কবি যখন জীবনের প্রান্তে এসে ছবি ঠাকুররূপে দেখা দিলেন, তখনও সমালোচকের দল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখানে আবার বুঝি দাঁড়াতে হবে পরিচিত প্রশ্নের শিয়রে। রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি? কোথায়, কোন কাগজে এঁকেছিলেন কলমের সে চিত্রময় আঁচড়, কোন খাতার অন্দরে? খেয়াল করলে দেখি, ‘মালতী পুঁথি’র আনাচেকানাচে কখনো দেখা দিয়েছে পাশ ফেরা মুখের আদল, কোথাও বা ফুটেছে একটু ইশারা। পরে ছিন্নপত্রাবলীতে বরষার ঝাপসা মেঘের সঙ্গে তাঁর রাবার-পেন্সিল ঘষাঘষির উপমা ছবি আঁকার সচেতন চেষ্টার জানান দেয়। এরপরে ‘রক্তকরবী’র পাতায় জান্তব আকার দেখেছি বটে। কিন্তু গোটাগুটি ছবি কি ‘পূরবী’র পরে?
২.
প্রথম। এই ছোট্ট রোমান্টিক শব্দে কি এক মায়া-জড়ানো আছে। চকিতে মনের ভেতরে ঘা দিয়ে যায়। হঠাৎ ঝলসে ওঠা বিদ্যুৎ যেন! কিন্তু শব্দের পুরো অর্থ সে মেলে ধরতে পারে না। এ শব্দ বড় একা, অসংলগ্ন, খাপছাড়া। কলমের প্রান্তে উঠে আসা অক্ষরের অসমাপ্ত প্রতিমা। গড়তে গড়তে থেমে যাওয়া ভাস্কর্যের মতো। এর পরেই অমোঘ প্রশ্নটা উঠে আসে, কী সেই প্রথম? প্রথম প্রেম! প্রথম দেখা? কোনও গোপন অনুভবের প্রথম স্পর্শ– কী আছে এর পরের অংশে? জানার জন্য কান সজাগ হয়, মন উৎসুক হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি বলি, কোনও কবির প্রথম কবিতা। লেখকের প্রথম উপন্যাস। প্রতিদিনের রেওয়াজ ছাপিয়ে গায়কের প্রথম গান বা শিল্পীর পটে আঁকা প্রথম ছবি? তাহলে কি আমাদের শোনার আগ্রহে কিছু ভাটা পড়বে? পড়তে পারে, তবুও সেদিকে এগোতে চাই।
রবি ঠাকুরের কথাই ধরা যাক না। তাঁর জীবন ও কাজ ঘিরে আমরা শতসহস্র গবেষণা পার হয়ে এসেছি। কিন্তু তাঁর প্রথম কবিতাটির খোঁজ কি পেয়েছি? ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ তাঁর জীবনে ‘আদিকবির প্রথম কবিতা’, কিন্তু তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়া প্রথম কবিতা? সে খোঁজ আমাদের জানা নেই, জানা সহজও নয়। বাল্যের সেই বন্দিদশার স্মৃতি ‘নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট’ পেরিয়ে সময়ের আরেকটা বাঁকে এসে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘সন্ধ্যাসংগীত’। সেখানে কি আছে এর কোনও হদিশ? লুকিয়ে আছে প্রথম কবিতার ছায়া? ‘সন্ধ্যাসংগীত’-এর অধিকাংশ কবিতা ১৮৭৮-’৭৯ নাগাদ লেখা। প্রথম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে এমনটাই জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এ-ও বলা আছে, ‘‘কেবল ‘বিষ ও সুধা’ নামক দীর্ঘ কবিতাটি বাল্যকালের রচনা’’।
