ওয়াকিবহাল শিবিরের একাংশের মতে, গত বছরের তুলনায় কম সংখ্যক বই বিক্রি হয়েছে এবারের বইমেলায়। কত শতাংশ কম তা আমরা জানতে পারি না। আর এই তথ্য জানতে না পারলে বইয়ের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কেও কোনও ধারণা করা যায় না। অনেক প্রকাশকই বলেছেন, ‘কাগজের দাম এত বেড়েছে যে আমাদের বইয়ের দাম না বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না আর।’ কাগজের বেড়ে যাওয়া দামের সঙ্গে বইয়ের বর্ধিত মুদ্রিত মূল্য সমানুপাতিক কি না, আমরা জানি না। শুধু জানি, এ বছরে ২৮ কোটি। ভেঙে গিয়েছে রেকর্ড।
অনলাইন খুচরো বিপণি কিংবা সুসজ্জিত শপিং মলের কোনও বাহারি আউটলেট– মালিক থেকে কর্মীদের খাতায় বিক্রির পরিমাপ করা হয় মূলত দুটি বিষয়ের ওপর। টেকনিক্যাল পরিভাষা ব্যবহার করলে বলা যেতে পারে, ‘সেলস’ আসলে দুটি জিনিসের গুণফল। এক, নাম্বার অফ বিলস অর্থাৎ কতগুলো বিল তৈরি হল। দুই, অ্যাভারেজ বিল ভ্যালু। মানে, দ্রব্যগুলো স্ক্যান করে এন্টার মারার পরেই জমিয়ে রাখা কথার মতো হুড়হুড় করে যে বিলগুলো বমি করে দিল মনিটরের পাশে বসানো ছোট প্রিন্টার– তার গড় মূল্য কত। বিলের সংখ্যার সঙ্গে বিলের গড় মূল্য গুণ করলে যে সংখ্যাটি আসে, সেটাই হল বিক্রির পরিমাণ। অর্থাৎ, গ্রস সেলস ভ্যালু। একই সঙ্গে আরও কয়েকটা বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে। তা হল, বিক্রি যে বাড়ছে (অথবা কমছে), তার সঠিক কারণটি কী? মাসের শেষে বেড়ে যাওয়া সেলস ভ্যালুর মূলে কি রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি বা ইনফ্লেশন? বাজারের যাবতীয় সামগ্রীর প্রতিটিরই যে ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি হবে, তার কোনও মানে নেই। অনেক সময় জিনিসের দাম কমেও যায়। অন্যতম উদাহরণ, ভোজ্য তেল। মূল্যহ্রাস সত্ত্বেও যদি সেলস ভ্যালু বাড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, বিক্রিত দ্রব্যের পরিমাণ (সেলস কোয়ান্টিটি) বেড়েছে। এমন খবর যে কোনও সংস্থার কাছে ‘মেঘের শাসন ঘুচিয়ে দেওয়া আলোর ভালবাসা’-র মতো। তবে আজকের দুনিয়ায় এমন উদাহরণ বিরল। আধুনিক খুচরো বিপণিগুলি একই সঙ্গে অন্য যে বিষয়ের পর্যালোচনা করে, তা হল বিল পেনিট্রেশন।
জটিল ব্যাপার। একটু খোলসা করে বলা যাক। তর্কের খাতিরে কোনও প্রখ্যাত ব্র্যান্ডের ইনস্ট্যান্ট নুডলকে কাঠগড়ায় আনা যেতে পারে। যদি বলা হয়, দ্রব্যটির বিল পেনিট্রেশন ৪.১ শতাংশ, তাহলে বুঝব, ১০০টি বিলের মধ্যে ৪.১টি বিলে এই নুডলটি রয়েছে। এবারে যদি বিল পেনিট্রেশন কোনও কারণে ৪.১ থেকে ৩.৮ শতাংশে নেমে যায়, তাহলে ওই নুডল প্রস্তুতকারক সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের কপালে ভাঁজ পড়তে বাধ্য। এর অর্থ হল, ক্রেতাদের মধ্যে ওই ব্র্যান্ডের নুডলের জনপ্রিয়তা কমছে। হয়তো মার্কেট শেয়ার খেয়ে নিচ্ছে প্রতিযোগী কোনও ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট। কিংবা এটাও হতে পারে যে, চটজলদি নুডল নামে পরিচিত দ্রব্যগুলির থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সামগ্রিকভাবে। বিশেষজ্ঞরা কি সাধে বলেন, সেলস-এর মতিগতি বড় বিচিত্র! কী করলে ক্রেতাদের শপিং ট্রলিতে জায়গা করে নেওয়া যাবে, তা হয়তো দেবতাদেরও অজানা! আরও কঠিন বিষয় হল, একবার জায়গা করে নিলেও সেই স্থানটিকে টিকিয়ে রাখা। সামগ্রীগুলির গায়ে নানা মার্কেটিং টুলস-এর জাদুহাওয়া না লাগাতে পারলে প্রতিযোগিতার বাজারে টেকা মুশকিল। সারা দুনিয়ার সেলস ও মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন। মার্কেটিং-এর নানা আন্তর্জাতিক জার্নাল বলে, এ-বিষয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বাৎসরিক বই পার্বণ শেষ হওয়ার পরে হাতেগোনা কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া অন্যদের মুখে এবার হাসি ফোটেনি তেমন। ফেলে আসা বছরগুলোর বইমেলার শেষে তাঁরা যে খুব খুশি থাকতেন এমন ধারণাও ভুল। তবে সময় এগোচ্ছে যত, তাঁদের সন্তুষ্টির পরিমাণ কমছে ক্রমশ। এক পরিচিত প্রকাশককে বলতে শুনেছিলাম, “এই দু’সপ্তাহের উৎসবের জন্য প্রাণপাত করি ভাই, সদলবলে। কিন্তু লক্ষ্মীদেবী ঠিক করেই রেখেছেন যে, আমাদের দেখলেই মুখ ভার করে থাকবেন।”
