১৯০২-এ টটেনহ্যাম-শেফিল্ডের ম্যাচ দেখতে ক্রিস্টাল প্যালেস গ্রাউন্ডে ভিড় জমিয়েছিল ১,১০,০০০-এর বেশি ফুটবল অনুরাগী। কিন্তু রিল্পে-তে সেই ভিড় কমে দাঁড়ায় ২০,০০০-এ। তারপর থেকে ক্রমাগত সেটাই ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়ায়। আসলে ফুটবলারদের গা-জোয়ারি ফুটবল, প্রথম লেগে ঘর বাঁচিয়ে খেলার প্রবণতা দেখে ফুটবল নিয়ে আগ্রহ কমছিল সমর্থকদের। শেষমেশ নড়েচড়ে বসেন এফএ কর্তারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯২০-তে এফএ কাপে ঠিক হয় প্রথম ম্যাচ থেকে থাকবে ‘এক্সট্রা টাইম’।
আপনাদের কি মনে পড়ে, আমাদের ছেলেবেলায় খেলার মাঠের একপাশে রূপকথার রাক্ষসের মতো একটা পানাডোবা সর্বদা ওত পেতে থাকত?
কচুবন, আগাছা, সাপখোপ আর জমা ময়লার দুর্গন্ধে মোড়া সেই ডোবায় পড়ন্ত বিকেলে কত যে ম্যাচের অসমাপ্ত কাহিনি জমে, তার ইয়াত্তা নেই। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে যাওয়া বল নিরুদ্দেশ যাত্রা করত ওই কালো ঝোঁপের আড়ালে, তারপর নিভে আসা আলোয় তন্নতন্ন করে খোঁজখোঁজ। তবু রাক্ষসের গ্রাস থেকে উদ্ধার করা যেত না হারিয়ে যাওয়া বলটাকে। যেমন উদ্ধার করা যেত না সে বিকেলের জয়ের আনন্দটুকু। বিফলমনোরথ হয়ে, একবুক হতাশায় আমরা বাড়ি ফিরে আসতাম।
পরের দিন আবার চাঁদা তুলে নতুন ক্যাম্বিস, কিংবা সস্তার স্ট্যাম্পার কেনা। আবার সেই ডোবা-রাক্ষসের ওত পেতে বসে থাকা। এভাবেই চলত দিনের পর দিন।
হারানো নিধি পাওয়াও যেত একসময়। অনেকদিন পর হয়তো ‘অন্তর্ধান’ করা আবার কোনও একটা বল খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করা যেত পূর্বতনকে, সম্পূর্ণ কর্দমাক্ত অবস্থায়। তখন সে আমাদের কাছে ‘এক্সট্রা’। সেই প্রাপ্তিযোগে মিশে থাকত অনাবিল একটা বাড়তি আনন্দ।
এই বাড়তির যেমন আনন্দ আছে, তেমনই দুঃখজ্বালাও কম নেই। সেটাও ক্রিকেটকে ঘিরেই। পাড়ায় এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় ইট পেতে চলত দেদার ক্রিকেট। সে খেলায় মাঝেমধ্যে ভূঁইফোঁড়ের মতো উদয় হত পাড়াতুতো বড় দাদারা। ‘এই একটু ব্যাট করতে দে’ কিংবা ‘জাস্ট একটা বল খেলব’ এসবের উটকো অছিলায় দাঁড়িয়ে পড়ত ব্যাট হাতে। তারপর আমাদের কচি হাতের লোপ্পায় অক্লেশে হাঁকাত। অসহায়ের মতো আমরা তাকিয়ে দেখতাম, ‘এক্সট্রা’ ডেলিভারি আকাশে মিলিয়ে গিয়ে হারিয়ে যেত বেপাড়ার কোনও ছাদে। আর আমাদের ছলছল চোখের সামনে দিয়েই হাতা গুটিয়ে সটকে পড়ত সেই দাদারা।
দাদা বলাতেই মনে পড়ল আসল দাদাগিরির কথা। মানে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ’৯৬-এর লর্ডসে সেই মহারাজকীয় টেস্ট অভিষেক। অথচ বিলেত সফরে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারতীয় দলে যখন তাঁর ঠাঁই হল, সকলেই মনে করেছিল, এ স্রেফ ‘এক্সস্ট্রা’। খেলার সুযোগ-টুযোগ বিশেষ মিলবে না। দলের সঙ্গে যাবে, আর ফিরে আসবে। আজহার? কানাঘুঁষো শোনা যায়, বেহালার বাঁ-হাতির সঙ্গে তৎকালীন ভারত অধিনায়কের সম্পর্কটাও ছিল ‘সুমধুর’। ভারতীয় ড্রেসিংরুমের অনেক কান। সেখানে আড়ি পাতলে জানা যায়, বিলেতে শপিং কমপ্লিট কি না, তা নিয়েও মহারাজকে তির্যক কথায় বিঁধতে ছাড়েননি আজহারউদ্দিন। ওই সফরেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। কেন্দ্রস্থল ঐতিহ্যের লর্ডস। সঞ্জয় মঞ্জরেকরের পরিবর্তে দলে ঢুকে পড়লেন সৌরভ। বাকিটা ইতিহাস। সেই ‘হোম অফ ক্রিকেটে’ই টেস্ট শতরান। পরের টেস্টে আরও একটা। মুখে নয়, ব্যাটে ‘প্রিন্স অফ ক্যালকাটা’ বুঝিয়ে দিলেন তিনি বিলেতে শপিংয়ের জন্য নয়, ভারতীয় ক্রিকেটে রাজত্ব করতে এসেছেন।