বাল্যকাল? সে ঠিক কোন পর্ব? তার পরিধি কতদূর পর্যন্ত? স্পষ্টই বলা চলে, ‘কোনো-একটি কর্মচারীর কৃপায় একখানি নীল কাগজের খাতা জোগাড়’ করার পরের ‘বাল্যকাল’। তারও পরে বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রে শূন্যস্থান ভরাটের অছিলায়– সাতকড়ি দত্তের দেওয়া কবিতার লাইন পূর্ণ করার ঘটনা। সে কথা ধরা আছে ‘জীবনস্মৃতি’-র পাতায়। ইশকুলের সেই কাব্যরসিক মাস্টার সাতকড়িবাবুকে সাধুবাদ জানাতে হয়, তিনি সেদিনের বালকটিকে কবিতা রচনায় পরোক্ষে বহুবার উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। তার একটি– ‘রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই/ বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই’– লিখে দিয়ে বলেছিলেন বাকিটা লিখে আনতে। মহা উৎসাহে ছাত্র লিখে এনেছিল পরবর্তী দুটি চরণ– ‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে/ এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে’। এমন আরও কিছু ছিল, কবির স্মৃতিতে রয়ে গেছে এই একটিই। তবু প্রশ্ন যে আটকে রইল সেই ‘প্রথম’ কবিতাকে ঘিরে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র ওলটাতে গিয়ে দেখি, ‘রক্তকরবী’র বেশ কিছু আগে এক বালিকার অনুরোধে চিঠির সঙ্গে তিনি ছবি এঁকে পাঠাচ্ছেন। সেই মেয়ে কবির স্নেহধন্য রাণু। রাণু লিখেছে, ‘দেখুন আমি কেমন ওড়না পরা মেয়ে করেছি এর নাম নীলা। বেশ সুন্দর হয়েছে। না? আপনাকেও আঁকতে হবে’। তবে কি রাণুর এই দাবি থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সূচনা? রাণুর আরেকটি চিঠিতে দেখি, ‘আপনি ছবিটা রেখে দেবেন। এবার আর একটা পাঠাচ্ছি। আপনিও একটা আঁকবেন। দেখব কারটা বেশী ভাল হয়’।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সাতকড়িবাবুকে সাধুবাদ দেওয়ার আগে মনে পড়বে ভাগিনেয় জ্যোতিপ্রকাশের নাম। যিনি ছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে কিছু বড়। সেদিনের সাত-আট বছরের বালক রবীন্দ্রনাথের মনে কবিসত্তার বীজ রোপণ করেছিলেন এই জ্যোতিপ্রকাশ, তিনিই কাব্যরচনার প্রথম গুরু। তাঁর হাত ধরে ১৪ মাত্রার ছন্দে স্লেট-পেনসিলে লেখা হয়েছে বালক রবির প্রথম কবিতা। কিন্তু ‘একাকী গায়কের নহে তো গান’ যেমন সত্য, তেমনি কবিতার পাঠক বা শ্রোতার অভাবে তা একপ্রকার অসম্পূর্ণ। সেদিক থেকে কবির প্রথম ইম্প্রেসারিও হলেন দাদা সোমেন্দ্রনাথ। সেই পর্বে তিনি বালককবির প্রচারক, যা কবিকে পরিচিত গণ্ডিতে মেলে ধরেছে, বিস্ময়মিশ্রিত প্রশংসাও জুটেছে অঢেল। তবে শুধুই কি প্রশংসা আর হাততালি? সোমেন্দ্রনাথের অনুরোধে পদ্ম-বিষয়ক একটি কবিতা শোনাতে গেলে ‘ন্যাশনাল পেপার’-এর এডিটর নবগোপালবাবুর দিক থেকে ভেসে এসেছিল বঙ্কিম হাসি। ইতিহাসের নিরিখে সেইটিই বুঝি রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম বিরূপ সমালোচনা। ঘটনাটা এইরকম, কবির পদ্ম-বিষয়ক সেই কবিতায় ছিল ভ্রমরের অমোঘ উপস্থিতি। কিন্তু