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
গৌরচন্দ্রিকাটি বেশ বড় হয়ে গেল জানি। কিন্তু এ-বিষয়ে এতগুলো কথা একসঙ্গে উগরে দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না। প্রসঙ্গে আসি। কলকাতা বইমেলা এবারে বই বিক্রির রেকর্ড করেছে। খবরে প্রকাশ, সদ্য শেষ হওয়া এ বছরের আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় বই বিক্রি হয়েছে ২৮ কোটি টাকার। এটি সর্বকালীন রেকর্ড। আরও জানা গিয়েছে, দু’-সপ্তাহের এই বই পার্বণে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়েছিলেন ২৯ লক্ষ মানুষ। গিল্ড কর্তৃপক্ষ এই খবরে খুশি। এই সংখ্যাগুলো সংবাদমাধ্যমের কাছে জানানোর সময় তাঁদের কথায় অনেক আশা মিশে ছিল। ভরসাও। তবে সেলস ও মার্কেটিং দুনিয়ার অলিগলিতে যাঁরা চলাচল করতে বাধ্য হন প্রতিনিয়ত, তাঁরা জানেন, এমন তথ্য এক আংশিক ছবির কথা বলা বলে। গিল্ডকর্তাদের অনেকেই হয়তো বলবেন, ‘বাঙালি যে বই বিমুখ– এই ধারণাকে ফের ভুল প্রমাণ করে দিল বই বিক্রির অঙ্ক।’ তবে মজার কথা হল, শুধুমাত্র বই বিক্রির মূল্য দিয়ে যদি আমাদের বইপ্রেমের সঙ্গে একটি সমাধানসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়, তাতে থেকে যাবে মস্ত গলদ!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দেবাশিস গুপ্তর লেখা: ফিরে দেখা ‘প্রতিক্ষণিকা’, বইমেলার দৈনিক বুলেটিন
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাৎসরিক বই পার্বণ শেষ হওয়ার পরে হাতেগোনা কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া অন্যদের মুখে এবার হাসি ফোটেনি তেমন। ফেলে আসা বছরগুলোর বইমেলার শেষে তাঁরা যে খুব খুশি থাকতেন এমন ধারণাও ভুল। তবে সময় এগোচ্ছে যত, তাঁদের সন্তুষ্টির পরিমাণ কমছে ক্রমশ। এক পরিচিত প্রকাশককে বলতে শুনেছিলাম, “এই দু’সপ্তাহের উৎসবের জন্য প্রাণপাত করি ভাই, সদলবলে। কিন্তু লক্ষ্মীদেবী ঠিক করেই রেখেছেন যে, আমাদের দেখলেই মুখ ভার করে থাকবেন।” শীর্ণকায় মানুষটি থামলেন খানিক। তিন-চার মাসের টানা পরিশ্রমে ও রাত জাগায় চোখের তলায় কালি। ফের বললেন, ‘মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি বলব এবং সোজাসুজি বলব, এই বইমেলা আসলে সরকারি উদ্যোগে এক হুজুগে আয়োজন ছাড়া অন্য কিছু নয়। উপায় নেই তাই আসতে বাধ্য হই, হেরে যাব জেনেও।’ বুঝতে পারি, গিল্ডকর্তারা তাঁদের খুশির খবর যতই আম-আদমির সামনে আনুন না কেন, এই হাসির পরিধি বেশি দূর ছড়ায় না। প্রকাশকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, আমাদের অবসরযাপনের বিবিধ উপকরণের তালিকা ক্রমশ যত লম্বা হবে, আরও ব্রাত্য হয়ে যাবে বই। এ শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই বেশ ভাল আছি আমরা, বইবিহীন রোজনামচায়।
বইমেলার বই বিক্রির এই সার্বিক সংখ্যাকে যদি একটু ভেঙে দেখার চেষ্টা করা হয়, দেখা যায়, তা আর ভাঙে না! কর্পোরেট জগতের ভাষায় সংখ্যা নিয়ে আরও নাড়াচাড়া করার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ড্রিলিং ডাউন।’ ২৮ কোটির বই বিক্রির একটু বিস্তারিত বিবরণ পাওয়ার চেষ্টা করলে আদতে কোনও উত্তর মেলে না। শুনেছি, বইমেলায় কত টাকার বই বিক্রি হল, তা গিল্ডের কাছে জানানোর জন্য প্রকাশকরা কোনওভাবেই দায়বদ্ধ নন। ফলে, ২৮ সংখ্যাটির পরে এতগুলো শূন্যের সমষ্টি দেখার পরে আমাদের মনে তৈরি হওয়া খুশি-খুশি ভাব কতটা ‘লজিক্যাল’, তা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। ধরে যাক, সংখ্যাটি সত্যি। ঝড়ের মতো পরের প্রশ্ন ধেয়ে আসে মনে। ২৮ কোটি তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু বিক্রিত বইয়ের সংখ্যা কত? প্রশ্নটি সহজ হলেও এর উত্তর দিকশূন্যপুরে। প্রকাশকরা বলবেন, ‘এ তো ব্যক্তিগত তথ্য। আপনাকে দেব কেন?’ সঠিক উত্তর!
