি রয়েছেন । অজিতকাকাই বললেন, পটলডাঙায় যে টেনিদা আছেন লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁরই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এবং খুব কাছেই সেই বাড়ি। আমি তৎক্ষণাৎ আবদার করে বসলাম, আসল টেনিদার সঙ্গে দেখা করতে যাব। অজিতকাকার ছেলে পার্থ, টেনিদার বাড়িটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েই চলে গেল।
ছোটবেলায় আমার একবার পটলডাঙার আসল টেনিদার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবার ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অজিতকাকা থাকতেন পটলডাঙায়। ট্রামে চড়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট ক্রসিং-এ নেমে সরু একটা গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে পৌঁছতাম অজিতকাকার বাড়ি। জায়গাটার নাম যদিও জেনেছিলাম আর একটু বড় হয়ে। তবে একদম ছোটবেলা থেকেই আমার ওই পাড়ায় যাতায়াত ছিল। তখন তেমন গল্পের বই পড়া শুরু করিনি, ফলে টেনিদার নামও জানতাম না। যতদূর মনে পড়ছে, টেনিদার নাম প্রথম জেনেছিলাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে নয়, বরং ওঁর স্ত্রী আশা দেবীর লেখা পড়ে। ছোটবেলায় আমার খুব প্রিয় বই ছিল ‘সেরা সন্দেশ’। আটের দশকের গোড়ার দিকে সেখানেই প্রথম পড়ি আশা দেবীর লেখা ‘আসল টেনিদা’। সেটা পড়েই আমার টেনিদার গল্পগুলো পড়ার ইচ্ছে তৈরি হয়। তারপর যখন আর একটু বড় হলাম তখন গল্পের বইয়ের নেশা ধরল, পরিচয় হল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা গল্পের টেনিদা, হাবুল, ক্যাবলা এবং প্যালার সঙ্গে।
টেনিদার সঙ্গে অজান্তেই আরও একটা যোগাযোগ ঘটেছিল বটে, তবে সেটা খুবই ছোটবেলায়। একটা গানের সূত্রে। বছর পাঁচেক বয়সে একবার পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা বাবার বন্ধুদের পরিবারের সঙ্গে দল বেঁধে। সেই দলে আমরা বেশ কয়েকজন ছোট ছেলেমেয়ে ছিলাম। আমাদের মধ্যে যে সবথেকে বড় সে একটা গান শিখিয়ে ছিল। ‘ঘচাং ফু খাবো তোকে , গিলে গিলে গিলে গিলে’। গানের কথার অভিনবত্বের জন্য নাকি এর মুডের জন্য জানি না, সেই পাঁচ বছর বয়েসেই গানটা আমার মনে দাগ কেটেছিল। মনে আছে, সন্ধেবেলা সি-বিচে আমরা ছোটরা ঘুরে ঘুরে এই গানটা গাইতাম। যদিও এরসঙ্গে টেনিদার কি যোগাযোগ সেটা একেবারেই জানা ছিল না, জানা সম্ভবও ছিল না। ‘চারমূর্তি’ ফিল্মটা দেখি অনেক বছর পরে, কোনও এক শনিবারে, যখন আমার মামাবাড়িতে প্রথম সাদা-কালো টিভি আসে।
এর কিছুদিন পরে, সম্ভবত ১৯৮৫-’৮৬ সালে, তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, একবার পটলডাঙায় অজিতকাকুর বাড়িতে গিয়েছি, কথায় কথায় প্রশ্ন করে বসলাম– ‘টেনিদার বাড়ি কোথায়?’ আমি তখন জানি যে, টেনিদা বলে সত্যিই একজন ব্যক্তি রয়েছেন । অজিতকাকাই বললেন, পটলডাঙায় যে টেনিদা আছেন, লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁরই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এবং খুব কাছেই সেই বাড়ি। আমি তৎক্ষণাৎ আবদার করে বসলাম, আসল টেনিদার সঙ্গে দেখা করতে যাব। অজিতকাকার ছেলে পার্থ, টেনিদার বাড়িটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েই চলে গেল। আমি আর বাবা ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একতলাটা বেজায় অন্ধকার। একটা ঘর পেরিয়ে সামনে উঠোন। সেখানে চৌবাচ্চা থেকে জল তুলছে একটা হিন্দুস্তানি চাকর (এইসব কথা আবার আজকাল পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট বলে গণ্য হয়, কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি তখন তেমন ছিল না, আর টেনিদার মেজাজটা ধরতে গেলে এটা বাদ দেওয়াও যায় না, তাই রেখে দিলাম, পাঠক ক্ষমা করে দেবেন)। বাবা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে টেনিদা কোথায় থাকেন’? চাকরটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘টেনিদা! ইয়ে নাম সে কোই নেহি রহতা হ্যায় ইধর।’ এই সেরেছে! বলে কী। এখন আমরা কী করব ?
