স্বদেশপ্রেমের কথা বারবার বলতেন আমিন সায়ানি। বলতেন পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথা। আর, এগুলো শুধু মুখের বুলি ছিল না। ভারত স্বাধীন হওয়ার দিন, ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এ, তিনি তখন স্কুলে। স্কুলের কাছাকাছি একটা পাহাড়ের মাথায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কাহিনি যখন শোনাতেন, আচমকাই ছলছল হয়ে যেত মানুষটার চোখ।
ঘুম-ঘুম মফসসল। আটের দশক। বই খুলে বসলেই ঘুম পেত আরও। লোডশেডিং-এ, হ্যারিকেনে, ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের গণসংগীতে, বাঁশপাতার মৃদু মর্মরে, হঠাৎ হাওয়ায় বাতাবি-ফুলের গন্ধে সিলেবাস বড় বাঁশ হয়ে যেত। ঢুলতাম। হ্যাঁ, যদি নাগাল পেতাম টিভির, টেপ রেকর্ডারের, রেডিওর– ইনসমনিয়া গ্যারান্টিড। দূর নিভু-নিভু চা-দোকান থেকে ভেসে আসত ‘উত্তম হাসি’। না, সে হাসি উত্তম কুমারের নয়। সে হাসি আপামর বাঙালি-জীবনে দিলদার হাসির খোরাক জোগানো এক কমেডিয়ানের। নাম– উত্তম দাস।
নানা সেলিব্রিটির মিমিক্রি করে, উত্তম দাস হাসাতেন টুকরো টুকরো গল্প বেঁধে, ক্যাসেটে। তাঁর নকল করা একটা কণ্ঠ এত ভালো লাগত– কিন্তু ধরতে পারতাম না তিনি কে! তারপর, একদিন ‘বিবিধ ভারতী’-তে শুনলাম সেই কণ্ঠ, ‘বেহনোঁ অউর ভাইয়োঁ…’। বড়রা বলল, ওঁর নাম আমিন সায়ানি। আসমুদ্রহিমাচল যিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন স্বকীয় কথন ভঙ্গিতে। অনুষ্ঠানের নাম, ‘গীতমালা’।
আটের দশকেই দেখলাম ‘মি. ইন্ডিয়া’। পর্দায় শুনতে পাচ্ছি নায়কের গলা… এমনকী, মোগাম্বোর মতো জাঁদরেল ভিলেনও ঘাবড়ে যাচ্ছে তাতে! কিন্তু আমরা বা মোগাম্বো, কেউই দেখতে পাচ্ছি না তাকে! আমাদের কাছে আমিন সায়ানি তখন অনেকটা ওরকমই। জাস্ট একটা কণ্ঠস্বর! জাস্ট একটা ম্যাজিক! সেই স্বর, যথানিয়মে, মহাকাল মেনে, চির-চুপ হয়ে গেল।
কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, বি. ভি. কেসকার, ১৯৫২ সালে, সিদ্ধান্ত নিলেন ন্যাশনাল ব্রডকাস্টারে শুধুমাত্র ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত চালানো হবে; নিষিদ্ধ করা হবে হিন্দি ফিল্মের গান-বাজনা। সরকারি নিদানে, হিন্দি সিনেমার গান খুবই চটুল, বাজারি, ছ্যাঃ ছ্যাঃ। অতএব, এ দেশে সংস্কৃতির পুলিশরা অবিলম্বে বন্ধ করল ওইসব গান চালানো।
ওদিকে, শ্রীলঙ্কার একটা নতুন রেডিও স্টেশন, ‘রেডিও সিলোন’-এ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া এক শক্তিশালী ট্রান্সমিটার– যার তরঙ্গ পৌঁছতে পারে ভারতে তো বটেই, আরও দূর দূর দেশেও। ‘রেডিও সিলোন’ দেখল, এই সুযোগ! ভারতের প্রথম ‘কাউন্টডাউন শো’ শুরু করল তারা। স্পনসরের নাম জুড়ে, প্রোগ্রামের নাম, ‘বিনাকা গীতমালা’। মূল লক্ষ, হিন্দি সিনেমার গান চালানো। সেই শো হোস্ট করার দায়িত্বে, তরুণ আমিন সায়ানি। তাঁর অনন্য বাক-ভঙ্গি আর এ দেশের লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু শ্রোতা অচিরে জনপ্রিয়তার চূড়ায় নিয়ে গেল ওই শো।
সদ্য-স্বাধীন দেশে, অধিকাংশ মানুষেরই সাধ্য ছিল না রেকর্ড কিনবে, কিংবা সিনেমা রিলিজ হলেই গিয়ে দেখবে, কিংবা পছন্দের সিনেমা বারবার দেখবে। এমনকী, সব বাড়িতে রেডিও-ও ছিল না। মানুষের পছন্দের গান তার হাতের কাছে নিয়ে এল এই প্রোগ্রাম– যার সঙ্গে সমার্থক হয়ে জুড়ে গেল আমিন সায়ানির নাম। রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে, হাটে-বাজারে, এ দেশের কোণে কোণে– প্রতি বুধবার সন্ধ্যায়, মৌচাকের মতো থিকথিক করত মানুষ, একটা রেডিও-কে ঘিরে।