ভ্রমরের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছিলেন কিঞ্চিৎ প্রচলিত ‘দ্বিরেফ’ শব্দটি। এই দ্বিরেফ শব্দের ওপর বালককবির সমস্ত আশা-ভরসা, অথচ শ্রোতা নবগোপাল মিত্রের প্রতিক্রিয়া হয়েছে অন্যরকম। এমন কি তিনি হেসে উঠতেও দ্বিধা করেননি। স্বভাবতই তিনি কবির কাছে সমঝদার শ্রোতা থেকে বঞ্চিত হলেন। সেই সঙ্গে শব্দটি ‘মধুপানমত্ত ভ্রমরের মতো স্বস্থানে অবিচলিত’ রয়ে গেল।
এখানে দেখি, নিত্যকৃষ্ণ বসু, ডি এল রায়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ বা সুরেশ সমাজপতির বহু পূর্বে নবগোপালবাবু মুচকি হেসে বালকরবিকে ঠাট্টা করে বসেছেন। সেই কবি যখন জীবনের প্রান্তে এসে ছবি ঠাকুররূপে দেখা দিলেন, তখনও সমালোচকের দল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখানে আবার বুঝি দাঁড়াতে হবে পরিচিত প্রশ্নের শিয়রে। রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি? কোথায়, কোন কাগজে এঁকেছিলেন কলমের সে চিত্রময় আঁচড়, কোন খাতার অন্দরে? খেয়াল করলে দেখি, ‘মালতী পুঁথি’র আনাচ-কানাচে কখনো দেখা দিয়েছে পাশ ফেরা মুখের আদল, কোথাও বা ফুটেছে একটু ইশারা। পরে ছিন্নপত্রাবলীতে বরষার ঝাপসা মেঘের সঙ্গে তাঁর রাবার-পেনসিল ঘষাঘষির উপমা ছবি আঁকার সচেতন চেষ্টার জানান দেয়। এরপরে ‘রক্তকরবী’র পাতায় জান্তব আকার দেখেছি বটে। কিন্তু গোটাগুটি ছবি কি ‘পূরবী’র পরে? কবিতার আঁকিবুকি পার হয়ে সে কবে দেখা দিল?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র ওলটাতে গিয়ে দেখি, ‘রক্তকরবী’র বেশ কিছু আগে এক বালিকার অনুরোধে চিঠির সঙ্গে তিনি ছবি এঁকে পাঠাচ্ছেন। সেই মেয়ে কবির স্নেহধন্য রাণু। রাণু লিখেছে, ‘দেখুন আমি কেমন ওড়না পরা মেয়ে করেছি, এর নাম নীলা। বেশ সুন্দর হয়েছে। না? আপনাকেও আঁকতে হবে’। তবে কি রাণুর এই দাবি থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সূচনা? রাণুর আরেকটি চিঠিতে দেখি, ‘আপনি ছবিটা রেখে দেবেন। এবার আর একটা পাঠাচ্ছি। আপনিও একটা আঁকবেন। দেখব কারটা বেশী ভাল হয়’। পরের চিঠিতে– ‘আপনি যে ছবিটা এঁকেছেন সেটা বেশ সুন্দর হয়েছে।… আপনি তো বেশ ছবি আঁকেন। শেখেন না কেন’ ইত্যাদি। বা আরেকটি চিঠিতে ছবির আঙ্গিকের ডিটেল, ‘আপনি যে ছবিটা এঁকেছেন সেটা বেশ সুন্দর হয়েছে। ছবিটা পেয়ে আমি খুসী হয়েছি।… আপনি তো ছবিটা আগে পেন্সিল দিয়ে এঁকে তারপর তাতে কালী দিয়েচেন আমি তাই করি’। চিঠিগুলির তারিখ জুলাই ১৯১৮, অর্থাৎ ‘রক্তকরবী’ বা ‘পুরবী’র পাণ্ডুলিপিতে আঁকিবুঁকির বেশ আগে।
কখনও মনে হয়, কবির স্নেহের দান হিসেবে রাণুকে লেখা চিঠির ভাঁজেই কি রয়ে গেল রবীন্দ্রচিত্রকলার প্রথম হদিশ? সে কি রয়ে গেল দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকার প্রীতিস্নিগ্ধ বৈভবের বেশে?