অতীত সাক্ষী, ‘টিম ইন্ডিয়া’র উদ্গাথা, এই সৌরভের হাত ধরেই একঝাঁক নতুন মুখ পেয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। বীরেন্দ্র শেহবাগ থেকে যুবরাজ সিং, হরভজন থেকে জাহির খান– তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। ও হ্যাঁ, শেহবাগ বলাতেই মনে পড়ল আরও এক ‘এক্সট্রা’র কথা। ২০১০-এ শ্রীলঙ্কার মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় বীরেন্দ্র শেহবাগ। দরকার স্রেফ ১ রান। ভারতের জয়ের জন্য তাই। লঙ্কান স্পিনার সূরজ রণদীপ জেনে বুঝে নো-বল করলেন। অর্থাৎ এক্সট্রা রান যোগ হল ভারতের খাতায়। ম্যাচও জিতল টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু রণদীপের কূট-চালে মাঠে মারা গেল বীরুর শতরান। পার পাননি অবশ্য সূরজ। ইচ্ছাকৃত নো-বল করার অপরাধে নির্বাসনের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে ‘এক্সস্ট্রা’ অর্থাৎ অতিরিক্ত রান খরচে কম যায় না ভারতীয় দল। রেকর্ড বলছে, একটি টেস্টে সবচেয়ে বেশি বাড়তি রান দেওয়ার নজির রয়েছে ভারতের। ২০০৭-এ বেঙ্গালুরু টেস্টের প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৭৬ রান অতিরিক্ত দিয়েছিলেন ইশান্ত শর্মারা। সেই নজির আজও অটুট। তবে সেই রেকর্ডের থেকেও বাঙালির কাছে ওই বেঙ্গালুরুর টেস্টের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। সেটাই ছিল বাঙালির ‘ক্রিকেট আইকন’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম ও একমাত্র দ্বিশতরানের মঞ্চ।
সে ‘দাদাগিরি’র কথা আপাতত থাক। এক্সস্ট্রায় ফিরি। টেস্টে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত রান খরচে ভারতের নাম আগে থাকলেও ওয়ান ডে’তে সেই কৃতিত্বের অধিকারী চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। ’৮৯-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ’৯৯-এ স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়াসিম আক্রামরা খরচ করেন অতিরিক্ত ৫৯ রান। সেটাই এখনও পর্যন্ত রেকর্ডবুকে সবার ওপরে। এ তো গেল শুকনো পরিসংখ্যানের কচকচানি। নো কিংবা ওয়াইড, বাই কিংবা লেগ-বাই– ‘এক্সট্রা’ রান অনেক সময়েই ভাগ্য নির্ধারণ করেছে টানটান উত্তেজক ম্যাচে। ‘কী হয়… কী হয়’ আশা-আশঙ্কায় পেণ্ডুলাম হয়ে হাত কামড়ে বসে থাকা ক্রিকেট অনুরাগী সেই এক্সস্ট্রা-রোমান্সের সুখটান নিয়েছে গ্যালারিতে বসে। তবে ক্রিকেট মাঠে ‘এক্সট্রা’ চরিত্র কম নেই, তারা হিসেবের বাইরে থেকে উঠে এসে বদলে দিয়েছেন ম্যাচের রং। এই টি. নটরাজনের কথাই ধরা যাক। ২০২০-’২১-এ ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর। টেস্ট সিরিজে চোট-আঘাতে মিনি হাসপাতাল ভারতীয় দল। পারিবারিক