যদি মনে করেন, মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর স্টার হয়েছেন সিনেমায় গান গেয়ে– তাহলে, বিনীত বলি, ও ধারণা ভুল। মানুষ তাঁদের স্টার বানিয়েছে রেডিও-তে গান শুনে শুনে। নামজাদা মিউজিক ডিরেক্টররা দম আটকে অপেক্ষা করতেন, আমিন সায়ানি আজ তাঁর গানটা বাজাবেন তো! আর হ্যাঁ, সিনেমা চলবে কি না– সে কপালও খুলতে পারত ওই প্রোগ্রাম। এই নীল গ্রহের অন্যতম দীর্ঘকালীন রেডিও শো, ‘বিনাকা গীতমালা’– ১৯৫২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত, থামেনি কখনও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শ্রীলঙ্কার একটা নতুন রেডিও স্টেশন, ‘রেডিও সিলোন’-এ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া এক শক্তিশালী ট্রান্সমিটার– যার তরঙ্গ পৌঁছতে পারে ভারতে তো বটেই, আরও দূর দূর দেশেও। ‘রেডিও সিলোন’ দেখল, এই সুযোগ! ভারতের প্রথম ‘কাউন্টডাউন শো’ শুরু করল তারা। স্পনসরের নাম জুড়ে, প্রোগ্রামের নাম, ‘বিনাকা গীতমালা’। মূল লক্ষ, হিন্দি সিনেমার গান চালানো। সেই শো হোস্ট করার দায়িত্বে, তরুণ আমিন সায়ানি। তাঁর অনন্য বাক-ভঙ্গি আর এ দেশের লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু শ্রোতা অচিরে জনপ্রিয়তার চূড়ায় নিয়ে গেল ওই শো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমিন সাবের মা, কুলসুম ছিলেন ঘোরতর গান্ধিবাদী আর ‘হিন্দুস্তানি প্রচার সভা’-র অন্যতম পুরোধা। গান্ধিজীর বিশ্বাস ছিল, ভারতের জন্য দরকার কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষা, উর্দু বা বিশুদ্ধ হিন্দি নয়। কুলসুম নিজেও ছিলেন ফেমিনিস্ট, মুসলিম মহিলাদের লেখাপড়ায় কাজ করেছেন অনেক। আর, এই দুটো গুণই মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ছেলে। তাঁর যেকোনও অনুষ্ঠানে, রেডিও বা রেডিও-র বাইরেও, কঠিন উর্দু বা সংস্কৃত-ঘেঁষা হিন্দি এড়িয়ে, বলতেন যথাসাধ্য কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষা। আর, ওই আজীবন ‘বেহনোঁ অউর ভাইয়োঁ…’ সম্বোধন। কখনও বলতেন না, ‘ভাইয়োঁ অউর বেহনোঁ…’। মহিলাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের উদাহরণ দিতে, বোধহয় এটুকু যথেষ্ট।
‘বিনাকা গীতমালা’ ছাড়াও আমিন সাবের আরও কাজকর্ম নিয়ে লিখতে বসলে, একটা গোটা বই কম পড়ে যাবে। রেডিও জকিদের নতুন প্রজন্মই গড়ে তুলেছেন তিনি। শ্রোতাকে বন্ধু বানাতে বিশ্বাস করতেন তিনি। শ্রোতাকে বিশ্বাস করাতেন, আশপাশে আর কেউ নেই, তিনি শুধু তাঁর সঙ্গেই কথা বলছেন। ওই মাইলস্টোন শো ছাড়াও হোস্ট করেছেন আরও অনেক জনপ্রিয় শো, রেডিওতে– ‘এস. কুমারস কা ফিল্মি মুকাদ্দমা’, ‘সংগীত কে সিতারোঁ কি মেহফিল’; সিডি কালেকশন– ‘গীতমালা কি ছাওঁ মেঁ’…। ক্যামিও করেছেন বেশ কিছু সিনেমায়। নিয়েছেন প্রায় সমস্ত স্টারের ইন্টারভিউ। ছিলেন ভীষণ সফল লাইভ শো হোস্ট। ছিলেন ক্রাউড কন্ট্রোলে পারদর্শী। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে, এক দল রাগী দর্শক স্টেজে ঘিরে ফেলেছিল তাঁকে। হাসি-ঠাট্টায়, উপস্থিত বুদ্ধির জাদু দিয়ে তাঁদের শান্ত করেছিলেন তিনি।
