ঋতুর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’র স্ক্রিপ্ট। বাবা সেখানে পরিবারের মুখ্য– এরকম একটা চরিত্র করেছিল। আমি স্ক্রিপ্ট শুনে চলে গিয়েছি আমার ফ্ল্যাটে। ঋতু খানিক পর এল। জানতে চাইল, কীরকম লেগেছে। আমি বললাম, ‘ভালোই। কিছু কিছু সংলাপ ভীষণ ভালো লেগেছে আমার।’ ঋতু বলল, ‘বসন্ত চৌধুরী যখন আসছেন, তোর জন্যও একটা ব্যবস্থা করছি। তুইও শুটিং দেখতে আয়।’ আমি গিয়েওছিলাম। শুরু হল সঞ্জীত চৌধুরীর নতুন কলাম ‘ফ্রেমকাহিনি’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
আটের দশক। আমি তখনও বিজ্ঞাপনের ছবি বানানো শুরু করিনি। কিন্তু বিজ্ঞাপনে আগ্রহ ষোলোআনা! নিজের মতো করে বিজ্ঞাপন দেখি, বোঝা-টোঝার চেষ্টা করি। বয়সে বড় এক বন্ধু, রুদ্র সেন, ‘ওয়াল্টার টমসন’ নামের বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করত। তার বাড়িতে দিব্যি যাতায়াত ছিল আমার। ওই বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত আলোচনাই হত। কোনও বিজ্ঞাপন দেখে ভালো লাগলে, ওকে বলতাম: ‘কী ভালো বিজ্ঞাপন!’ সেরকমই এক উচ্ছ্বাসের মুখে, আমার ওই বন্ধুর মুখে একটা নাম শুনি। পরবর্তীকালে যার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। ছবিও তুলব তার। সে– ঋতুপর্ণ ঘোষ।
ঋতু, তখন কাজ করত ‘রেসপন্স’ নামের এক বিজ্ঞাপন সংস্থায়। রুদ্র সেনের বাড়িতেই একদিন ঘটনাচক্রে আমি গিয়ে হাজির হয়েছি। সেসময় ঋতুও উপস্থিত ছিল। সেই প্রথম ওর সঙ্গে আলাপ।
টালিগঞ্জের বাড়িতে, এক সকালবেলা, আমার বাবা বসন্ত চৌধুরী বলল, ‘তুমি ঋতুপর্ণ বলে কাউকে চেনো?’ আমি স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, চিনি।’ বলল, ‘ঋতু আসবে আজকে, সকাল ১০টায়, একটা স্ক্রিপ্ট শোনাতে।’ ঋতু এল। আমার সেদিন কাজ নেই কোনও। বিজ্ঞাপনের গুহায় তদ্দিনে মাথা গুঁজে দিয়েছি। কখনও টানা ২২ দিন কাজ থাকত, আবার কখনও এক হপ্তা কোনও কাজ নেই। তখন ওই ফাঁকা সময়টাই চলছে। ঋতু বাবাকে জিজ্ঞেস করল, স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় আমি থাকতে পারি কি না। বাবা আপত্তি করলেন না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজ আর মনে পড়ে না, ঋতুর যে ছবি তুলেছিলাম, সেটা কোন উপলক্ষে? বোধহয় এমনিই। কোনও কারণ ছাড়াই। তখন মাঝে মাঝেই ক্যামেরা থাকত আমার সঙ্গে। একদিন ওর বাড়ি গিয়ে দেখি, সেজেগুজে সুন্দর হয়ে বসে আছে ঋতু। হয়তো কোনও মিটিং বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি বললাম, ‘আমার তো ফিল্ম লোড করা আছে ক্যামেরায়, তোর কিছু ছবি তুলি?’ বলল, ‘তোল, তুই তো ছবিটা ভালো তুলিস।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শুনলাম সেই স্ক্রিপ্ট। ঋতুর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’র স্ক্রিপ্ট। বাবা সেখানে পরিবারের মুখ্য– এরকম একটা চরিত্র করেছিল। আমি স্ক্রিপ্ট শুনে চলে গিয়েছি আমার ফ্ল্যাটে। ঋতু খানিক পর এল। জানতে চাইল, কীরকম লেগেছে। আমি বললাম, ‘ভালোই। কিছু কিছু সংলাপ ভীষণ ভালো লেগেছে আমার।’ ঋতু বলল, ‘বসন্ত চৌধুরী যখন আসছেন, তোর জন্যও একটা ব্যবস্থা করছি। তুইও শুটিং দেখতে আয়।’ আমি গিয়েওছিলাম। পরে এ ছবির স্ক্রিনিংয়েও। ১০-১২ জন এসেছিল নিউ থিয়েটার্স-এর সেই স্ক্রিনিংয়ে। সেখানে দেখলাম, ‘রেসপন্স’-এর হেড– রাম রে-কে।