কারণে প্রথম টেস্টের পর দেশে ফিরে এসেছিলেন বিরাট কোহলিও। ব্রিসবেনে প্রথম এগারো তৈরি করাই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানের। সেই সফরে ভারতীয় দলে ‘নেট বোলার’ হিসেবে গিয়েছিলেন থাঙ্গারাসু নটরাজন। নেট-বোলার। অর্থাৎ, নেট-সেশনে মিচেল স্টার্কদের মহড়ার জন্য মূলত তাঁকে দলের সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসা। এককথায় ‘এক্সস্ট্রা’। কিন্তু ব্রিসবেনে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, বাধ্য হয়েই সেই নেট-বোলার নটরাজনকে প্রথম দলে নিতে বাধ্য হলেন অধিনায়ক রাহানে। আর তারপর এক মিরাকলের সাক্ষী ছিল ক্রিকেটবিশ্ব। সেই ব্রিসবেনে অজি-বধ করেই সিরিজ ২-১-এ পকেটস্থ করেছিল রাহানের ভারত। তৈরি হয়েছিল নতুন ইতিহাস।
আসলে এক্সস্ট্রা মানেই বাড়তি কিছু। কবি তো কোনকালেই বলে গিয়েছেন, ‘অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি’। দামোদরের মতোই আমাদের বাড়তির দিকে ঝোঁক। ক্রিকেট হোক কিংবা ফুটবল, ঠান্ডা পানীয় হাতে শচীনের মতো আমরাও বলি– ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’। যদিও ‘এক্সট্রা টাইম’ কথাটা ফুটবলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা সত্ত্বেও সেই একচ্ছত্র ‘এক্সট্রা’ অধিকারে ভাগ বসিয়েছে ক্রিকেটও। কীভাবে? কেন, ‘সুপার ওভার’-এর হাত ধরে। টানটান উত্তেজনার নিরিখে ক্রিকেটে সুপার ওভার অনেকটাই ফুটবলের এক্সট্রা টাইমের সমতুল্য। ২০০৭-এ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-পাক ম্যাচে বোল-আউটের মধ্যে একটা টাইব্রেকারে প্রচ্ছন্ন ছায়া ছিল। পরবর্তীতে সুপার ওভার এনে দিয়েছে পুরোদস্তুর অতিরিক্ত সময়ের আমেজ। সেই উত্তেজনার পারদ সপ্তমে চড়েছিল চলতি বছরের জানুয়ারিতে, ভারত-আফগানিস্তান টি-টোয়েন্টি ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ‘ডবল’ সুপার ওভারের সাক্ষী ছিল ক্রিকেট বিশ্ব। অতীতে যদিও সেই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে আইপিএলের দর্শক, ২০২০-তে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বনাম পাঞ্জাব কিংস ম্যাচে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
টেস্টে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত রান খরচে ভারতের নাম আগে থাকলেও ওয়ান ডে’তে সেই কৃতিত্বের অধিকারী চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। ’৮৯-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ’৯৯-এ স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়াসিম আক্রামরা খরচ করেন অতিরিক্ত ৫৯ রান। সেটাই এখনও পর্যন্ত রেকর্ডবুকে সবার ওপরে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে অতিরিক্ত সময়ে ঘনীভূত উত্তেজনা, তার অনুভবে জুড়ি নেই ফুটবলের। তবে মজার বিষয়, ফুটবল খেলাটির জন্মের আতুঁরঘরে অবশ্য ‘এক্সট্রা টাইম’ ছিল না। তা এসেছে আরও পরে। আগে ম্যাচ ড্র হলে ‘রিপ্লে’ খেলাই ছিল দস্তুর। কিন্তু ১৮৭২-এ এফএ কাপের সেমিফাইনালের একটা ঘটনা আয়োজকদের ম্যাচের অতিরিক্ত সময় সংযোজন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। কী