পিতা-পুত্র সম্পর্কটা নবগণিত মুকুলে যতটা জটিল, বাস্তব জীবনে আরও জটিলতর। পাড়ার ঝঞ্ঝাট থেকে নাটকের সংলাপ– বাবার পরিচয় নিয়ে টানাটানিটাই দস্তুর। সে মুখের আদলে কিংবা স্বভাবগুণে ‘বাপ কা বেটা’ না হলেও। কিন্তু বাবাদের সমস্যা যে অন্য। বাবারা কীভাবেই বা দাবি করবেন, তিনি কারও বাবা!
২৫.
দাদা বলল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমায় নাকি বাবার মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে চুল পেকে যাওয়ার পর থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে সেরকমই মনে হল, বাবার মাথায় যেখানে টাক পড়েছিল আমারও সেই অঞ্চল পাতলা হচ্ছে। অথচ ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আমায় একেবারে অন্যরকম দেখতে, যদি একটুও মিল থাকে সেটাও মামাবাড়ির দিকে।
হাফ-প্যান্ট বয়সে ‘ফুটবল’ নাটকটি দেখেছিলাম। চরিত্র, সংলাপ কয়েক দিন পর ভুলে গেলাম। শুধু একটি গান মনে গেঁথে রইল– ‘বাবা কে তোর? বাবা কে তোর, বাবা কে তোর রেফারি?’ গানটি একটি ট্র্যাডিশনাল আমেরিকান ব্যালাডের সুরে গাওয়া। মূল গানটি আমার বাবা বাড়িতে মাঝে মাঝে গেয়ে উঠতেন। নাটকের গানটি শুনে খুব আমোদ পেয়েছিলাম, কারণ রেফারিকে কেউই কোনও দিন পছন্দ করে না। কিন্তু গানের ওই প্রশ্নের মধ্যে যে একটি গূঢ় তত্ত্ব নিহিত আছে, সেটি অনুধাবন করতে অনেক বছর লেগেছিল। যেদিন পাড়ায় প্রথম হুমকি শুনেছিলাম, এই ক্লাব ওই ক্লাবের ঝঞ্ঝাটে, তার মূল বয়ান ছিল– ‘মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব’। বাড়ি ফিরে মনে হয়েছিল, সাবধানের মার নেই, একটা সাদা পাতায় ১০৮ বার বাবার নাম লিখে তোরঙ্গে রেখে দিই। এই সমস্ত কথনে, স্টেজের নাটক থেকে পাড়ার ঝঞ্ঝাট, মা উহ্য। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাবা-রা প্রাধান্য পাবেন, সেটা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে বড় হতে থাকি। কিন্তু বাবা কন্সট্রাক্টটি যে এক গভীর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে পিসার টাওয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সেই চিন্তা মাথায় ঢুকতে বয়স আঠারো পেরিয়ে যায়। সেই জটিল মনস্তত্ত্বের দরজা আমার সামনে হাট করে খুলে দেওয়ার জন্য বাবাকেই ধন্যবাদ দিতে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দাদা বলল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমায় নাকি বাবার মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে চুল পেকে যাওয়ার পর থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে সেরকমই মনে হল, বাবার মাথায় যেখানে টাক পড়েছিল আমারও সেই অঞ্চল পাতলা হচ্ছে। অথচ ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আমায় একেবারে অন্যরকম দেখতে, যদি একটুও মিল থাকে সেটাও মামাবাড়ির দিকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে ওই ধন্যবাদ মানে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলা থেকেই এক গ্রীষ্মের দুপুরে আমাদের দ্বৈরথের শুরু। আমার ধন্যবাদ-জ্ঞাপন টিপিক্যাল বাবাসুলভ জ্ঞানের উত্তরে, একটু ঠেস দিয়ে। আর যায় কোথা! ‘বাবা-কে কেউ থ্যাঙ্ক ইউ বলে না’, এই যুক্তি দিয়ে উচ্চগ্রামের সিম্ফনি শুরু হয়, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সদ্য আঠারোকেও কয়েক অক্টেভ চড়তে হয়। মা কিছুক্ষণ মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেন। উভয়পক্ষের যুক্তির ভাণ্ডার যখন প্রায় শূন্য, বাবা রাগে ফেটে পড়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা আমার ঔরসে তোমার জন্ম, এ ব্যাপারে কি তোমার সন্দেহ আছে?’ এটি একটি গভীর প্রশ্ন। আমার বার্থ-সার্টিফিকেট নেই। যে হাসপাতালে জন্মেছিলাম, শুনেছি সেটিতে তালা পড়েছে। তখনও ভোটার আইডি-র ফর্ম ভরা হয়নি, পাসপোর্টের প্রশ্নই ওঠে না, রেশন কার্ড ছেঁড়া-ফাটা। শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের রেজিস্টার বা আডমিট কার্ড সম্বল। এদিকে ‘ঔরস’ একটি খটমট শব্দ। তার অভিঘাতে আমি ঘাবড়ে যাই এবং বাসে চেপে সোজা ধর্মতলায়, সিনেমা। মাথার মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, একজন বাবা কী করে দাবি জানাবেন যে, তিনি কারওর বাবা। একই সমস্যা একজন সন্তানের তার বাবা-কে নিয়ে। মা’র যেমন অনেক সাক্ষী আছেন, ডাক্তার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। যখন আমি ভূমিষ্ঠ হচ্ছি কেউ না কেউ তো দেখেছেন,। তাঁদের মধ্যে অনেকে আমায় বড় হতে দেখেছেন। কিন্তু ধর্মাবতার, ঠিক কোন শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর মিলনে আমি নিষিক্ত হয়েছি, এর তো কোন প্রত্যক্ষদর্শী থাকার সম্ভাবনাই নেই।