ওই একই জাদু দেখিয়েছেন র্যাম্প শো আর বিউটি কনটেস্টেও। সাতের দশকে হোস্ট করেছেন ‘মিস. ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতা’-ও। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় ছিলেন এক স্তম্ভ। কমার্শিয়াল রেডিও, মানে যেখানে প্রোগ্রামের স্পনসর থাকে নামিদামি ব্র্যান্ড– সেইসব শো জনপ্রিয় করার পাশাপাশি জনপ্রিয় করেছেন ব্র্যান্ডকেও। আর, ছিলেন ‘অ্যাডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ডস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; যে কাউন্সিল লক্ষ রাখত, মানুষকে ভুলভাল না বুঝিয়ে বিজ্ঞাপনের নির্দিষ্ট নৈতিক মান বজায় রাখা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সাবিত্রী বাঙালির নিত্যদিনের পাশের বাড়ির চেনা মেয়ে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শেষ বয়সে একটু একটু করে স্মৃতি চলে যাচ্ছিল তাঁর। ছোটবেলার গল্প শোনাতেন, কিন্তু গুলিয়ে ফেলতেন ঘটনার পরম্পরা। কিশোর, রফি, লতার নাম হঠাৎ ঘাই মেরে উঠত কথায় কথায়। অথচ, তাঁর হাতে একটা স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিন! ব্যস! যেন কোনও দৈবশক্তি ভর করেছে। টানটান শিরদাঁড়ায়, নিখুঁত কণ্ঠে, ৯০ বছর বয়সের মানুষটা আপনাকে এমনভাবে পড়ে শোনাবেন, আপনি ঘাবড়ে যাবেন। টানা চার ঘণ্টায় তিনি ব্রেক নেবেন না, ক্লান্ত হবেন না, চোখ রগড়াবেন না। আপনার পিঠ টনটন করবে, তিনি ঠায় পড়ে শোনাবেন। আর, আতিথেয়তা? একসঙ্গে খেতে বসলে, প্রতিটা, হ্যাঁ, প্র-তি-টা পদ আপনি চেখেছেন কি না, জিজ্ঞেস করবেন বারবার। ‘আজ দারুণ পরোটা বানিয়েছে, খেয়ে দ্যাখো।’ ‘দই নিয়েছ? আরেকটু নাও।’ ‘আরে, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো! চা-টা শেষ করো আগে।’
কিছু কিছু বিষয়ে তিনি বারবার বলতেন, শেষ বয়সেও। মনে হত, সেগুলো তাঁর ভেতরে গেঁথে গেছে এত দৃঢ়, যেন গতায়ু স্মৃতিতেও তারা চলে যেতে নারাজ। বারবার বলতেন স্বদেশপ্রেমের কথা। বলতেন পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথা। আর, এগুলো শুধু মুখের বুলি ছিল না। ভারত স্বাধীন হওয়ার দিন, ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এ, তিনি তখন স্কুলে। স্কুলের কাছাকাছি একটা পাহাড়ের মাথায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কাহিনি যখন শোনাতেন, আচমকাই ছলছল হয়ে যেত মানুষটার চোখ।
বলতেন আমাদের জাতীয় সংগীতের একটা সহজতর ভার্সন হওয়া দরকার; যে গানের প্রতিটা শব্দ বুঝতে পারবে, গাইতে পারবে যেকোনও মানুষ। আর, এমন একটা গান তিনি লিখেওছিলেন। বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের পণ্ডিত বাড়ির রমা মাট্টুকে। কোনও দিন, একবারের জন্যও, ধর্মান্তরিত হতে দেননি তাঁকে। তাঁর ছেলে, রাজিলও মুসলিম, কিন্তু বিয়ে করেছেন এক হিন্দুকেই। কোরানের পাশাপাশি, আমিন সাব পড়েছেন গীতা আর বাইবেলও। শুধু পড়েননি, রীতিমতো ঠোঁটস্থ করেছেন। তিন ধর্মের মিল খুঁজে খুঁজে, শ্লোকের পর শ্লোক লিখে রেখেছেন পাতার পর পাতায়।
শেষ করি বি. ভি. কেসকারের কাহিনিতে। কেসকারের ওই সিদ্ধান্তে এমন কেস খেল ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’, কয়েক বছরেই বুঝতে পারল মানুষ তাদের শুনছে না আর। তাই, হারাচ্ছে রেভিনিউও। শেষমেশ, তারা আনতে বাধ্য হল ‘কমার্শিয়াল ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’, যেখানে চালানো হল মূলত হিন্দি সিনেমার গান, বলিউড-কেন্দ্রিক প্রোগ্রাম। হ্যাঁ, নাম– ‘বিবিধ ভারতী’।
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।