হয়েছিল? স্কটল্যান্ড থেকে নামমাত্র পুঁজি নিয়ে এফএ কাপে অংশ নিতে এসেছিল কুইন্স পার্ক। সেমিফাইনালে ওয়ান্ডারার্সের সঙ্গে ম্যাচ ড্রয়ের পর তাদের রিল্পে খেলার কথা ছিল লন্ডনের কেনিংটন ওভালে। কিন্তু অর্থাভাবে কুইন্স পার্কের আর দল নিয়ে যাওয়া হয়নি। ফলে ওয়াকওভার পায় ওয়ান্ডারার্স। তার ঠিক তিন বছর পর ১৮৭৫-এ এফএ কাপের আসরে প্রথম সংযোজিত হয় ‘এক্সট্রা টাইম’। ম্যাচটা ছিল রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স বনাম ওল্ড ইটোনিয়ান্সদের মধ্যে। তবে বাধ্যতামূলকভাবে ইউরোপে, বিশেষত ব্রিটিশ-ফুটবলে ম্যাচে এক্সট্রা টাইম-যোগ ঘটে আরও অনেক পরে। ১৯০২-এ টটেনহ্যাম-শেফিল্ডের ম্যাচ দেখতে ক্রিস্টাল প্যালেস গ্রাউন্ডে ভিড় জমিয়েছিল ১,১০,০০০-এর বেশি ফুটবল অনুরাগী। কিন্তু রিল্পে-তে সেই ভিড় কমে দাঁড়ায় ২০,০০০-এ। তারপর থেকে ক্রমাগত সেটাই ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়ায়। আসলে ফুটবলারদের গা-জোয়ারি ফুটবল, প্রথম লেগে ঘর বাঁচিয়ে খেলার প্রবণতা দেখে ফুটবল নিয়ে আগ্রহ কমছিল সমর্থকদের। শেষমেশ নড়েচড়ে বসেন এফএ কর্তারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯২০-তে এফএ কাপে ঠিক হয় প্রথম ম্যাচ থেকে থাকবে ‘এক্সট্রা টাইম’। দেখাদেখি, সেই নিয়ম চালু হয় সে-বছর অলিম্পিকের আসরেও।
বিশ্বকাপে অবশ্য অতিরিক্ত সময়ের অন্তর্ভুক্তি আরও একটু পরে, ১৯৩৪-এ। সেবারই ম্যাচের অতিরিক্ত সময় ৯৫ মিনিটে অ্যাঞ্জেলো স্কিয়াভিয়োর গোলে চেকোস্লোভাকিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতে ইতালি। এবার ‘বিশ সাল বাদ’-এর গল্প। সময়টা ১৯৫৪। বিশ্বকাপ। ‘মিরাকল অফ বার্ন’-এর ঠিক আগে সেমিফাইনালে ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা নিয়েছিল ‘এক্সট্রা টাইম’। সেমিফাইনালে দুর্ধর্ষ ফেরেঙ্ক পুসকাসের হাঙ্গেরির কাছে ২-৪ গোলে পরাস্ত হয় ‘ডিফেন্ডিং’ চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। প্রসঙ্গত, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেটাই দু’বারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের প্রথম হার। নির্ধারিত সময়ে খেলার ফল ২-২ থাকলেও ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে রং বদলে দেন হাঙ্গেরির ককসিস। তাঁর জোড়া গোলেই ফাইনালে ওঠে হাঙ্গেরি। যদিও ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে বিশ্বজয়ের স্বপ্নভঙ্গ ঘটে পুসকাস-হিদেকুটিদের। এক যুগ পর সেই ‘এক্সট্রা টাইম’-ই ঘাতক হয়ে দেখা দেয় পশ্চিম জার্মানির কাছে। ফাইনালে তাদের হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে ইংল্যান্ড, ‘এক্সট্রা টাইম মিরাকল’-এ। ‘৬৬-র ফাইনালে নির্ধারিত সময়ে খেলার ফলাফল ছিল ২-২। অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ গড়াতেই জ্বলে ওঠেন জিওফ্রে হার্স্ট। তার জোড়া গোলে বিশ্বজয়ের স্বপ্নপূরণ ঘটে ববি চার্লটনদের।