সেই সময় একটি বছর পঁচিশের ছেলে বাড়িতে ঢুকছিল। সে আমাদের দেখে জানতে চাইল, ‘কাকে খুঁজছেন’? আমরা বলার আগেই চাকরটা বলে উঠল, ‘আরে ইয়ে লোগ কোই টেনিদাকো ঢুঁড় রাহা হ্যায়, ম্যায় বোলা ইধার কোই নেহি হ্যায় ইস নাম কা , নেহি শুনতা হ্যায়’। ছেলেটা একটু হেসে বলল, ‘ও তুমি টেনিদাকে দেখতে এসেছ, দাঁড়াও।’ এবার সে হাঁক দিল, ‘ জেঠু, তোমার সঙ্গে কারা দেখা করতে এসেছেন।’ জেঠুর গলা পেলাম, ‘ওপরে পাঠিয়ে দে।’ উঠোন থেকেই খোলা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। উঠতে উঠতেই শুনতে পেলাম চাকরটা বলছে, ‘হায় রাম,বড়া বাবুকা নাম টেনিদা হ্যায় কেয়া!’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কাঠ খোদাইয়ের কবি, আমার শিক্ষক হরেন দাস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দোতলায় পৌঁছতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সৌম্যদর্শন ছিপছিপে চেহারার এক বয়স্ক মানুষ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথায় হালকা হয়ে আসা চুলের সবটাই সাদা। আর পেল্লায় খাঁড়ার মতো নাক। আসল টেনিদা! বাবা বলল, ‘আপনার গল্প পড়ে আমার ছেলে আপনাকে দেখতে এসেছে।’ আমি ওঁকে প্রণাম করতেই আমার হাত ধরে উনি কাছে টেনে নিলেন, তারপর নিজের নাকটা দেখিয়ে বললেন, ‘ভাল করে দেখো তো দাদুভাই, নাকটা মিলছে, গল্পের সঙ্গে’? তারপর জানতে চাইলেন আমি টেনিদার কী কী গল্প পড়েছি, কোন ক্লাসে পড়ি ইত্যাদি। সব বললাম, তারপর ফেরার সময় বললেন, ‘একদিন হাতে সময় নিয়ে এসো, অনেক গল্প আছে, সব বলব।’ আমি আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিন ইশকুলে বন্ধুদের কাছে গল্প করতে প্রথমে তো তারা বিশ্বাসই করতে চায় না । পরে, ‘এটা জিজ্ঞেস করলি না কেন, ওটা জিজ্ঞেস করলি না কেন’ ইত্যাদি বলে আমাকে প্রায় পাগল করে দিল। আমি বললাম পরেরবার যখন পটলডাঙায় যাব তখন সব জিজ্ঞেস করে আসব।
সেই পরের বার আর এল না, আর যাওয়া হয়ে উঠল না টেনিদার বাড়ি। আমিও ধাঁ করে কীভাবে জানি বড় হয়ে গেলাম। ৩৮ বছর পরে এ লেখা লিখতে লিখতে সব ছবির মতো মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সেই বয়সের কতকিছুই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমার স্মৃতি থেকে, অথচ এই ঘটনাটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ এবং উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে মনের মধ্যে।