বইমেলা থেকে পাওয়া বই বিক্রির খতিয়ান নিয়ে ছোটবেলায় শেখা পাটিগণিতের অঙ্ক ফের কষে দেখতে ইচ্ছে করে। যত বই বিক্রি হল, তার গড় দাম কত? এই তথ্যটি জানার জন্য বিক্রিত বইয়ের সংখ্যা জানা জরুরি। ২৮ কোটিকে ওই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে গড় দাম। তা জানার কোনও উপায় নেই কারণ বই বিক্রির পরিমাণ আমাদের অজানা। ফলে বিক্রিত বইয়ের মূল্যে এ বছরের বইমেলা বিগত বছরগুলিকে টেক্কা দিলেও বিক্রিত বইয়ের সংখ্যায় কোনখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে সম্বন্ধে কোনও সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে না আমাদের মনে। ওয়াকিবহাল শিবিরের একাংশের মতে, গত বছরের তুলনায় কম সংখ্যক বই বিক্রি হয়েছে এবারের বইমেলায়। কত শতাংশ কম তা আমরা জানতে পারি না। আর এই তথ্য জানতে না পারলে বইয়ের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কেও কোনও ধারণা করা যায় না। অনেক প্রকাশকই বলেছেন, ‘কাগজের দাম এত বেড়েছে যে আমাদের বইয়ের দাম না বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না আর।’ কাগজের বেড়ে যাওয়া দামের সঙ্গে বইয়ের বর্ধিত মুদ্রিত মূল্য সমানুপাতিক কি না, আমরা জানি না। শুধু জানি, এ বছরে ২৮ কোটি। ভেঙে গিয়েছে রেকর্ড!
মোট বিলের পরিমাণ কত বইমেলায়? নাম্বার অফ বিলস? উত্তর অজানা। যে পরিমাণ মানুষ আসছেন, তার কত শতাংশ বই কিনছেন তা জানার জন্য আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। ফলে মানুষের বইপ্রেম আদৌ বাড়ছে কি না, তা নিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের ওপরে ভর করে তর্ক করার কোনও উপায় নেই আমাদের। বিক্রির অর্থকে মেলায় আগত মানুষের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যা মেলে, তা হল মাথাপিছু কত টাকার বই কেনা হল। কিন্তু পরিসংখ্যানবিদদের কাছে এই প্রশ্ন আসে অনেক পরে। এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি প্রশ্নের উত্তর কোনও অজ্ঞাত কারণে আমাদের জানা নেই। ফলে বাঙালির বইপ্রেম দিয়ে কথা বলতে শুরু করলে যা খেলা করে, তা হল মেলায় দেখা রংবেরঙের বুদ্বুদ। গায়ে আলো পড়ে রামধনু রং খেলে গেলেও তিন-চার সেকেন্ডের বেশি ওদের অস্তিত্ব থাকে না।
সংগঠিত ক্ষেত্রে যে ব্যবসাগুলি চলে, বছরের শেষে তার অধিকাংশেরই পারফরম্যান্স রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ না থাকা বহু সংস্থাও তা প্রকাশ করে, ক্রেতাদের জ্ঞাতার্থে। প্রকাশনাশিল্পে এমন কোনও নজির চোখে পড়ে না। ‘প্রকাশের ১০ দিনের মাথায় প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত’ বলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন গর্বিত লেখক কিংবা প্রকাশক। কিন্তু, প্রতি সংস্করণে কত কপি বই ছাপা হয়, আমরা জানি না। ফেসবুকে দেখা একটি সাম্প্রতিক পোস্টের কথা মনে পড়ছে। একজন জানতে চেয়েছিলেন, ‘এবারের বইমেলায় বেস্টসেলার কী?’ কমেন্টবক্স উপচে পড়েছিল। বহু মানুষ লিখেছিলেন, ‘কেন? মোমো আর ফিশ ফ্রাই।’
তর্কের এই প্রাচীন বিষয় অমরত্ব পেয়েছে, আমাদের গুণেই। হাওয়ার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি জারি থাক। বিতর্ক সতত সুখের।