ক্রিকেটে টি. নটরাজনের কথা বলেছিলাম। এবার বলি আমারিল্ডোর কথা। যে দলের আপফ্রন্টে পেলে, গ্যারিঞ্চা, ভাভা, কুটিনহো, মারিও জাগালোদের অবস্থান, সে টিমের প্রথম এগারোয় যে স্থান পাওয়া দুষ্কর, তা ভালোই জানতেন বছর ২২-এর আমারিল্ডো। এককথায় তিনি দলের বাড়তি-বোঝা। টিমের সঙ্গে আছেন, সিনিয়রদের কাছ থেকে শিখছেন, প্রাপ্তি বলতে এইটুকু। কিন্তু ফুটবলদেবতা যে এভাবে মুখ তুলে চাইবেন, তা কে জানত! পেলের চোট, ফাইনালে সেই সুযোগটাকে দারুণ কাজে লাগালেন ওই ‘এক্সট্রা’ হয়ে যাওয়া আমারিল্ডো। সাম্বা শিবিরের হয়ে টানা দ্বিতীয় জুলে রিলে কাপ জয়ের প্রথম গোলটাই এল তাঁর পা থেকে। তারপর অবশ্য আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ব্রাজিলকে। আমারিল্ডোকেও।
ফুটবলের প্রাগতৈহাসিক যুগ নিয়ে তো অনেক কথাই হল। একটু হাল আমলে ফেরা যাক। সেখানেও এক্সট্রা-রোমান্সের ছড়াছড়ি। ২০১০-এর বিশ্বকাপ হাতেই উঠত না স্প্যানিশ আর্মাডার, যদি না অতিরিক্ত সময়ের ৪ মিনিট বাকি থাকার আগে তেকাঠির মধ্যে বলটা রাখতেন ইনিয়েস্তা। আবার ওই অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোৎজের গোলটাই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছিল লিওনেল মেসি নামক এই গ্রহের এক ফুটবল-সাধকের। সেই স্বপ্ন অবশ্য দু’বছর হল পূরণ করেছেন এলএম টেন। আর্জেন্টাইন তারকার স্বপ্নপূরণেও লেগে রয়েছে এক্সট্রা টাইমের সুবাস। ফাইনালে ১০৮ মিনিটে মহার্ঘ গোল এসেছিল তাঁর পা থেকে। বাকিটা এমিলিয়ানো মার্টিনেজ নামক এক দস্যি-আর্জেন্টাইনের হাতের জাদু। শুধু আর্জেন্টিনার জার্সিতে কেন, বার্সেলোনার হয়েও এক্সট্রা টাইমে ফুল ফুটিয়েছেন লিও। ২০১৭-তে ম্যাচের সংযুক্তি সময়ে রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে অনবদ্য গোলে এল ক্লাসিকো জয়, তারপর গ্যালারি অভিমুখে জার্সি মেলে মেসির গোল-সেলিব্রেশন, অমর-অক্ষয় হয়ে আছে ফুটবল ইতিহাসে।
মেসির কথাই যখন উঠল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কথাই বা বাদ যায় কেন। এক্সট্রা টাইম যে তাঁকেও দিয়েছে সাফল্যের সপ্তম স্বর্গ। অতিরিক্ত সময় ক্রমশ গড়িয়ে যাচ্ছে শেষের দিকে। ডাগআউটে কোচ ফের্নান্দো স্যান্টোসের পাশে দাঁড়িয়ে ছটফট করছেন সিআর সেভেন। পায়ে স্ট্যাপ বাঁধা। খোঁড়াচ্ছেন। ওই যন্ত্রণা নিয়েই মাঠ ছেড়েছেন, চোখের জলে। ম্যাচের বয়স তখন ১০৯ মিনিট। জ্বলে উঠল সতীর্থ এডারে পা। চকিতে হুগো লরিসকে পরাস্ত করে বল জালে। শিশুর উল্লাসে লাফিয়ে উঠলেন রোনাল্ডো। ২০১৬-র ইউরো কাপের ফাইনাল যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই দৃশ্যের সাক্ষী। কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের ‘লা ডেসিমা’ অর্জন। ২০১৪-র চ্যাম্পিন্স লিগ ফাইনাল। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ জয়ের দোরগোড়ায়। ইনজুরি টাইমে সার্জিও রামোসের গোলে ম্যাচে সমতা ফেরায় রিয়াল। তারপর অতিরিক্ত সময়ে বেল আর মার্সেলোর অনবদ্য গোল। আর অ্যাটলেটিকো কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়ে রোনাল্ডোর সেই চিরস্মরণীয় উল্লাস, তা তো ভোলার নয়। তবে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব চুকিয়ে রোনাল্ডো-মেসি আজও খেলছেন, মন্ত্রমুগ্ধ করছেন আপন ফুটবল-জাদুতে। ফুটবল-জনতার কাছে এরচেয়ে আর এক্সট্রা পাওনা কী হতে পারে!