ঋতু রামের কথা খুবই শুনত, মানত। ছবিটা নিয়ে আমি যে কিছু বলতে যাব, তার আগেই ঋতু বলে বসল, ‘রাম বলেছে, ছবিটা ভালো হয়েছে।’ রামের কাছ থেকে এ কথাটা শোনা ওর কাছে বড় পাওয়া। রাম অবশ্য সে মাপেরই মানুষ। ভালো না হলে সোজাসুজি বলে দিত রাম। ফলে ঋতু খুব খুশি।
এ ঘটনার পরে, ঋতুর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডাও বাড়ে। ভারতের স্বাধীনতার যখন ৫০ বছর, সুবর্ণজয়ন্তী, তখন আমি বিজ্ঞাপনের কাজে একেবারে ডুবে। আমাকে এক প্রোডিউসার বলল, স্বাধীনতা নিয়ে দূরদর্শন একটা ডকু-ফিকশনের প্রপোজাল চাইছে। আমার মনে পড়ল, আগে, পুরনো বাড়ি নিয়ে নিজের মতো করে খানিকটা কাজ আমি করেছিলাম। সেসময় আমাকে খুবই সাহায্য করেছিল রাধাপ্রসাদ গুপ্ত– আর.পি.। ওকে আমি ‘কাকু’ বলতাম। আর.পি.-কে বলেছিলাম, ‘তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে?’ তারপর কিছু বইপত্র দিল পড়তে। এ কাজটায় সেই পুরনো বাড়িগুলোর মধ্যে থেকে যেগুলো স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত– সেগুলো নিয়েই তৈরি করছিলাম। যেমন ধরা যাক– বসুবাড়ি, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। সেই পুরনো প্রোজেক্টটাই রিওয়ার্ক করে জমা দিয়ে দিয়েছিলাম। যে করে হোক, এই কম্মখানা ঘাড় থেকে নামলে মনে হচ্ছিল বেঁচে যাই! কারণ এমনই ব্যস্ততা তখন, দু’দিনে একবার ঘুমোই বলা চলে!
আশা করেছিলাম, কিছুই হবে না। কিন্তু কী করে যেন কাজটা স্যাংশন হয়ে গেল। পড়লাম বেজায় বিপাকে! এবার?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঋতুর কাছে পৌঁছনো ছাড়া দ্বিতীয় কোনও উপায় খুঁজে পেলাম না। কাজটা দেখালাম। বললাম, ‘‘এটার একটা স্ক্রিপ্ট লিখে স্ট্রাকচার করে দিবি? রিসোর্সের জন্য দু’জন রয়েছে।’’ ঋতু বলল, ‘নিশ্চয়ই করে দেব।’ ‘তুই আয়। ঘণ্টাখানেক কথা বলে নেব।’ বললাম, ‘আমার যাওয়া মানে কিন্তু সাত সকালে, ৬টা-সাড়ে ৬টা!’ কারণ এর পরই আমার কাজ শুরু হয়ে যাবে। ঋতু বলল, ‘তা-ই আয়।’ আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ওই সময়ই হয়েছে দিনের পর দিন। সেই কাজটার স্ট্রাকচার করে দিয়েছিল ঋতু। মোটের ওপর উতরে গিয়েছিল কাজটা। ডকু-ফিকশনটায় অভিনয় করেছিল বাবা। রাজি করিয়েছিল ঋতু নিজেই।
আজ আর মনে পড়ে না, ঋতুর যে ছবি তুলেছিলাম, সেটা কোন উপলক্ষে? বোধহয় এমনিই। কোনও কারণ ছাড়াই। তখন মাঝে মাঝেই ক্যামেরা থাকত আমার সঙ্গে। একদিন ওর বাড়ি গিয়ে দেখি, সেজেগুজে সুন্দর হয়ে বসে আছে ঋতু। হয়তো কোনও মিটিং বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি বললাম, ‘আমার তো ফিল্ম লোড করা আছে ক্যামেরায়, তোর কিছু ছবি তুলি?’ বলল, ‘তোল, তুই তো ছবিটা ভালো তুলিস।’ কোনও একটা কারণে আমার ছবি পছন্দ করত ও, বলতও সেকথা।
ছবি তুলতে গিয়ে ও বারবার বলল, ‘এই বইগুলো দেখা যাচ্ছে?’ কিংবা ‘ছবিটা দেখা যাচ্ছে তো?’ ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল। সব ব্যাপার নিয়েই ও সচেতন ছিল। একেবারে ঠিকঠাকভাবে সচেতন। জানতে চাইত বারবার করে। ক্যামেরার ব্যাপারেও। কী অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করেছি, তাও জেনে নিত খুঁটিয়ে।
ছবিগুলো প্রিন্ট করিয়েছিলাম। দিয়েছিলাম ঋতুকে। ছোট্ট একটা প্রিন্ট। হাতে নিয়ে হেসেছিল।
এই দৃশ্যটার কোনও ছবি অবশ্য আমার কাছে নেই।
(চলবে)