মা’কে প্রশ্ন করব, সেই সাহস নেই। ‘রিডারস ডাইজেস্ট’ বা ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এ ডি-এন-এ টেস্টের ওপর মনোজ্ঞ আর্টিকেল দেখেছি বটে, কিন্তু সে তো তখন প্রথম বিশ্বের কুক্ষিগত টেকনোলজি। চিন্তায় আমার বীররস কিঞ্চিৎ শুকিয়ে যায়, তাই অন্ধকার নামলে বাড়ি ফিরি। উঠোনের এক কোণে মা বসেছিলেন গালে হাত দিয়ে, কারণ বাবা-ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তবে এর ফলে একটি উপকার হয়। নিজের মধ্যে এক স্বাধীন চেতনার উন্মেষ ঘটে। নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করি। ক্রমে ভোটার আইডি হয়, পাসপোর্ট-ভিসা হয়, বিদেশ হয়, দেশে ফিরে ফ্ল্যাট হয় এবং জায়গা বদল। সেই দুপুরের পর অনেকগুলো দুপুর পার করে বন্ধু দেবদত্ত যখন মানিকতলায় ভোটের লাইন থেকে ফোন করে তখন খেয়াল হয়, ভোটার কার্ডে পুরনো পাড়ার ঠিকানা রয়ে গেছে। তখন আধার জন্মায়নি। সে জানায় তার সামনে স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট, গলায় চেইন, হাতে বালা পরিহিত এক নাগরিক বলছেন, তিনি নাকি আমি। হাতে অন্য কোনও প্রমাণপত্র। দেবদত্তকে অনুরোধ করি ওঁর বাবার নাম জিজ্ঞেস করতে, কারণ আমার ভোট-সংক্রান্ত নথিতে বাবার নাম থাকবে নিশ্চয়। সে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জানায়, সেই নামও মিলিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই ঘটনায় আমি একেবারেই বিচলিত হই না। বরং ১০৮ বার বাবার নাম লেখার চাপ অন্য কেউ ঘাড়ে নিল ভেবে কিঞ্চিৎ হালকা বোধ করি।
…পাল্টি-র অন্যান্য পর্ব…
পাল্টি পর্ব ২৪: মাকুন্দ বলে যৌনপ্রস্তাব পেয়েছিলাম, জেনেছিলাম ওঁর বান্ধবীর মধ্যেও এত নারীত্ব নেই
পাল্টি পর্ব ২৩: যে মানুষী জ্বলছিলেন দাউদাউ করে, তাঁর গায়ে বৃষ্টি পড়েনি
পাল্টি পর্ব ২২: বাংলা মদের মতো বাংলা ভাষার নেশাটাও যদি চিরস্থায়ী হত!
পাল্টি পর্ব ২১: সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো
পাল্টি পর্ব ২০: যে কারণে বুলাদির মর্তে আগমন
পাল্টি পর্ব ১৯: আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?
পাল্টি পর্ব ১৮: ‘আসল হিজড়ে’ কথাটা সোজা মাথায় আঘাত করে
পাল্টি পর্ব ১৭: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
পাল্টি পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
পাল্টি পর্ব ১৫: পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক
পাল্টি পর্ব ১৪: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
পাল্টি পর্ব ১৩: আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়
পাল্টি পর্ব ১২: টিবি হয়েছে বলে আড়ালে বন্ধুটির নাম দেওয়া হয় ‘কিশোর কবি’
পাল্টি পর্ব ১১: ডোমেরা জানে, আগুনের তর সয় না
পাল্টি পর্ব ১০: আমেরিকায় খুন হওয়ার থেকে স্বদেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ভাল
পাল্টি পর্ব ৯: মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে?
পাল্টি পর্ব ৮: খোকাবাবু, ম্যাডাম স্যুইটে আছেন, এক ঘণ্টায় ৪০০ দেবেন বলছেন
পাল্টি পর্ব ৭: ও তো সন্ধে থেকেই গিরিশ ঘোষ
পাল্টি পর্ব ৬: যে দোকানের বেবিফুডে বেড়ে উঠলাম, সেখান থেকেই বীরদর্পে কন্ডোম কিনেছি
পাল্টি পর্ব ৫: প্রায়শ্চিত্ত রোল অ্যান্ড কর্নার
পাল্টি পর্ব ৪: দু’অক্ষর কথা, চার-অক্ষর কথা
পাল্টি পর্ব ৩: ‘টুকলি’ ঈশ্বরের দয়ার শরীর
পাল্টি পর্ব ২: পাগলি তোমার সঙ্গে
পাল্টি পর্ব ১: প্যান্টি যেন বদ্বীপ, লাজুকলতা নরম কাপড় জুড়ে যাবতীয় গোপনীয়তা