প্রিয় ‘রনে’র কথাতেই মনে পড়ে গেল এক ভদ্রলোকের কথা। এককালের কোচিং করাতেন। নাম, স্যর আলেক্স ফার্গুসন। এক্সট্রা টাইমকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্রেফ মগজাস্ত্রের জোরে। আর সেটাই জগৎপ্রসিদ্ধ ‘ফার্গি টাইম’ নামে। নিস্তেলরুই থেকে ওয়েলবেক, সোলসায়ার থেকে রায়ান গিগস, কত তারকার উত্থানের সোপান গড়েছে ‘ফার্গি টাইম’, তার ইয়াত্তা নেই। ভুলে গেলে চলবে না ২০১২-র চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মিরাকল ঘটানো চেলসিকেও। সেমিফাইনালের ফিরতি লেগে তারকাখচিত বার্সেলোনাকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল দশ জনে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া ব্লু’জ। ‘এক্সট্রা টাইমে’ ফের্রান্দো টোরেসের গোলটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল সেদিনের ম্যাচে। এই তো সেদিন ভ্যান ডাইকের গোলে লিগ কাপ ঘরে তুলল লিভারপুল, চেলসিকে হারিয়ে। কখন? সেই ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে।
বিদেশ নিয়ে তো অনেক হল, ঘরের কথা আর হল কই! মানে, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল। কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন দুই ক্লাব। ইতিহাস উভয়ের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। বড় ম্যাচে দুই প্রধানকে ঘিরে যে উত্তেজনার পারদ, তার তুলনা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই। অতিরিক্ত সময়ে বড়ম্যাচ গড়ানো মানেই, হৃদকম্প হওয়ার জোগাড় সমর্থকদের। অতীতে তার উদাহরণ ভূরি ভূরি। সাম্প্রতিক কালে বরং সংখ্যাটা বেশ কম। তবু হিসেবের বাইরে ফেলে রাখা কিয়ান নাসিরির কথাই ধরুন না। পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নেমে ডার্বিতে হ্যাটট্রিক, এ কি কম বাড়তি পাওনা সবুজ-মেরুন সমর্থকদের। সেই ‘এক্সট্রা’ লাভের আনন্দই যে আলাদা। যেমন অনন্য ইস্টবেঙ্গলের চলতি মরশুমে নাটকীয় সুপার কাপ জয়। ফাইনালে ওড়িশার চোখে চোখ রেখে বাজিমাত লাল-হলুদের। ম্যাচের ‘এক্সট্রা টাইমে’ ক্লেটন সিলভার জয়সূচক গোলটা শুধু এক যুগ পরে মশাল শিবিরের ট্রফি লাভ নয়, মনে করিয়ে দিয়েছিল সেই চেনা মিথ– ‘লড়াইয়ের আরেক নাম ইস্টবেঙ্গল’।
‘এক্সট্রা’ নিয়ে এত শব্দখরচ। শুধু ক্রিকেট আর ফুটবল নয়, এক্সট্রা টাইম রয়েছে বাস্কেট বল থেকে আইস-হকি, রাগবি থেকে হ্যান্ডবলে। কোথাও তা ৩০ মিনিট, কোথাও তা মিনিট পাঁচেক। বিস্তারিত আর নাই বা বললাম।
পাঠক, অনেক হল। এবার থামার পালা। ভুলে যাবেন না, চার বছরে এমন ‘এক্সট্রা দিন’ একটাই মেলে। সেই বাড়তি সময় শুধু একটা লেখাতেই কেন ব্যয় করবেন, রোববার.ইন-এ আরও অনেক ‘এক্সট্রা’ আপনাদের পাঠের অপেক্ষায়।